খাটের ওপরে, নীচে, ডানে-বামে সবদিকে ডেঙ্গু রোগী’

খাটের ওপরে, নীচে, ডানে-বামে সবদিকে ডেঙ্গু রোগী’

ফাইল ছবি

বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগ জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতির পর্যায়ে চলে গেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করলেও এখনো সেই সময় আসেনি বলে মনে করছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

তবে সরকারের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, জরুরি পরিস্থিতি জারির বিষয়টি তারা পর্যালোচনা করছেন।

গত দুই মাস ধরেই বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। এর মধ্যেই মৃত্যুর সংখ্যা এর মধ্যেই শতাধিক ছাড়িয়ে গেছে। দেশের ৬৩টি জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে।

স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ১৬২৩ জন আর মৃত্যু হয়েছে সাতজনের। এদের বেশিরভাগ আক্রান্ত হয়েছে ঢাকা শহর এলাকায়।

এই বছর বাংলাদেশে মোট আক্রান্ত হয়েছে ১৯ হাজার ৪৫৪ জন আর মৃত্যু হয়েছে ১০০ জনের।

এমন প্রেক্ষাপটে রোববার ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

‘জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা করে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয়া দরকার’
রোববার ঢাকার মুগদা মেডিক্যালে কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক একটি সেমিনার হয়।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন ওই সেমিনারে বলেছেন, ‘ডেঙ্গুর চারটি ধরনেই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এখন দেশে ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য জরুরি পরিস্থিতি চলছে, যা জাতীয় উদ্বেগের কারণ হয়েছে উঠেছে।’

তিনি বলেন, এক সময় ডেঙ্গু রোগটি মৌসুমি রোগ বলে মনে করা হলেও গত দুই বছর ধরে সেখানে ভিন্ন পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে গত বছর এবং এই বছরের মধ্যে ডেঙ্গুর বিস্তারে আসলে কোনো বিরতি ছিল না। বিশেষ করে শহর এলাকায় এই অবস্থার সবচেয়ে বেশি খারাপ হয়েছে।

তিনি মনে করেন, এখনি এটিকে জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা করে কোভিড মোকাবিলার মতো করে ডেঙ্গু মোকাবিলায় সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্বামী আজিম মিয়াকে নিয়ে ভর্তি রয়েছেন মনোয়ারা বেগম। তিনি বলছেন, ‘খাটের ওপরে, নীচে, ডাইনে-বামে সবদিকে ডেঙ্গু রোগী। তিন দিন হইলো স্বামীরে এখানে ভর্তি করছি। ডাক্তার স্যালাইন আর ওষুধ দিছে, জ্বর একটু কমছে।’

এখনো জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণার সময় আসেনি : স্বাস্থ্য বিভাগ
তবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগ মনে করছে, ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটলেও এখনো দেশে জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা করার মতো সময় আসেনি। তবে সেই বিষয়েও পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

রোববার ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে একটি ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলন করেছে বাংলাদেশর স্বাস্থ্য বিভাগ।

সেখানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি ঘোষণার সময় এখনো আসেনি। যখন করোনা ছিল, তখন এটা করা হয়েছিল। এ ধরণের কিছু করতে হলে পলিসি লেভেলে আলোচনা করতে হবে। আমরা আমাদের উদ্বেগের বিষয়টি তাদের জানিয়েছিল। প্রয়োজনে আবারো তাদের জানাব।’

বাংলাদেশে ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর ‘পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি’ ঘোষণা করেছিল সরকার। সেই ঘোষণার আলোকে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল।

পরে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘পাবলিক হেলথ পরিস্থিতি ঘোষণার মতো অবস্থা এখনো তো হয়নি। তবে ডেঙ্গুর এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে ইমার্জেন্সি জারির মতো কিনা, আমরা সেটা পর্যালোচনা করছি।’

মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ’আমরা দেখছি আশঙ্কাজনকভাবে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। আমরা চিকিৎসা দিচ্ছি। তবে রোগী সংখ্যা আরো বাড়তে থাকলে নিশ্চয়ই আমরা সঙ্কটে পড়ে যাব। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাদের কোনো সঙ্কট নেই। আমার সবাই মিলে আশা করি ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে পারব।’

