রাহুলকে মণিপুরে পুলিশি ‘বাধা’, আবারো গোলাগুলি

রাহুলকে মণিপুরে পুলিশি ‘বাধা’, আবারো গোলাগুলি

সংগৃহীত

অশান্তির আগুনে জ্বলছে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের রাজ্য মণিপুর। তপ্ত পরিস্থিতিতে রাহুল গান্ধীর সফর ঘিরে বৃহস্পতিবার দিনভর সরগরম ছিল রাজ্যটিদে। সফরের শুরুতেই ‘বাধা’র মুখে পড়েন কংগ্রেস নেতা।

মণিপুরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওকরাম ইবোবি সিংহ, এআইসিসির সাধারণ সম্পাদক অজয় সিংহসহ কংগ্রেস নেতাদের সাথে নিয়ে ইম্ফল থেকে চূড়াচাঁদপুরের শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার পথে বিষ্ণুপুর এলাকায় রাহুল এবং তার সঙ্গীদের পুলিশি বাধার মুখে পড়তে হয়। শেষে বিজেপি শাসিত মণিপুর পুলিশের ‘পরামর্শ’ মেনে হেলিকপ্টারে চড়ে চূড়াচাঁদপুর জেলার কয়েকটি শরণার্থী শিবিরে ঘরছাড়াদের সাথে দেখা করলেন তিনি। শরণার্থী শিবিরে শিশুদের সাথে খেয়েছিলেন দুপুরের খাবার।

দু’দিনের মণিপুর সফরে বৃহস্পতিবার সকালে মণিপুর পৌঁছান রাহুল। সহিংসতা কবলিত এলাকায় শরণার্থীদের সাথে দেখা করতে যাওয়ার সময় রাহুলের কনভয় আটকানো হয় বলে অভিযোগ ওঠে।

ইম্ফল থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে বিষ্ণুপুর এলাকায় রাহুলের পথ আটকায় পুলিশ। এ নিয়ে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি।

যদিও পুলিশ দাবি, কনভয়ে হামলার আশঙ্কাতেই রাহুলের পথ আটকানো হয়। পরে তিনি রাজ্যের সরকারি ব্যবস্থাপনায় চূড়াচাঁদপুরে যান। মণিপুরে রাহুলকে ‘বাধা’ দেয়ার ঘটনায় মোদি সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে তৃণমূলসহ বিরোধী দল।

রাহুলের সফরের মধ্যেই নতুন করে অশান্তির খবর পাওয়া গেছে মণিপুরে। চলেছে গোলাগুলি। প্রাণহানির খবরও পাওয়া গেছে।

রাহুলের সফরে কী ঘটেছে
বিমানে করে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১১টায় ইম্ফলে পৌঁছান রাহুল। এরপরেই চূড়াচাঁদপুরের শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার উদ্দেশে রওনা দেয় তার গাড়ি। মণিপুরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওকরাম ইবোবি সিংহ, এআইসিসির সাধারণ সম্পাদক অজয় সিংহসহ কংগ্রেস নেতাদের সাথে নিয়ে রওনা দেন তিনি। বিষ্ণুপুর এলাকায় রাহুল এবং তার সঙ্গীদের পুলিশি বাধার মুখে পড়তে হয় বলে অভিযোগ।

এআইসিসির সাধারণ সম্পাদক কেসি বেণুগোপাল জানান, ইম্ফল থেকে ২০-২৫ কিলোমিটার দূরে বিষ্ণুপুর এলাকায় কনভয় আটকে দেয়া হয়। রাহুলকে ওই এলাকায় যেতে দেয়া ঠিক হবে না বলে জানায় পুলিশ। ওই সময় রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে বহু মানুষ। রাহুলের উদ্দেশে তাদের হাত নাড়তে দেখা যায়। গাড়ির মধ্যে বসেছিলেন রাহুল।

বিষ্ণুপুরের পুলিশ সুপার হেইসনাম বলরাম সিংহ জানান, রাহুলের নিরাপত্তা নিয়ে তারা চিন্তিত। তাই তাকে যেতে দেয়া ঠিক হবে না।

কনভয়ে হামলা হতে পারে বলে গোয়েন্দা সূত্রে খবর এসেছিল, দাবি পুলিশের। রাহুলের বিরুদ্ধে স্লোগানও শোনা যায় বলে দাবি করেছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। এই আবহে রাহুলকে কপ্টারে যাওয়ার পরামর্শ দেয় পুলিশ। পরে সড়কপথের বদলে আকাশপথে চূড়াচাঁদপুর জেলায় পৌঁছান রাহুল।

