সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবারের ৫ সদস্যকে হারিয়ে নির্বাক পিতা

সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবারের ৫ সদস্যকে হারিয়ে নির্বাক পিতা

সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবারের ৫ সদস্যকে হারিয়ে নির্বাক পিতা

যশোরের লেবুতলা ট্রাজেডিতে পরিবারের ৫ সদস্যকে হারিয়ে নির্বাক গৃহকর্তা হেলাল হোসেন। শোকে পাথর হয়ে গেছে পরিবারের অন্য সদস্যরাও। অনেকে হারিয়ে ফেলেছেন কান্নার শক্তি। অপলোক চোখে শোকাহতরা তাকিয়ে আছে উঠানে সারি সারি থাকা খাটিয়ার দিকে। খাটিয়ায় শুয়ে থাকা নিথর দেহ গুলো দাফনের প্রহর গুনছে। দূর্ঘটনার খবর শুনে রাতেই আত্নীয় স্বজনরা নিহতদের বাড়িতে ভিড় শুরু করে। সবাই সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন শোকাহতদের শান্তনা দেওয়ার । কিন্তু কোন শান্তনাই তাদেরকে শান্ত করতে পারছে না।

এক সঙ্গে পরিবারের ৫ সদস্যকে দাফনের প্রস্তুতি চলছিল পাশের কবর স্থানে। সে এক মর্মান্তিক দৃশ্য। সবাই শোকাহত। ভগ্ন হৃদয়ে সবাই কাতরকন্ঠে শোকাহত পরিবারের সদস্যদের পাশে বসে শান্তনার মিথ্যা আশ্বাসবানী শোনাচ্ছেন। গতকাল শনিবার সকালে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার যাদবপুর গ্রামের মুন্সিপাড়ায় পৌছালে চোখে পড়ে এই করুন দৃশ্য। চারিদিকে চাপা কান্নার রোলে পরিবেশ ও আশেপাশের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে।

যমজ ২ ছেলে হাসান ও হোসেনকে সাথে করে অসুস্থ মেয়ে খাদিজার চিকিৎসার জন্য ইজিবাইকে যশোরে যাচ্ছিলেন মা সোনিয়া খাতুন। সাথে ছিলেন সোনিয়ার মা মাহিমা, খালা রাহিমা ও খালাতো বোন জেবা তাহিরা। কিন্তু হাসপাতালে যাওয়ার পথে লেবুতলা বাজারে বেপোরোয়া একটি বাসের চাপায় হারিয়েছেন তার দুই ছেলে, মা, খালা আর খালাতো বোনকে। নিজেও ঢাকায় চিকিৎসা নিচ্ছেন আর অসুস্থ মেয়ে আহত খাদিজা ভর্তি যশোর জেনারেল হাসপাতালে।

গত শুক্রবার সন্ধ্যায় বাসচাপায় মারা যান বাবুল মুন্সির স্ত্রী মাহিমা ও তার দুই নাতি হাসান ও হোসেন। যমজ এই দুই ভাইয়ের বয়স দুই বছর এক মাস। একই দুর্ঘটনায় নিহত হন মাহিমা খাতুনের বোন একই উপজেলার বন্দবিলা ইউনিয়নের সেকেন্দারপুর গ্রামের রাহিমা বেগম মুক্তা (৩২) ও তার মেয়ে জেবা তাহিরা (৫)। রাহিমার স্বামীর নাম সাইদুল ইসলাম। তিনি মালয়েশিয়া প্রবাসী। প্রবাসী সাইদুল ইসলামের বড় ভাই সিরাজুল ইসলাম পেশায় সাংবাদিক। তিনিও একই সঙ্গে ৫ স্বজনকে হারিয়ে নির্বাক হয়ে পড়েছেন।এই দুর্ঘটনায় একই পরিবারের পাঁচ জন ছাড়াও মারা যান ইজিবাইক চালক একই উপজেলার মথুরাপুর গ্রামের ওবায়দুর রহমানের ছেলে আবু মুসা (১৭) ও আরেক যাত্রী সদর উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের সাইদুল ইসলামের ছেলে ইমরান (২৫)।

শনিবার সকালে যাদবপুরে নিহত মাহিমার বাড়িতে যেয়ে অভাবনীয় এক দৃশ্য চোখে পড়ে। বাড়ির উঠানে প্রতিবেশীরা ছাড়াও আত্মীয়-স্বজনদের ভিড়। কান্নার রোলে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। আর দুই সন্তানের মৃত্যু, শ্বাশুড়ী, খালা শ্বাশুড়ী ও তার কন্যার মৃত্যুতে নির্বাক হেলাল হোসেন। হাসপাতালে মৃুত্যর প্রহর গুনছেন স্ত্রী সোনিয়া ও মেয়ে খাদিজা পারভীন।