হাসপাতালগুলোর কাহিল অবস্থা
শুধুমাত্র ঢাকা মহানগরীতেই সরকারি এবং বেসরকারি মিলিয়ে এখন ৫৩টি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে। সবচেয়ে বেশি রোগী রয়েছে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।

এছাড়া ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, এসএসএসএমসি ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতাল, বেসরকারি হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে অনেক রোগী ভর্তি রয়েছে। বড় হাসপাতালগুলোয় জায়গা না হওয়ায় অনেক রোগী মেঝেতে থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।

এরকম একটি হাসপাতালের চিকিৎসক তৌফিক আহমেদ বলেন, ‘প্রতি দিনই জ্বর নিয়ে রোগী আসছে। আমরা তো আর কাউকে ফিরিয়ে দিচ্ছি না। অবস্থা ভালো মনে হলে ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু বেশিরভাগ রোগী আসছে কিছুটা খারাপ অবস্থায়।’

তিনি জানান, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু রোগীদের ক্ষেত্রে খুব অল্প সময়েই অবস্থার অবনতি হতে দেখা যাচ্ছে।

সম্প্রতি বৃষ্টি হওয়ায় বৃষ্টির পানি জমে জমে ডেঙ্গুর সংক্রমণ আরো বেড়ে যেতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করেন।

গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৬২ হাজার ৩৮২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। মৃত্যু হয়েছিল রেকর্ড ২৮১ জনের। সেই বছরেও জুলাই, অগাস্ট মাসে ডেঙ্গুর সংক্রমণ অনেক বেড়ে গিয়েছিল।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশে যতো ডেঙ্গু রোগী আক্রান্ত বা মৃত্যু হচ্ছে, তার প্রকৃত চিত্র এই পরিসংখ্যানে আসছে না। কারণ অনেকেই যেমন ঘরে বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের তথ্য এখানে যুক্ত হচ্ছে না। আবার দেশের সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রোগীর তথ্য এখানে নিয়মিত আসছে না। বিশেষ করে ঢাকার বাইরের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ডেঙ্গু রোগীদের তথ্য আসে না স্বাস্থ্য বিভাগে।

ডেঙ্গু হলে কখন হাসপাতালে যেতে হবে
চিকিৎসকরা বলছেন, বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় দেহে জ্বর দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। এরপর পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্ত হলে রোগীর অবস্থা বুঝে চিকিৎসক ওষুধ বা হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেবেন।

ডা. তৌফিক আহমেদ বলছেন, সব ধরনের ডেঙ্গুতেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় না। সাধারণ জ্বরের সাথে অন্য কোনো উপসর্গ না থাকলে বাড়িতে বিশ্রামে থেকে আর ওষুধ খেয়েই সুস্থ হওয়া যাবে। সেক্ষেত্রে নিজে নিজে ওষুধ না খেয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খেতে হবে। তবে প্রচুর তরল খাবার, ডাবের পানি, লেবুর শরবত ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে।’

ডেঙ্গুর প্রধান লক্ষণ জ্বর। সাধারণত ৯৯ থেকে ১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত তাপমাত্রা উঠতে পারে। জ্বরের সঙ্গে শরীরে ব্যথা, মাথা ব্যথা, চামড়ায় র‍্যাশ বা ফুসকুড়ি ওঠা, চোখে ব্যথা দেখা দিতে পারে।

ড. আহমেদ বলছেন, ‘রোগীর ডায়াবেটিস থাকলে, ডেঙ্গুর সাথে সাথে যদি পেটে ব্যথা বা বমি হয়, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি বা লিভারের সমস্যা, অন্তঃসত্ত্বা ইত্যাদি থাকলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়া ভালো। বিশেষ করে বমি বা খিচুনি হলে, নাক, মলদ্বার, মাড়ি বা প্রস্রাবের সাথে রক্তপাত হলে কোনরকম দেরি না করে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।’

তিনি বলছেন, ডেঙ্গু জ্বর কমে গেলেও অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। তাহলে পরবর্তীতে অনেক জটিলতার এড়ানো যেতে পারে।

অনেক সময় রোগীর রক্তে প্লেটলেট কাউন্ট কমে গেলে বা রক্তপাত বেশি হলে রক্ত দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে রোগীর রক্তের গ্রুপের সম্ভাব্য রক্তদাতার খোঁজ বা যোগাযোগ করে রাখা যেতে পারে।

সূত্র : বিবিসি