আলঝেইমার্স রোগের চিকিৎসায় মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে নতুন যে ওষুধ

আলঝেইমার্স রোগের চিকিৎসায় মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে নতুন যে ওষুধ

আলঝেইমার্স রোগের চিকিৎসায় মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে নতুন যে ওষুধ

আলঝেইমার্স রোগের চিকিৎসায় সাফল্যের নতুন মোড় আনার কারণে সমাদৃত হচ্ছে ডোনানেমাব নামে নতুন এক ধরণের ওষুধ। সারা বিশ্বে পরীক্ষা চালানোর দেখা গেছে যে, এই ওষুধ চিন্তা করার শক্তি লাঘবের প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেয়।অ্যান্টিবডি মেডিসিন বা দেহে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা এই ওষুধটি ডিমেনশিয়ার এই ধরনটিতে আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিষ্কে তৈরি হওয়া এক ধরনের প্রোটিনকে সরিয়ে দেয়। ফলে এটি প্রাথমিকভাবে আক্রান্ত রোগীর অবস্থার উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করে।

যদিও এটা কোন প্রতিষেধক নয়, তবে দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে যে, জামা নামে চিকিৎসা জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণার ফল আলঝেইমার্স চিকিৎসায় নতুন যুগের সূত্রপাতকে নির্দেশ করছে।যুক্তরাজ্যের ওষুধ বিষয়ক ওয়াচডগ সংস্থা এটি মূল্যায়ন করে দেখছে যে, এটিকে জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ বা এনএইচএস এ ব্যবহার করা যায় কিনা।এই ওষুধটি শুধু আলঝেইমার্স রোগের ক্ষেত্রেই কাজ করে, ডিমেনশিয়ার অন্য কোন ধরণ যেমন ভাস্কুলার ডিমেনশিয়ায় এটি কার্যকর নয়।

পরীক্ষায় এই ওষুধটি রোগের গতি এক তৃতীয়াংশ ধীর করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এতে করে আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাদের দৈনন্দিন নানা কাজ, যেমন খাবার তৈরি করা বা কোন শখ উপভোগ করার মতো সুযোগ বেশি পাচ্ছে।বৈশ্বিক এই পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন যুক্তরাজ্যের এমন কয়েক ডজন মানুষের মধ্যে মাইক কলি একজন, তার বয়স ৮০ বছর। তিনি এবং তার পরিবার বিশেষভাবে বিবিসির সাথে কথা বলেছেন।

লন্ডনের একটি ক্লিনিকে প্রতিমাসে একবার এই ওষুধ ধীরে ধীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে গ্রহণ করে থাকেন। তিনি দাবি করেন, “আপনার এ পর্যন্ত যত ভাগ্যবান মানুষের সাথে দেখা হয়েছে তার মধ্যে তিনি একজন।”এই পরীক্ষা শুরু করার কিছু দিন আগে মাইক এবং তার পরিবারের সদস্যরা খেয়াল করেন যে, তিনি তার স্মৃতি মনে করা এবং সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে সমস্যার মুখে পড়ছেন।

তার ছেলে মার্ক বলেন যে, শুরুতে এই বিষয়টা দেখা খুবই কষ্টকর ছিল।“তথ্য প্রক্রিয়া করতে এবং সমস্যার সমাধান করার ক্ষেত্রে সে যে ধরণের সমস্যার মুখে পড়ছিল তা দেখাটা খুব কষ্টকর ছিল। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এখন তার সমস্যাটা এমন একটা পর্যায়ে এসেছে যে, এটি আর খারাপ হচ্ছে না।”কেন্টের বাসিন্দা মাইক বলেন, “আমি প্রতিদিনই আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী অনুভব করি।”

ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি এলি লিলির তৈরি করা ডোনানেমাব ওষুধটি লিকানেমাব নামে আরেকটি ওষুধের মতোই কাজ করে। লিকানেমাব ওষুধটি তৈরি করেছিল এইসাই এন্ড বায়োজেন নামে ওষুধ কোম্পানি। তাদের ওষুধটি এই রোগের চিকিৎসায় কার্যকর প্রমাণিত হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে এটি সংবাদের শিরোনামে উঠে এসেছিল।অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক হলেও এই ওষুধগুলো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত নয়।

ডোনানেমাবের পরীক্ষায় এক তৃতীয়াংশ রোগীর মস্তিষ্কে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি দেখা দিয়েছিল। বেশিরভাগের ক্ষেত্রে অবশ্য কোন ধরণের উপসর্গ প্রকাশিত হওয়ার আগেই এটি প্রতিকার করা সম্ভব হয়েছিল।

তবে দুইজন স্বেচ্ছাসেবী এবং সম্ভবত আরো একজনের মস্তিষ্ক মারাত্মক ফুলে উঠার কারণে পরীক্ষা চলাকালীন মারা গেছেন। আরেকটি অ্যান্টবডি ড্রাগ যার নাম ছিল আদুকানুমাব, সুরক্ষা ইস্যুতে সেটি সম্প্রতি ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রকরা বাতিল করে দিয়েছেন। এছাড়া ওই ওষুধটি যে রোগীদের উপর কাজ করছিল তারও কোন প্রমাণ ছিল না।

ডিমেনশিয়া কী এবং এটি হলে কী করবেন?

