হজে সাফা-মারওয়া সায়ি করবেন কেন?

হজে সাফা-মারওয়া সায়ি করবেন কেন?

ফাইল ছবি

সাফা-মারওয়া সায়ি করা মহান আল্লাহর অনন্য এক নিদর্শন। এটি পবিত্র হজের অন্যতম একটি আমল। হজ ও ওমরায় সাফা-মারওয়া সায়ি করা ওয়াজিব। তবে তা সুন্নত পদ্ধতিতেই করতে হবে, তা না হলে ওয়াজিব আদায় হবে না। আর কেউ তা করতে ভুলে গেলে বা ইচ্ছাকৃত না করলে তার ওপর কাফফারা হিসেবে দম ওয়াজিব হবে।

সায়ি আরবি শব্দ। অর্থ- দ্রুত চলা ও চেষ্টা করা। ইসলামি শরিয়তে সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে বিশেষ রীতিতে সাতবার প্রদক্ষিণ করাকে সায়ি বলা হয়। উল্লেখ্য, সাফা ও মারওয়া পবিত্র কাবা ঘরের পূর্ব-দক্ষিণ ও পূর্ব-উত্তর কোণে অবস্থিত দুটি বিখ্যাত পাহাড়। 

সায়ি রুকন
শুধুমাত্র সাফা ও মারওয়ার মধ্যে সায়ি করাই হচ্ছে সায়ির রুকন। কোনো ব্যক্তি সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে সায়ি না করে এদিক ওদিক করলে সায়ি শুদ্ধ হবে না।

সায়ির জন্য শর্ত
১. সায়ি নিজেকেই  করতে হবে। নিজে নিজে সায়ি করতে অসমর্থ হলে বাহনে করে সায়ি করা যাবে। ওজর বা অজ্ঞান হওয়া ব্যতীত কেউ কারো সায়ি করতে আদায় করতে পারবে না
২. পূর্ণ তাওয়াফ বা তাওয়াফের অধিকাংশ চক্কর সম্পন্ন  করার পরই সায়ি করা। তাওয়াফের ন্যূনতম চার চক্কর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে সায়ি করলে তা সহিহ হবে না।
৩. সায়ির আগেই হজ ও ওমরার ইহরাম বাধতে হবে।
৪. সায়ি সাফা পাহাড় হতে আরম্ভ করতে হবে। মারওয়া থেকে শুরু করলে প্রথম চক্কর গণ্য হবে না।
৫. সায়ির অধিকাংশ চক্কর পূর্ণ করা। না করলে সায়ি আদায় হবে না।
৬. নির্ধারিত সময়ে সায়ি করা। হজের সায়ির জন্য এটি শর্ত।

সায়ির ওয়াজিবসমূহ
১. যাবতীয় অপবিত্রতা হতে মুক্ত হয়ে তাওয়াফের পর সায়ি করা।
২. সায়ি সাফা হতে আরম্ভ করা এবং মারওয়াতে শেষ করা।
৩. পায়ে হেটে সায়ি করা। বিনা ওজরে বাহনে চড়ে সায়ি করলে দম বা কোরবানি ওয়াজিব।
৪. সাত চক্কর পূর্ণ করা। ফরজ চার চক্করের পর আরো তিন চক্কর পূর্ণ করা। যদি কেউ তিন চক্কর ছেড়ে দেয় তবে সায়ি হবে কিন্তু প্রতি চক্করের পরিবর্তে পৌনে দুই সের গম বা সমপরিমাণ মূল্য সদকা করা ওয়াজিব।
৫. ওমরার সায়ির ক্ষেত্রে ওমরার ইহরাম সায়ি সমাপ্ত করা পর্যন্ত বহাল থাকা।
৬. সাফা এবং মারওয়ার মধ্যবর্তী পূর্ণ দুরুত্ব অতিক্রম করা। ‍Safa to Marwa

সায়ির সুন্নতসমূহ
১. হাজরে আসওয়াদ ইস্তিলাম করে সায়ির উদ্দেশ্যে মসজিদ থেকে বের হওয়া।
২. তাওয়াফের পরপরই সায়ি করা। Safa

৩. সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের ওপর আরোহন করা এবং কেবলামুখী হওয়া।
৪. সায়ির চক্কর পরপর সমাপন করা।
৫. জানাবাত এবং ঋতুস্রাব থেকে পবিত্র থাকা।
৬. এমন তাওয়াফের সায়ি করা যা পবিত্রাবস্থায় সম্পন্ন করা হয়েছে এবং কাপড়, শরীর ও তাওয়াফের জায়গাও পবিত্র ছিল এবং অজু ছিল।
৭. সবুজ বাতি চিহ্নিত স্থানে দ্রুতপায়ে অতিক্রম করা।

সায়িতে যা মাকরুহ
১. ক্রয়-বিক্রয় কথা-বার্তা বলার দরুন একাগ্রতা নষ্ট হয়ে যায় এবং দোয়া পাঠ করতে অসুবিধা হয়।
২. বিনা ওজরে সায়িকে তাওয়াফ হতে অথবা কোরবানির দিনসমূহ হতে বিলম্বিত করা।
৩. বিনা সতরে সায়ি করা।
৪. সবুজ বাতি চিহ্নিত স্থানে দ্রুত না চলা।
৫. চক্করসমূহের মধ্যে সময়ের ব্যবধান অনেক হওয়া।
৬. সাফা ও মারওয়া আরোহন না করা।

সায়ির মোস্তাহাব
নিয়তের সহিত সাফা ও মারওয়ার ওপর দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকা। বিনয় ও নম্রতা সহকারে তিন-তিন বার জিকির ও দোয়া করা। সায়ি চক্করসমূহের মধ্যে বিনা ওজরে বেশি ব্যবধান হয়ে গেলে পুনরায় নতুন করে সায়ি শুরু করা। সায়ি সমাপ্ত করে মসজিদে গিয়ে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করা।

