বর্ষায় মেঘের দেখা নেই, পুড়ছে ফসলের মাঠ, বৃষ্টি হবে কবে?

বর্ষায় মেঘের দেখা নেই, পুড়ছে ফসলের মাঠ, বৃষ্টি হবে কবে?

সংগৃহীত

রাজবাড়ী জেলার কৃষক হারুন-উর রশীদ আমন ধানের জন্য বীজতলা করেছিলেন। ক্ষেতে বোনার জন্য উপযোগী হয়ে উঠেছে সেসব চারা। কিন্তু বৃষ্টি না হওয়ায় তিনি বীজ বুনতে পারছেন না।

‘প্রতি বছর এই সময় বৃষ্টি হয় বলে এখন সেচের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। আমরা ধরে নিছি, বৃষ্টি হবে, চারা লাগালে আর পানির সমস্যা হবে না। কিন্তু পানি না পেয়ে ক্ষেতের মাটি শুকনা হয়ে গেছে। চারাগুলোও বড় হয়ে যাচ্ছে। আর কয়েকদিন গেলে সেগুলো আর লাগাতেও পারব না,’ তিনি বলছিলেন।

বাড়ির পাশে একটি উঁচু জমিতে মেহগনির বাগান করবেন বলে একটি নার্সারিতে চারার জন্য বায়না বা অগ্রিম টাকাও জমা করে এসেছিলেন। কিন্তু বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত তিনি সেগুলোও লাগাতে পারছেন না। মানিকগঞ্জের দেলোয়ার হোসেনের মতো সমস্যায় পড়েছেন বাংলাদেশের অনেক কৃষক।

পুরো বর্ষা মৌসুমে হাতে গোনা কয়েকদিন মাত্র বৃষ্টি হওয়ার পর আর মেঘের দেখা নেই। বৃষ্টির অভাবে একদিকে আমনের মৌসুমে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন কৃষকরা, অন্যদিকে ক্ষেতে থাকা সবজির ফসলও কমে গেছে।

আগস্ট মাসের আগে আপাতত বৃষ্টির আর সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির বিবিসি বাংলাকে বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার বৃষ্টিপাত প্রায় ৫৭.০৬ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে। তবে এখন উড়িষ্যা আর অন্ধ্রপ্রদেশ উপকূলে একটা লঘুচাপের তৈরি হওয়ায় সব মেঘ সেখানে চলে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের আকাশ অনেকটা মেঘশূন্য অবস্থায় থাকছে।

‘তবে আমরা আশা করছি, এই মাসের ২৮/২৯ তারিখের দিকে এই অবস্থার পরিবর্তন হবে। তখন হয়ত দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে বৃষ্টি হবে,’ তিনি বলছেন।

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরেই বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টিপাতের একটা বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। অনেক সময় বর্ষার আগেই বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়, আবার বর্ষা বাদ দিয়ে পরে শরৎকালে বৃষ্টি হতে থাকে।

কিন্তু এর ফলে বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে ফসলের ওপর। কারণ চাষাবাদের চক্র বদলে যাচ্ছে।

বর্ষাকাল কি বদলে যাচ্ছে?
বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদরা বলছেন, গত দুই দশক ধরেই বাংলাদেশ অঞ্চলে বর্ষাকালে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। অনেক সময় বর্ষাকালের আগে বা পড়ে বেশি বৃষ্টি হচ্ছে, অথচ পুরো আষাঢ়-শ্রাবণ মাস হয়তো শুষ্ক থাকছে।

এজন্য বিশেষজ্ঞরা জলবায়ু পরিবর্তন, এল নিনো বা লা নিনার প্রভাবকে দায়ী করছেন। পেরু অঞ্চলের সমুদ্রের পানির উষ্ণতা বেড়ে গেলে এল নিনো আর কমে গেলে লা নিনা তৈরি হয়। এর প্রভাব প্রশান্ত বা ভারত মহাসাগরীয় সব দেশের ওপরেই পড়ে। বৃষ্টি কম বা বেশি হওয়া, প্রাণীর জৈববৈচিত্রের ওপরে তার প্রভাব পড়ে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের সাবেক পরিচালক ড. সমরেন্দ্র কর্মকার বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এটাকে আমরা সাধারণত বলে থাকি, ভেরিয়াবিলিটি অব মনসুন। এল নিনো বা লা নিনার প্রভাবে এটা হয়ে থাকে। এই বছর এল নিনো হচ্ছে। সেরকম হলে সাধারণত বৃষ্টিপাত কম হয়। কিন্তু যেখানে হবে, সেখানে অতি বৃষ্টি বা বন্যা হয়ে যায়। যেমন আমাদের এখানে বৃষ্টি কম হলেও গুজরাটে বা পাকিস্তানে অনেক বৃষ্টি হচ্ছে।‘