ডোনানেমাব ওষুধের পরীক্ষার সময় গবেষকরা ৬০ থেকে ৮৫ বছর বয়সী ১৭৩৬ জন মানুষের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, যারা আলঝেইমার্সের প্রাথমিক স্তরে ছিল।এদের অর্ধেককে মাসে একবার করে ধীরে ধীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে এই ওষুধ দেয়া হয়েছে। আর বাকি অর্ধেক মানুষকে ওষুধের মতো একটি তরল দেয়া হয়েছে যা প্ল্যাসেবু নামেও পরিচিত। অর্থাৎ এমন একটি ওষুধ যাতে আসলে কোন সক্রিয় ওষুধি উপাদান নেই যেমন চিনির বড়ি ইত্যাদি। পুরো প্রক্রিয়া চলেছে ১৮ মাস ধরে।

এর থেকে যা পাওয়া গেছে তা হলো:

এই ওষুধটির কিছু সুবিধা রয়েছে, অন্তত কিছু রোগীর ক্ষেত্রে এটি কাজ করেছে। যারা এই রোগটির প্রাথমিক পর্যায়ে ছিলেন এবং যাদের মস্তিষ্কে অ্যামিলইড নামে এক ধরণের প্রোটিনের পরিমাণ কম ছিল তাদের উপর এই ওষুধ বেশি কার্যকর ছিল। মস্তিষ্ক স্ক্যান করে সেটি পরিষ্কার দেখা গেছে।যাদেরকে এই ওষুধ দেয়া হয়েছিল তারা তাদের দৈনন্দিন নানা কাজ চালিয়ে যেতে পেরেছেন। যেমন সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা, ফোনকলের উত্তর দেয়া বা কোন শখ পূরণ করা।

আক্রান্ত ব্যক্তি তার দৈনন্দিন কাজ কতটা চালিয়ে যেতে পারেন তার মাধ্যমে রোগের গতি নির্ণয় করা হয়। সেই গতি এই ওষুধ নেয়ার ফলে সার্বিকভাবে ২০-৩০ শতাংশ ধীর হয়েছে বলে গবেষকরা জানাচ্ছেন। একই সাথে যেসব রোগী এই ওষুধের প্রতি ভাল প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন তাদের মধ্যে রোগের গতি ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত ধীর হয়েছে বলে ধরা হচ্ছে

ডোনানেমাব গ্রহণকারী রোগীদের অর্ধেকই এক বছর পর চিকিৎসা নেয়া ছেড়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। কারণ ওই ওষুধ তাদের মস্তিষ্ককে পর্যাপ্ত পরিমাণে পরিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে।আলঝেইমার্স মতো জটিল রোগের ক্ষেত্রে অ্যামিলইড একটি মাত্র অংশ। তাই দীর্ঘ সময়ে এই চিকিৎসা আরো বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখবে কিনা তা নিয়ে সতর্ক রয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, এই ওষুধেদর প্রভাব হয়তো মোটামুটি, কিন্তু এর মাধ্যমে যে ফলাফল পাওয়া যায় তাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে মস্তিষ্ক থেকে অ্যামিলইড সরিয়ে ফেলা সম্ভব হলে তা আলঝেইমার্সের গতি পাল্টে দিতে পারে এবং এর মাধ্যমে এতে আক্রান্ত রোগীরা ঠিক সময়ে চিকিৎসা পেলে পুরোপুরি সেরেও উঠতে পারে।

যুক্তরাজ্যের ডিমেনশিয়া গবেষণা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক গিলস হারডিংহাম বলেন: “আজ এই ফল পুরোপুরিভাবে প্রকাশিত হয়েছে দেখে দুর্দান্ত লাগছে।”“আইলঝেইমার্সের চিকিৎসার জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করেছি, তাই এই খাতে বাস্তব অগ্রগতি ঘটতে দেখাটা আসলেই অনেক উৎসাহব্যঞ্জক।”যুক্তরাজ্যের আলঝেইমার্স রিসার্চ এর গবেষক ডা. সুসান কোলহাস বলেন: “আজকের ঘোষণা আরেকটি মাইলফলক স্পর্শ করলো।”

“দশকের পর দশক ধরে চলা গবেষণাকে ধন্যবাদ, ডিমেনশিয়া নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানুষ ও সমাজের উপর এর প্রভাব অবশেষে পরিবর্তিত হচ্ছে এবং আমরা একটি নতুন যুগে প্রবেশ করছি যেখানে আলঝেইমার্স রোগ নিরাময়যোগ্য হতে পারে।”