সায়ির সুন্নত নিয়ম
বাবুস সাফা দিয়ে সাফা পাহাড়ের ওপরে ওঠে ‘আবদাউ বিমা বাদাআল্লাহু বিহি ইন্নাস সাফা ওয়াল মারওয়াতা মিন শাআইরিল্লাহি’ বলে  কাবার দিকে তাকিয়ে উভয় হাত কাঁধ পর্যন্ত তুলে তিনবার হামদ ও সানা পাঠ করা। তারপর উচ্চস্বরে তাকবির ও তাহলিল (আল্লাহু আকবার ও লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু) পাঠ করা। তারপর দরুদ পাঠ করা। তারপর নিজের প্রয়োজনীয় দোয়া করা।

সবুজ বাতি চিহ্নিত স্থানের দোয়া
সবুজ চিহ্নিত স্থান দ্রুততার সহিত অতিক্রম করা এবং এই দোয়াটি পাড়া—উচ্চারণ- রাব্বিগফির ওয়ারহাম আনতাল আআ’যযু ওয়াল আকরাম’।

সায়ি করার কারণ ও ইতিহাস
মা হাজেরা (আ.)-এর স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতেই হজ ও ওমরায় সায়ি করার এ বিধান। ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায়- মহান আল্লাহ হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে কঠিন থেকে কঠিনতর পরীক্ষার মুখোমুখি করেছিলেন। সেই পরীক্ষাগুলোর একটি ছিলো— আল্লাহ তাআলার আদেশে স্ত্রী ও দুগ্ধপোষ্য ছেলে ইসমাইলকে সিরিয়া থেকে মক্কার মরুভূমিতে রেখে যেতে হয়েছিল। তখন মক্কা ছিল নির্জন মরুপ্রান্তর। 

সেখানে ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে থাকতে হবে মা হাজেরা (আ.)-কে। আল্লাহর ওপর ভরসা করে সেখানে থাকা শুরু করার কিছুদিন পর খাদ্য ও দুগ্ধ ফুরিয়ে গেলে উপায়ন্তর না দেখে হাজেরা (আ.) ছুটে চললেন নিকটতম পাহাড় সাফার দিকে। সাফা সংলগ্ন উপত্যকা থেকে নিয়ে দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত কোথাও পানির সন্ধান মিলল না। মারওয়া পাহাড়ের ওই পাশে হয়তো পানি পাওয়া যাবে—এমনটা ভেবে সাফা থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে আরোহণ করলেন মারওয়ার চূড়ায়।

সেখানে দাঁড়িয়েও চারদিকে চোখ বুলিয়ে ব্যর্থ হলেন। শিশুপুত্রের মুখে পানি তুলে দেওয়ার জন্য এভাবেই অস্থির হয়ে সাতবার সাফা-মারওয়ার মাঝে দৌড়াদৌড়ি করছিলেন তিনি। উভয় পাহাড়ের নিচু উপত্যকাটি প্রত্যেকবার তিনি দৌড়ে অতিক্রম করেছেন। কেননা ওই স্থান থেকে শিশু ইসমাইলকে দেখতে পেতেন না। মা হাজেরার এই অস্থিরতা ও দৌড়াদৌড়ি আল্লাহর কাছে অনেক পছন্দ হয়ে যায়। 

আর এ কারণেই আল্লাহ তাআলা মুসলিম মিল্লাতের জন্য হজরত হাজেরা (আ.)-এর এ কাজকে স্মৃতি স্মারকস্বরূপ হজ ও ওমরায় রুকন হিসেবে সাব্যস্ত করেন। পুরুষরা সায়ির মধ্যে পাহাড়ের উপত্যকার স্থানটুকু (কিছুটা হাল্কা দৌড়ের মতো) অতিক্রম করেন। যা বর্তমানে সবুজ বাতি দ্বারা চিহ্নিত আছে। তবে এ স্থানটুকু নারীদের দৌড়াতে হয় না; কারণ মা হাজেরার দৌড়ানোর বদৌলতে এবং তাঁর সম্মানে আল্লাহ তাআলা কেয়ামত পর্যন্ত সব নারীকে দ্রুত চলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। 

অবশেষে আল্লাহ তাআলা হজরত জিব্রাইল (আ.)-কে পাঠিয়ে ইসমাইল (আ.)-এর পায়ের কাছে একটি ঝরনা জারি করে দিলেন। এটাই পরবর্তীতে জমজম নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। ইমাম বুখারি (রহ.) ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে এ সংক্রান্ত দীর্ঘ একটি হাদিস বর্ণনা করেন। হাদিসের শেষাংশে ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুল (স.) বলেছেন- হাজেরার এই অস্থির ছুটোছুটির স্মারক হিসেবেই হজে ও ওমরায় সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে সায়ি করা ওয়াজিব করা হয়েছে। (বুখারি: ১/৪৭৪-৪৭৫) 

হাজেরা (আ.) যে অস্থিরতা, অসহায়ত্ব এবং আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষিতা নিয়ে ছুটোছুটি করছিলেন সাফা মারওয়ায় সায়িকারীদেরও উচিত সেই অসহায়ত্ব, নিঃস্বতা ও আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষিতার বোধ ও বিশ্বাস নিয়ে সায়ি করা। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মা হাজেরার অস্থির ছোটাছুটির গুরুত্ব বোঝার এবং নবী (স.)-এর দেখানো পদ্ধতিতে সাফা-মারওয়া সায়ি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।