যে মৌসুমি বায়ুর কারণে বৃষ্টি হয়ে থাকে, সেটা অনেক সময় উত্তর বা দক্ষিণে অবস্থান নিয়ে থাকে। এটা যদি দক্ষিণ দিকে বেশি সময় থাকে, তাহলে বাংলাদেশ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হয়। আবার উত্তর অঞ্চলে থাকলে হিমালয়ের পাদদেশ এলাকায় বৃষ্টিপাত বেশি হয়, যার ফলে অনেক সময় নদীগুলো উপচে উজানে বন্যা দেখা দেয়।

‘বর্ষাকালের এই পরিবর্তন ২০০৩ সাল থেকেই পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। যে অ্যাক্সেসে মনসুন সিস্টেম থাকে, সেটা দক্ষিণ দিকে এক থেকে দুই ডিগ্রি সরে গেছে। এর ফলে আমাদের এলাকায় বর্ষাকালে বৃষ্টির হার কমে গেছে,’ তিনি বলেন।

ফসলের ওপর কী প্রভাব?
বহু বছর ধরে প্রাকৃতিক কৃষি পদ্ধতিতে চাষাবাদ নিয়ে কাজ করেন মানিকগঞ্জের দেলোয়ার হোসেন। প্রাকৃতিক কৃষি কেন্দ্রের এই সমন্বয়ক বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘আষাঢ়ে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়, এবার তার চেয়ে অনেক কম হয়েছে। আমাদের এখানে এখন তো আমন ধানের মৌসুম। অনেক জায়গায় কৃষকরা ধান লাগাতে পারছেন না পানির জন্য। কৃষকরা বুঝতে পারছে না, কোন ধরনের ধান লাগাবে। বৃষ্টি হলে বা পানি এলে এক ধরনের ধান, না হলে আরেক ধরনে ধান লাগাবেন। মানিকগঞ্জে, সিরাজগঞ্জে, কুষ্টিয়ায় খবর নিয়ে দেখেছি, সব জায়গায় একই অবস্থা।‘

তিনি বলছেন, বর্ষা মৌসুমে যে সব ফসল উৎপাদন হয়ে থাকে, সেসব ফসলের উৎপাদন অনেক কমে গেছে।

‘সব ধরনের সবজির উৎপাদন কমে গেছে। চিচিঙ্গা, কাঁচা মরিচ, চাল কুমড়া, ঝিঙ্গা, পুঁইশাক- বৃষ্টি না হওয়ায় লতা জাতীয় সব সবজির উৎপাদন কমে গেছে। এই সময়ে কাঁচা পেঁপের দাম খুব কম থাকে, এবার স্থানীয় বাজারেও কাঁচা পেঁপের দাম বেড়ে গেছে কম উৎপাদন হওয়ার কারণে। অনেকের ক্ষেতে গাছ আছে, কিন্তু ফল ধরছে না। ফসল হচ্ছে না শুধুমাত্র যথেষ্ট বৃষ্টি না হওয়ার কারণে,’ বলছেন দেলোয়ার হোসেন বলছেন।

ঠিক সময়ে ধানের চারা রোপণ করতে না পারলে উৎপাদন যেমন ক্ষতি হবে, তেমনি পরবর্তী অন্য ফসলের চাষাবাদের ওপরেও তার প্রভাব পড়বে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোঃ পারভেজ আনোয়ার বিবিসি বাংলাকে বলেন, বৃষ্টি বা অতি বৃষ্টির প্রভাবে কৃষকরা ঠিক সময়ে ধান বা ফসল লাগাতে না পারলে পরবর্তী ফসল লাগানোও পিছিয়ে যায়। ফলে দেখা যাবে, তারা হয়ত একটি ফসল আর লাগাতেই পারবেন না।

পারভেজ আনোয়ার বলছেন, লম্বা সময় বৃষ্টি না হলে বর্ষাকালীন সব ধরনের ফসলের ওপরেই প্রভাব পড়ছে। কিন্তু এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে শীতকালীন ফসলেরও ওপরেও।

