জ্বরের যেসব উপসর্গ দেখলে দ্রুত হাসপাতালে যাবেন

জ্বরের যেসব উপসর্গ দেখলে দ্রুত হাসপাতালে যাবেন

ছবিঃ সংগৃহীত।

বাংলাদেশে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এমন কিছু উপসর্গ দেখা যাচ্ছে যা ডেঙ্গুর প্রথাগত উপসর্গ নয়। চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু হয়েছে তা বুঝতে না পারার কারণে হাসপাতালে যেতে দেরি করছে রোগীরা। ফলে শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে গেলেও অনেকেই মারা যাচ্ছে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৫০ জন। এদের ৮০ ভাগই হাসপাতালে ভর্তির এক থেকে তিন দিনের মধ্যে মারা গেছে। বাকিদের মধ্যে ১৪ ভাগ ৪ থেকে ১০ দিনের মধ্যে এবং ছয় ভাগের মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে ভর্তির ১১ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে যাওয়াটাই ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যুর একটি বড় কারণ।

এ বিষয়ে মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ নিয়াতুজ্জামান বলেন, ‘এর বড় একটি কারণ হলো ডেঙ্গুর যে নতুন উপসর্গ এগুলোর সাথে (মানুষ) অপরিচিত বা তারা এই উপসর্গ সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত নয়। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রেই তারা যাখন হাসপাতালে পৌঁছাচ্ছে তখন অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর এ পর্যন্ত আট হাজার ৭৫৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে।

তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ডেঙ্গু মৌসুম চলতে থাকার কারণে বর্তমান সময়ে যে কারো শরীরে অস্বাভাবিক কোনো উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে তার একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো উচিত।

সাধারণত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে জ্বর, প্রচণ্ড মাথাব্যথা, শরীর ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা দেয়।

এবার এ ধরনের উপসর্গ নিয়েও রোগীরা হাসপাতালে যাচ্ছে। তবে এদের সংখ্যা কম বলে জানান নিয়াতুজ্জামান।

এর তুলনায় এবার হাসপাতালে যারা ভর্তি হচ্ছে তাদের মধ্যে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এমন রোগীর সংখ্যা বেশি।

তিনি বলেন, ‘তারা হয়ত আগে একটি ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত হয়েছিল। এখন তারা হয়ত অন্য একটি ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত, ফলে যে উপসর্গগুলো নিয়ে তারা আসছে- সেগুলো প্রথাগত ডেঙ্গু উপসর্গের মতো নয়।’

একে বলা হচ্ছে, কমপ্লিকেটেড ডেঙ্গু সিনড্রোম বা এক্সটেনডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম। এই উপসর্গগুলো কোনোভাবেই অবহেলা করার সুযোগ নেই।

পরিবর্তিত উপসর্গ
মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ নিয়াতুজ্জামান যেসব উপসর্গের কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলো হচ্ছে-

১. দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া : তিন দিন বা চার দিন ধরে ডায়রিয়ায় ভুগছে কিন্তু তা ভালো হচ্ছে না। এমন উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। বর্তমানে ডেঙ্গুর নতুন যেসব উপসর্গ দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে এটাই বেশ উল্লেখযোগ্য। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর যে ডায়ারিয়া হয় তার সাথে সাধারণ ডায়রিয়ার কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। যে কারণে ডায়রিয়া দীর্ঘস্থায়ী হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।

২. জ্বর না থাকা : মোহাম্মদ নিয়াতুজ্জামান বলেন, হাসপাতালে এমন সব ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে যারা এ মৌসুমে জ্বরে আক্রান্তই হয়নি। অর্থাৎ জ্বর না হলেও পরীক্ষার পর তারা ডেঙ্গু আক্রান্ত বলে জানা গেছে। এছাড়া গরমের কারণে অনেকে হয়ত দুয়েক দিন হালকা জ্বরে ভুগেছে কিন্তু তা পাত্তা দেয়নি। কিন্তু পরে সেটি মারাত্মক ডেঙ্গুতে পরিণত হয়েছে।