হেলাল হোসেন বাঘারপাড়া উপজেলার যাদবপুর গ্রামেরই বাসিন্দা। তিনি ঢাকার হেমায়েতপুরে একটি চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় কর্মরত আছেন। দুর্ঘটনার খবরে রাতেই রওনা দিয়ে ভোরে বাড়ি এসে পৌঁছেছেন হেলাল। তিনি স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে ঢাকাতেই বসবাস করতেন। কোরবানির ঈদের আগে সবাই গ্রামে এসেছিলেন। ছুটি শেষে হেলাল হোসেন কর্মস্থলে ফিরে গেলেও স্ত্রী সোনিয়া বেগম যমজ সন্তান হাসান- হোসেন ও মেয়ে খাদিজাকে (৫) নিয়ে বাড়িতে ছিলেন। অসুস্থ মেয়ের চিকিৎসা করানোর জন্য ঢাকায় না গিয়ে নিজ বাড়িতেই থেকে যান। পরিকল্পনা ছিল মেয়ের চিকিৎসা শেষে ৩ ছেলে মেয়েকে নিয়ে ফিরে যাবেন স্বামীর কাছে। কিন্তু শুক্রবারেরঘটে যাওয়া লেবুতলা ট্রাজেডি তাদের সব স্বপ্ন ভেঙ্গে দিয়েছে ।

সোনিয়ার চাচা ছোটন হোসেন বলেন, খাদিজার গলায় টিউমার ছিল। এটি অপারেশনের জন্য শুক্রবার বিকালে তারা বাড়ি থেকে ইজিবাইকে যশোরের একটি কিনিকে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে লেবুতলা এলাকায় পৌছালে বিপরীত দিক থেকে আসা বেপরোয়া রয়েল পরিবহনের একটি বাস তাদের চাপা দিয়ে কিছু দূর সামনে টেনে নিয়ে যায়। এতে আমাদের পরিবারের পাঁচ জন মারা যান। এ ছাড়া আমার ভাইঝি সোনিয়া ও তার মেয়ে খাদিজা গুরুতর আহত হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় গতকাল রাতেই সোনিয়াকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খাদিজা যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।এদিকে গতকাল শনিবার বেলা সাড়ে ১০টায় যাদবপুর ঈদগাহ ময়দানে গন নামাজে জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে নিহতদের দাফন করা হয়।অপরদিকে, একই উপজেলার বন্দবিলা ইউনিয়নের সেকেন্দারপুর গ্রামে প্রবাসী সাইদুল ইসলামের বাড়িতেও একই অবস্থা দেখা যায়। আত্মীয়- স্বজন ও প্রতিবেশীদের কান্নার রোলে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।

প্রবাসী সাইদুল ইসলামের বড় ভাই সাংবাদিক সিরাজুল ইসলাম বলেন, রাহিমা বেগম মুক্তা ও তার মেয়ে জেবা তাহিরা স্বজনদের সঙ্গে যশোরে কিনিকে যাওয়ার পথে মারা যান শুক্রবার সন্ধ্যায়। তার ভাই সাইদুল ইসলাম মালয়েশিয়া প্রবাসী। মাস দুয়েক আগে সর্বশেষ তিনি দেশে এসেছিলেন। সাইদুলের তিন মেয়ে। বড় মেয়ে সুমাইয়া শিরিন ষষ্ঠ শ্রেণিতে, মেজো মেয়ে রিফা তামান্না পঞ্চম শ্রেণিতে এবং জেবা তাহিরা এ বছর স্কুলে ভর্তি হয়। সকাল ১১ টায় জানাজা শেষে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।গত কালকের দুর্ঘটনার বিষয়ে যশোর কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়েছে জানিয়ে ওসি মো. তাজুল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বাসের চালকও হেলপার কে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

উল্লেখ্য, শুক্রবার (৭ জুলাই) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে যশোর-মাগুরা সড়কের লেবুতলা বাজারে এই দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় ২ যমজ ছেলে সন্তানসহ একই পরিবারের ৫ জনসহ সর্বমোট ৭ জন নিহত হয়। এ ঘটনায় আহত হয় কমপক্ষে ১৫ জন।