বিবিসির রেডিও ফোর এর এক অনুষ্ঠানে কথা বলার সময় ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেন, এনিয়ে আরো গবেষণায় বিনিয়োগ করা উচিত। এই ওষুধকে তিনি ‘স্ট্যাটিন অব ব্রেইন’ বা মস্তিষ্কের ধমনী পরিষ্কারক বলে উল্লেখ করেছেন।তিনি বলেন, “আমরা এমন একটি বড়ি চাই যা মস্তিষ্ক এমন ধরণের প্রোটিন গঠিত হয় এমন মানুষ প্রতিদিন বা সপ্তাহে এক দিন নিতে পারে যাতে করে এই প্রোটিন তাদের মস্তিষ্ক থেকে দূর করা যায় এবং এর মাধ্যমে ডিমেনশিয়ায় পরিণত হয় এমন রোগেরও ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব হয়।”

নতুন ধরণের চিকিৎসা চালু করার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী সরকার বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে মি. ক্যামেরন বলেন, এটার জন্য সত্যিকারেই একটি প্রণোদনা ছিল।“আমরা ছয় কোটি মানুষের দেশ, যার মধ্যে ১০ লাখ মানুষ ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত, যাদের মধ্যে অনেককেই অনেক ব্যয়বহুল চিকিৎসাসেবার আওতায় রাখা হয়েছে। কাজেই মানুষকে কার্যকর চিকিৎসা দেয়ার জন্য প্রচুর সঞ্চয় করতে হবে....আমি আশাবাদী যে আমাদের সিস্টেম হয়তো এটা সরবরাহ করতে পারবে।”যুক্তরাষ্ট্রে লাইসেন্স পাওয়া লাকানেমাব ওষুধের দাম প্রায় ২৭৫০০ মার্কিন ডলার।তবে ডোনানেমাব এর দাম কেমন হবে এবং যুক্তরাজ্যে এটি অনুমোদন পেতে আরো কতদিন লাগবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। কিন্তু আলঝেইমার্স বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুটি ওষুধ থাকলে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়ে দামের উপর প্রভাব ফেলবে।

যুক্তরাজ্যের ওষুধের ওয়াচডগ প্রতিষ্ঠান এনআইসিই বলেছে, আলঝেইমার্স রোগের কারণে সৃষ্ট মৃদু ডিমেনশিয়া এবং যৌক্তিক আচরণের সমস্যা বিষয়ক চিকিৎসায় ডোনানেমাবকে অনুমোদন দেয়া নিয়ে এরইমধ্যে কাজ শুরু করেছে তারা।“আমাদের লক্ষ্য হল যুক্তরাজ্যে এটির লাইসেন্স পাওয়ার সাথে সাথে যাতে এটি এনএইচএস-এ এর ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় তার জন্য সুপারিশ করা,” বলেন একজন মুখপাত্র।

এপ্রিলে মাইক কলির বয়স ৮০ হয়েছে। তার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তিনি ৪০ জন অতিথির সামনে ‘মাই ওয়ে’ গানটি গেয়ে পরিবারের সবাইকে অবাক করে দিয়েছেন।তিনি বিবিসি নিউজকে বলেন: “আমার এখন এরকমই আত্মবিশ্বাস আছে। আমি ১২ মাস আগেও এটা করতে পারতাম না।”তার ছেলে মার্ক বলেন: “আামি কখনো ভাবিনি যে আমার বাবাকে আবার এতোটা প্রাণবন্ত দেখবো। এটি অসাধারণ একটা মুহূর্ত।”

যুক্তরাজ্যের নিউরোরেডিওলজিস্ট কনসালটেন্ট এবং রি:কগনিশন হেলথ এর মেডিক্যাল ডিরেক্টর ডা এমির ম্যাসসুইনি ডোনানেমাব ওষুধের পরীক্ষার নেতৃত্ত্ব দিয়েছেন।তিনি বলেন: “এটা আসলেই গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে বড় অগ্রগতি গুলোর মধ্যে একটা।”আলঝেইমার্স সোসাইটি বলেছে: “আলঝেইমার্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এটি আসলেই একটি নতুন মোড় এবং বিজ্ঞান প্রমাণ করছে যে এই রোগের গতি ধীর করে দেয়া সম্ভব।”

আলঝেইমার্সের চিকিৎসায় নতুন উদ্ভাবিত এই ওষুধ ব্যবহারের অনুমতি পেলে যুক্তরাজ্যের প্রায় সাত লাখ ২০ হাজার মানুষ উপকার পেতে পারে। কিন্তু আলঝেইমার্স সোসাইটি বলছে যে, এনএইচএস “খুব সাধারণভাবে এটা সরবরাহ করতে প্রস্তুত নয়।”দাতব্য প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কেইট লি বলেন: “সময় মতো সঠিক চিকিৎসাই চাবিকাঠি, এবং বর্তমানে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের মাত্র দুই শতাংশ মানুষ এই চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষ অনুসন্ধানের মাধ্যমে তাদের চিকিৎসা পাচ্ছেন।”“এর পাশাপাশি, আলঝেইমার্সের এই নতুন উদীয়মান ওষুধগুলো নিয়মিত ইনজেকশনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে গ্রহণ এবং পর্যবেক্ষণে থাকার দরকার হয়, আর এনএইচএস এখনই এতো বিশালাকারে এই সেবা দিতে প্রস্তুত নয়।”

সূত্র : বিবিসি