‘ফসল লাগানোর একটা প্যাটার্ন আছে, কোনটার পরে কোনটা লাগানো হবে। এখন দেখা যাচ্ছে, বৃষ্টির প্যাটার্ন পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় সময় মতো ফসল লাগানো যাচ্ছে না। আমন ধান লাগানো পিছিয়ে যাওয়ায় ফসল ঠিক মতো হবে না। চারার বয়স বেশি হয়ে গেলেও ফলন কমবে। আবার দেরিতে লাগানো হলে সেই ফসল উঠবেও দেরি করে। ফলে তারা হয়ত আমন তুলে সরিষা লাগাত, এখন আর সেটা পারবে না। তাদের একটা ফসল স্যাক্রিফাইস করতে হবে,’ তিনি বলছেন।

কৃষিবিদরা বলছেন, আগে আগস্ট সেপ্টেম্বরের পরে বৃষ্টি হতো না। কিন্তু এখন জুন মাসে বৃষ্টি না হয়ে এখন সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে শীতকালীন যে ফসলটা অক্টোবরে লাগানো হতো, মাটি কাদা বা আর্দ্রতা বেশি থাকার কারণে সেটা লাগানো যায় না।

‘নভেম্বরের আগে গম লাগানো, সরিষা বা শীতকালীন যে সবজি লাগানো হতো, সেটার চাষাবাদ পিছিয়ে যাচ্ছে। ফলে এটার যতটা শীত পাওয়ার দরকার সেটা পাচ্ছে না। কারণ লাগাতে দেরি হওয়ায় ফসল আসার আগেই গরম পড়ে যাচ্ছে। ফলে শীতকালীন ফসল শীত না পাওয়ায় ফলন প্রচুর কমে যাচ্ছে,’ বলছেন অধ্যাপক পারভেজ আনোয়ার।

আম, জাম, মেহগনি বা অন্যান্য বড় আকারের গাছ সারা বছর ধরে লাগানো গেলেও কৃষকরা এসব গাছ লাগানোর জন্য বর্ষাকালকেই সাধারণত বেছে নেন। কারণ এই সময় বৃষ্টি হওয়ায় গাছ গুলো দ্রুত বেড়ে ওঠে, তাদের কম পানি দিতে হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, বর্ষাকালে ১০০ গাছ লাগালে যতগুলো গাছ টিকে থাকে, অন্য সময়ে লাগালে সেই হার অর্ধেকে নেমে আসে।

কৃষি সমন্বয়ক দেলোয়ার হোসেন বলছেন, কিছু কিছু চারা আছে, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে লাগানো হয়। বর্ষাকালেই সবচেয়ে বেশি কলম করা হয়। কিন্তু বৃষ্টি না হলে কলম বেশি ভালো হবে না, কৃষকরাও সহজে এগুলো লাগাতে চাইবেন না। শুধু গাছ নয়, পুকুরের মাছের উৎপাদনও কমে গেছে। এমনকি গরুর রোগবালাইয়ের পরিমাণও অনেক বেড়ে গেছে গ্রামের দিকে।

তিনি বলছেন, মানিকগঞ্জ বা সিরাজগঞ্জের মতো অনেক নিচু এলাকায় এই সময়ে পানি চলে আসে। কৃষকরা সেই অনুযায়ী পাট বা ধান রোপণ করেন। কিন্তু এবার বৃষ্টি না হওয়ায় সেভাবে পানি আসেনি। ফলে কৃষকরাও সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না, তারা কি বেশি পানির ফসল লাগাবেন নাকি কম পানির গাছ।

যথেষ্ট বৃষ্টি না হলে ফরিদপুর-রাজবাড়ীর পাটের চাষাবাদের ওপরেও প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন হারুন-উর রশীদের মতো অনেক কৃষক।

তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে দুই ধরনের পাট চাষ হয়। এক ধরনের পাট গাছ পানির ভেতরে থাকে, কিন্তু আরেক জাত আছে, পানিতে হয় না। এবার বৃষ্টি না হওয়ায় নিঁচু জায়গায় পানি তেমন নাই। বৃষ্টি না হলে পানি হবে না, আবার কিছুদিন পরে যদি বেশি বৃষ্টি হয়, তখন ওই এলাকা ডুবে যাবে। এখন কোন জাতের পাট গাছ লাগানো ভালো হবে, কেউ বুঝতে পারছে না।’

সূত্র : বিবিসি