তিনি বলেন, তার হাসপাতালে এই মৌসুমের শুরুতে যেসব রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অবস্থায় ভর্তি হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্তত দু’জনের কোনো জ্বর ছিল না। তারা দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলে। পরে পরীক্ষা করে তাদের মধ্যে ডেঙ্গু ধরা পড়ে।

৩. স্থায়ী বমি : কয়েক দিন জ্বর হওয়ার পর বমি শুরু হয় এবং এক বার বমি শুরু হলে তা আর কমে না।

৪. প্রচণ্ড মস্তিষ্কে প্রদাহ : এই লক্ষণ অনেকটা মেনিনজাইটিসের সমস্যার মতোই। এতে প্রচণ্ড মাথা ব্যথা দেখা দেয়। চিকিৎসক নিয়াতুজ্জামান বলেন, অল্প জ্বরের পর কারো যদি প্রচণ্ড মাথাব্যথা থাকে, ঘাড় শক্ত হয়ে যায়, হাত-পা শক্ত হয়ে যায় কিংবা প্রচণ্ড খিঁচুনি দেখা দেয় তাহলে দেরি না করে ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো উচিত।

যেকোনো ধরনের মাথার প্রদাহ হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি।

৫. হাত-পা ফুলে যাওয়া।

৬. শরীরের বিভিন্ন জায়গায়- বিশেষ করে বুকে ও পেটে যদি পানি জমে যায় তাহলে দেরি না করে হাসপাতাল কিংবা চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এই লক্ষণটি এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে।

৭. অসহ্য রকমের পেট ব্যথা।

নিয়াতুজ্জামান বলেন, ডেঙ্গুর এসব পরিবর্তিত উপসর্গ একটি একটি করেও আসতে পারে। আবার বেশ কয়েকটি উপসর্গ এক সাথেও দেখা দিতে পারে। এটা নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর বা ডেঙ্গু কোন পর্যায়ে রয়েছে তার ওপর।

যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গুর মোট তিনটি পর্যায় আছে। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে ফেব্রিল ফেইজ বা জ্বর পর্যায়, দ্বিতীয়টি হচ্ছে ক্রিটিক্যাল ফেইজ বা গুরুতর পর্যায় এবং তৃতীয়টি হচ্ছে কনভালেসেন্ট ফেইজ বা নিরাময় পর্যায়।

মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ নিয়াতুজ্জামান বলেন, যত খারাপ রোগী আসে তাদের বেশিরভাগই ক্রিটিক্যাল ফেইজ বা গুরুতর পর্যায়ে চলে যাওয়ার পর হাসপাতালে ভর্তি হতে আসে।

এ পর্যায়ের অবস্থার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, কারো জ্বর এসে তা কমে যাওয়ার পর বমি শুরু হয়। কিন্তু এই বমি কমে না। অনেকের রক্তচাপ খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু রোগীরা বুঝতেও পারে না যে তার রক্তচাপ এতটা কমে গেছে।

এ পর্যায়ে যদি একটি বা দুটি উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া যায় তাহলে তার আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা বেশি থাকে। কিন্তু যখন অনেকগুলো উপসর্গ এক সাথে থাকে তখন তাকে চিকিৎসার ভাষায় বলা হয়, মাল্টি-অরগান ডিসফাংশন সিনড্রোম। অর্থাৎ তার দেহের একাধিক অঙ্গ তখন আক্রান্ত হয় এবং তাদের কাজ বাধাগ্রস্ত হয়।

তিনি বলেন, ‘একাধিক অঙ্গ কাজ করছে না এ ধরনের রোগী আমরা প্রচুর পাচ্ছি। ফলে এ ধরনের রোগীদের আমাদের আইসিইউ সাপোর্ট দিতে হচ্ছে।’

তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে চিকিৎসকদের কাছে যে নীতিমালা দেয়া হয়েছে সেখানে উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে যে প্রথমবারের তুলনায় দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্তদের উপসর্গ প্রথাগত উপসর্গের তুলনায় ভিন্ন হতে পারে।

ফলে এ ধরণের উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের ডেঙ্গু পরীক্ষার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।
সূত্র : বিবিসি