এবার সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ

এবার সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ

সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ। (ফাইল ছবি)

সাতটি পদে ৯৬০ জনকে নিয়োগ দিতে ২০১৮ সালের ৯ জুলাই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সমাজসেবা অধিদপ্তর। এর মধ্যে ছয়টি পদে নির্বাচিতরা নিয়োগ পেয়ে চাকরিও শুরু করেছেন; কিন্তু বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পাঁচ বছর পার হতে চললেও শেষ হয়নি সমাজকর্মী (ইউনিয়ন) পদে ৪৬৩ জনের নিয়োগ।

অভিযোগ উঠেছে, সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিতে বিভাগীয় নির্বাচন কমিটিকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। সেই প্রক্রিয়া বাধাহীন করতে মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের আগে মন্ত্রীর ইচ্ছায় নিয়োগ কমিটির দুজন সদস্যকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তাদের পরিবর্তে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মন্ত্রীর পছন্দের দুই কর্মকর্তাকে। তাদের একজন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি উপসচিব (প্রশাসন-৫) মো. দেলোয়ার হোসেন। অন্যজন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (পরিকল্পনা-৪) মো. মাহবুবুর রহমান। দুজনের বাড়িই রংপুর অঞ্চলে। এ দুজনকে দিয়ে মন্ত্রী তার পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগের ‘ছক’ তৈরি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ লালমনিরহাট-২ (কালীগঞ্জ-আদিতমারী) আসনের সংসদ সদস্য। মন্ত্রীর পক্ষে তার সহকারী একান্ত সচিব মিজানুর রহমান পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া তদারকি করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

কর্মকর্তারা জানান, বিভাগীয় নির্বাচন কমিটিতে কোনো সদস্য পরিবর্তন করতে হলে সচিবের নির্দেশেই তা হতে হয়; কিন্তু সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ নিজেই প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি অর্থাৎ, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ মিয়াকে পরিবর্তনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করে সমাজকল্যাণ সচিবকে চিঠি দেন। অথচ নিয়ম অনুযায়ী বিভাগীয় নির্বাচন কমিটির সদস্য পরিবর্তনের জন্য সচিবই ক্ষমতাপ্রাপ্ত। সচিব জাহাঙ্গীর আলম ওই কর্মকর্তাকে পরিবর্তন করতে চাননি বলে জানা গেছে।

এ ছাড়া বিভাগীয় নির্বাচন কমিটির আরেক সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিনকেও পরিবর্তনে সমাজকল্যাণমন্ত্রীর মৌখিক নির্দেশ ছিল বলে সূত্র জানিয়েছে। তার পরিবর্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা-৪ শাখার উপসচিব মো. মাহবুবুর রহমানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।

সচিবালয়ে সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের দপ্তরে গেলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, নিয়োগ কমিটির কোনো সদস্যকে আমার ইচ্ছায় পরিবর্তন করা হয়নি। আমার পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগের কোনো সুপারিশও নেই। গত সাড়ে ৯ বছর ধরে স্বচ্ছতার সঙ্গে আমরা কাজ করছি। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অর্জন ভণ্ডুল করতে অনেকে চেষ্টা করছেন।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম কালবেলাকে বলেন, কাকতালীয়ভাবে নিয়োগ কমিটির দুজন কর্মকর্তার বাড়ি রংপুরে। তবে এতেই যে তারা মন্ত্রীর ইচ্ছা অনুযায়ী নিয়োগ দেবেন, তা সম্ভব হবে না। লিখিত ও ভাইভার নম্বর যোগ করেই মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হবে। ভাইভার ঠিক আগে নিয়োগ কমিটির দুজন সদস্যকে কেন পরিবর্তন করা হলো—এমন প্রশ্নে সচিব বলেন, একজনকে

পরিবর্তন করেছে জনপ্রশাসন। অন্যজন আমরা পরিবর্তন করেছি। যাকে নতুন করে দেওয়া হয়েছে, আমরা মনে করেছি তিনি ভাইভার জন্য আরও বেশি দক্ষ। এজন্যই মূলত পরিবর্তন করা হয়েছে। জুলাই বা আগস্টের মধ্যে সমাজকর্মী (ইউনিয়ন) পদে নিয়োগ সম্পন্ন হবে বলেও জানান সচিব।

জানা গেছে, সমাজকর্মী পদে লিখিত পরীক্ষার প্রথম তারিখ ছিল ২০১৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর; কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। এরপর গত বছরের ২১ অক্টোবর লিখিত পরীক্ষা হয়। ৬ লাখ ৬২ হাজার ২৭০ প্রার্থীর মধ্যে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৬৪১ জন লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। উত্তীর্ণ হন ৫ হাজার ১৭৮ জন। এরই মধ্যে তাদের মৌখিক পরীক্ষাও শেষ হয়েছে। তবুও চূড়ান্ত ফল প্রকাশে বিলম্ব করছে সমাজসেবা অধিদপ্তর।

সমাজকর্মী পদের সঙ্গে হাউস প্যারেন্ট কাম টিচার পদে ১৩, সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে ১০, ফিল্ড সুপারভাইজার পদে ৫০, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক ১৫৭, গাড়িচালক পদে ১২ এবং অফিস সহায়ক পদে ২৫৫ জন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল সমাজসেবা অধিদপ্তর। এসব পদে নিয়োগ শেষ হলেও সমাজকর্মী নিয়োগে গড়িমসি করছে কর্তৃপক্ষ।

নিয়োগ বিলম্বের কারণ জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) এবং বিভাগীয় নির্বাচন কমিটির সভাপতি সৈয়দ মো. নূরুল বাসির বলেন, ঈদের পরই আমরা নিয়োগের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করতে পারব। লিখিত পরীক্ষার পর মৌখিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার ঠিক আগ মূহূর্তে কেন নিয়োগ কমিটির দুজন সদস্যকে পরিবর্তন করা হয়েছে—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটি মন্ত্রণালয় জানে। আমি এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে পারব না।

মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিয়োগ ঘিরে একটি চক্র সবসময়ই সক্রিয় থাকে। তারা ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন পদে নিয়োগে তৎপর থাকে। নিয়োগ আটকে থাকা সমাজকর্মী পদটি তৃতীয় শ্রেণির। এ পদেও জনপ্রতি ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা লেনদেন হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। একাধিক সূত্র বলছে, সমাজসেবার বিভিন্ন নিয়োগে মেধার চেয়ে অন্যকিছু প্রাধান্য পায়। এখানে নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত বলে গুঞ্জন রয়েছে।