কী বলেছেন রাহুল
হেলিকপ্টারে করে চূড়াচাঁদপুরে পৌঁছে সেখানে শরণার্থী শিবিরে যান রাহুল। কথা বলেন শরণার্থীদের সাথে। সেখানে শিশুদের সাথে বসে দুপুরের খাবার খান তিনি। পরে ইম্ফলেরও একটি শরণার্থী শিবিরে যান কংগ্রেস নেতা। তার সফরে পুলিশি ‘বাধা’ নিয়ে পরে সরব হয়েছেন রাহুল।

সামাজিক যোগযোগমাধ্যম টুইটারে তিনি জানান, ‘মণিপুরের সমস্ত ভাই-বোনদের কথা শুনতে এসেছিলাম। সব সম্প্রদায়ের মানুষ স্বাগত জানিয়েছেন। খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে সরকার আমায় আটকাচ্ছে। শান্তি আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।’

শুক্রবার ইম্ফলের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার কথা রাহুলের। যুযুধান মেইতেই জনগোষ্ঠী, কুকি ও নাগা জনজাতির নাগরিক সমাজের সাথেও বৈঠকে বসবেন তিনি। দিল্লি ফেরার আগে কংগ্রেস ভবনে সাংবাদিক সম্মেলন করতে পারেন তিনি। জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে রাহুলই প্রথম মণিপুরে গেলেন।

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি কেশম মেঘচন্দ্র জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার রাতে ইম্ফলে থাকবেন রাহুল। তবে শুক্রবারের কর্মসূচি তিনি করতে পারবেন কি-না, তা স্পষ্ট নয়।

কংগ্রেস বনাম বিজেপি
মণিপুরে রাহুলের পথ আটকানো নিয়ে কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে সঙ্ঘাত নয়া মাত্রা পেল। কং‌গ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে টুইটারে লিখেছেন, ‘মোদির ডবল ইঞ্জিনের সর্বনাশা সরকার এখন রাহুলকে আটকাতে স্বৈরাচারী আচরণ করছে।’

কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়ঙ্কা গান্ধী টুইটারে লিখেছেন, ‘শান্তি ফেরানো সকল দেশপ্রেমীর কাছেই প্রধান লক্ষ্য। মণিপুরের বাসিন্দাদের যন্ত্রণা ভাগ করে নিতে সেখানে গিয়েছেন রাহুল। শান্তির বার্তা দিতে গিয়েছেন। বিজেপি সরকারেরও তা করা উচিত। কেন সরকার রাহুলকে রুখতে চায়?’

মণিপুরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওকরাম ওকরাম ইবোবি সিংহ বলেছেন, ‘রাজনীতি করতে আমরা আসিনি। যারা দুর্ভোগে পড়েছেন, তাদের সাথে দেখা করতে এসেছি।’

কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক কেসি বেণুগোপাল বলেছেন, ‘কেন আমাদের আটকাল মণিপুর সরকার, তা জানি না। শান্তি ফেরাতেই রাহুলের সফর।’

তবে পাল্টা জবাব দিচ্ছে বিজেপি। মণিপুরে গিয়ে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ’ করেছেন বলে কটাক্ষ করেছেন বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র তথা মণিপুরে দলের ইনচার্জ সম্বিত পাত্র।

তিনি বলেন, ‘একগুঁয়েমির থেকে সংবেদশীল হওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

রাহুলকে ‘রাজনৈতিক সুবিধাবাদী’ বলে কটাক্ষ করেছেন বিজেপির অমিত মালবীয়।

সরব বিরোধীরা
মণিপুরে রাহুলকে ‘বাধা’ দেওয়ায় সরগরম জাতীয় রাজনীতি। এ ঘটনার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে বিভিন্ন বিরোধী দলের নেতারা।

রাজ্যসভায় তৃণমূলের নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেছেন, ‘মোদি-শাহের বিজেপি এখন মরিয়া হয়ে গেছে। এক মাস আগে মণিপুরে প্রবেশের অনুমতি চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাকে অনুমতি দেয়া হয়নি। ঠিক এক মাস পরে রাহুল গান্ধীকেও প্রবেশ করতে দেয়া হলো না। নিশ্চিতভাবে এটাই বিজেপি সরকারের শেষ ৩০০ দিন।’

এনসিপি প্রধান শরদ পওয়ার বলেছেন, ‘মণিপুর জ্বলছে। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না মোদি সরকার।’

তামিলনাড়ুর মন্ত্রী উদয়নিধি স্ট্যালিন টুইটারে এ ঘটনার নিন্দাপ্রকাশ করেছেন।

আরজেডি সাংসদ মনোজ ঝা বলেছেন, ‘মণিপুরে রাহুলের সফরের সুব্যবস্থা করা উচিত ছিল প্রশাসনের। প্রধানমন্ত্রীরও সেখানে যাওয়া উচিত।’

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এই ধরনের মন্তব্যে পটনা বৈঠকের পর এবং ১৩ জুলাই বেঙ্গালুরুর বৈঠকের আগে আরো একবার বিজেপি বিরোধী ঐক্যের ছবি প্রকাশ্যে এসেছে।

আবার গোলাগুলি মণিপুরে
বৃহস্পতিবার রাহুলের সফরের মধ্যেই নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে মণিপুরে। হারাওথেল গ্রামে টহল দেয়ার সময়ে হঠাৎই ভোরের দিকে সেনা কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে শুরু করে কয়েকজন অজ্ঞাত পরিচয়ের দুষ্কৃতিকারী।

সেনা বাহিনী তরফে জানানো হয়েছে, ‘পারিপার্শ্বিক ক্ষয়ক্ষতি’ এড়াতে পাল্টা গুলি চালায় তারাও। বিপুল সংখ্যক জনতা ওই এলাকায় জড়ো হয়েছিল। এ ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে আরো অনেকে।

কেন অশান্ত মণিপুর
গত ৩ মে মণিপুরের জনজাতি ছাত্র সংগঠন অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অফ মণিপুরের (এটিএসইউএম) বিক্ষোভ-মিছিল ঘিরে উত্তর-পূর্বের ওই রাজ্যে অশান্তির সূত্রপাত। মণিপুর হাইকোর্ট মেইতেইদের তফসিলি জনজাতির মর্যাদা দেয়ার বিষয়টি রাজ্য সরকারকে বিবেচনা করার নির্দেশ দিয়েছিল। তারপরেই জনজাতি সংগঠনগুলো তার বিরোধিতায় রাস্তায় নামে। আর ওই ঘটনা থেকেই সংঘাতের সূচনা হয় সেখানে। মণিপুরের আদি বাসিন্দা হিন্দু ধর্মাবলম্বী মেইতেই জনগোষ্ঠীর সাথে কুকি, জোসহ কয়েকটি তফসিলি জনজাতি সম্প্রদায়ের (যাদের বেশিরভাগ খ্রিস্টান) সংঘর্ষ ঠেকাতে গত ৬ মে মণিপুরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল নরেন্দ্র মোদি সরকার। নামানো হয় সেনা বাহিনী ও আসাম রাইফেলসকে।

বহু মানুষের প্রাণহানি
গত দেড় মাসে মণিপুরে গোষ্ঠী সংঘর্ষে শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রঞ্জন সিংহের বাড়িতে পেট্রল বোমা ছোড়ার অভিযোগ উঠেছে। মণিপুর সরকারের একমাত্র নারী মন্ত্রী কাংপোকপি কেন্দ্রের বিধায়ক নেমচা কিগপেনের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল বিক্ষুব্ধ জনতা। রাজ্যের জনস্বাস্থ্য, কারিগরি ও ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের মন্ত্রী এল সুসিন্দ্র মেইতেইয়ের বাড়ি-সংলগ্ন একটি গুদামঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতিরা। অশান্তির মধ্যেই ওই রাজ্যে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কিন্তু তারপরও পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি। বিজেপি শাসিত মণিপুরে অশান্তি নিয়ে সরগরম জাতীয় রাজনীতি। ওই রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি তুলেছে বেশ কয়েকটি বিরোধী দল। মণিপুর পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কেন নীরব, ওই প্রশ্নও তুলেছে বিরোধীরা। গত শনিবার মণিপুর নিয়ে দিল্লিতে সর্বদল বৈঠক করেছিলেন অমিত শাহ। মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংহের সাথেও বৈঠক হয় শাহের। সাত দিনের বিদেশ সফর সেরে দেশে ফেরার পরই মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার শাহের সাথে বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা