কোরিয়ার যুদ্ধে যেভাবে জড়িয়েছিল আমেরিকা, চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন

কোরিয়ার যুদ্ধে যেভাবে জড়িয়েছিল আমেরিকা, চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন

চীনের সেনারা কোরিয়ার যুদ্ধে প্রবেশের চিত্র

সময়টা ১৯৫০ সাল। দিনটি ছিল রবিবার। ড. ইউন গু লী চার্চে থাকা অবস্থায় খবর পান উত্তর কোরিয়ার সেনারা দক্ষিণে ঢুকে পড়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই উত্তরের সেনারা তাদের শহরে ঢুকে পড়ে।

১৯৫০ সালের ২৫শে জুন দুই কোরিয়ার যুদ্ধ শুরুর পর সেটি তিন বছর চলেছে। ১৯৫৩ সালের ২৭শে জুলাই সে যুদ্ধ থামে।২৫শে জুন দিনটিতে উত্তর কোরিয়ার সেনারা সীমান্ত ভেদ করে ঢুকে পড়ে দক্ষিণ কোরিয়ায়। এক সপ্তাহের মধ্যে রাজধানী সোলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় তারা। কয়েক দিনের মধ্যেই উত্তর কোরিয়ার সেনারা দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যবর্তী একটি শহর ওয়োনজুতে পৌঁছে যায়, যেখানে তরুণ ইউন গু লী তার পরিবারের সাথে থাকতেন।

তিনি মনে করছিলেন, একজন কমিউনিস্ট সেনার সাথে প্রথম মুখোমুখি হওয়ার কথা। ২০১০ সালে বিবিসির 'উইটনেস' বা 'ইতিহাসের সাক্ষী' অনুষ্ঠানে মি. তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।

“এটা ছিল অনেকটা বাঘের মত বন্য কোনো পশুর মুখোমুখি হওয়া, আমি ভয়ে কাঁপছিলাম। তারা যথেষ্ট বন্ধুসুলভই ছিল, কিন্তু আমি আমার নিজের উদ্বেগ আর ভয় কাটাতে পারছিলাম না,” যুদ্ধের শুরুটা এভাবেই বর্ণনা করছিলেন ড. লী।এই ঘটনার পাঁচ বছর আগে ভাগ হয়েছিল কোরিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান কোরিয়ার নিয়ন্ত্রণ হারায়। যে দুই ভাগে কোরিয়া বিভক্ত হয়েছিল তার উত্তর অংশ ছিল সোভিয়েত সমর্থিত কমিউনিস্ট অঞ্চল, আর দক্ষিণ অংশ ছিল আমেরিকা সমর্থিত অঞ্চল।

কিন্তু এই সময়টায় কমিউনিস্ট সেনারা একের পর এক দখল নিতে থাকে দক্ষিণের অঞ্চল। অল্প সময়ের মধ্যেই একদম দক্ষিণ দিকে সাগর পাড়ের একটি ছোট্ট শহর পুসান ছাড়া প্রায় সবটাই কমিউনিস্টদের দখলে চলে যায়।শরণার্থীর ঢল নামে দক্ষিণে যাওয়ার জন্য। ইউন গু লী সিদ্ধান্ত নেন উত্তর কোরিয়ানদের থেকে পালাতে তিনিও ওয়োনজু ছেড়ে শরনার্থীদের সাথে যোগ দিবেন।দক্ষিণে পুসানের কাছাকাছি সাচান বন্দর পর্যন্ত দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দেন তিনি। কয়েক সপ্তাহ সময় লাগে পৌঁছাতে।

“আমরা প্রয়োজনীয় অল্প কিছু জিনিসপত্র সাথে নিয়েছিলাম, আর মহাসড়কগুলো শরনার্থীদের ভীড়ে গিজগিজ করছিলো,” বলছিলেন মিঃ লী। মূলত তরুনরাই পালাচ্ছিলো, কারণ উত্তর বা দক্ষিণ যে কোনো সেনারাই তাদের দলে টানতে চাইতে পারে।শরনার্থীরা পুসানে পৌঁছানোর পর অবস্থা তুলনামূলক ভালো হলেও সেখানে ছিল লাখো মানুষের ভিড়। অথচ জায়গাটা ছিল পুরো কোরিয়ার ১০ শতাংশের কম।

“যথেষ্ট খাবার ছিল না, কোথাও যাওয়ার সুযোগ ছিল না, আমরা স্কুলভবনে থাকতাম” বলছিলেন মিঃ লী।১৯৫০ সালের শরতে এসে পরিবর্তন ঘটে পরিস্থিতির। কারণ দক্ষিণ কোরিয়া ও জাতিসংঘের সম্মিলিত বাহিনী পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। এই দলে মূলত যোগ দিয়েছিল আমেরিকার সেনারা। কমিউনিস্টদের দখলের ভয়ে যুক্তরাষ্ট্র সেনা পাঠিয়েছিল। উত্তর কোরিয়ানদের উত্তর দিকে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয় তারা। যদিও সময়টা ছিল রক্তক্ষয়ী। বাড়ি ফিরতে পারলেও সে অভিজ্ঞতা ছাপ ফেলেছিল মিঃ লীর মনে।

 “বহু মানুষ মানুষ মারা গিয়েছিল। আমার চোখে তারা সবাই ভালো মানুষ, কিন্তু উত্তর কোরিয়ানদের চোখে হয়তো তারা সমাজবাদ-বিরোধী। আবার আমার নিজের শহর ওয়ানজুতে যখন দক্ষিণ কোরিয়ান সেনারা পৌঁছায়, তখন যারা সেই কয়েকমাসে উত্তর কোরিয়ানদের কোনো না কোনোভাবে সহযোগিতা করেছিল তাদেরকে মেরে ফেলে।

"আমি নদীতে বহু লাশ ভাসতে দেখেছি। এমন কোনো পরিবার ছিল না যেখানে একজনও পরিবারের কোনো সদস্য হারায়নি,” বলছিলেন মিঃ লী। বাড়ী ফিরে মিঃ লী মা ও নানীর মৃত্যুর খবর পান।সেই কয়েক মাসের কঠিন অভিজ্ঞতার পর তিনি বুঝতে পারেন যে তার পক্ষে আর বসে থাকা সম্ভব না। যখন তিনি ফিরছিলেন তখনই তিনি জানতেন এ যুদ্ধ খুব শীঘ্র শেষ হবে না।

“আমি চিন্তা করি সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার। কোরিয়ান আর্মিতে যোগ না দিয়ে আমি জাতিসংঘের বাহিনীতে যোগ দেই,” বলছিলেন মিঃ লী।আসলেও যুদ্ধের আরো বাকি ছিল। জাতিসংঘের বাহিনী দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সোলের পুনর্দখল নিয়ে আরো উত্তরের দিকে এগোচ্ছিল। এসময় কমিউনিস্ট চীন সেখানে হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেয়। উত্তর কোরিয়ার সাথে চীনের সীমান্ত বেশ বিশাল।

১৯৫১ সালের জানুয়ারির মধ্যে সোলের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায় চীনের বাহিনী। বেতারে খবর ভেসে আসতে থাকে যে চীনের কমিউনিস্ট বাহিনী সোলের দক্ষিণ দিকে হান নদী পার করে ফেলেছে এবং জাতিসংঘের বাহিনীর দুটি অংশে তারা আক্রমণ চালাচ্ছে।সেই সময়টায় ইউন গু লী জাতিসংঘের প্রকৌশল বিভাগের দোভাষী হিসেবে কাজ করছিলেন। তারা দেশটির ধ্বংস হয়ে যাওয়া রাস্তা ও রেলপথ সংস্কারের কাজ করছিলো। ১৯৫০ থেকে ১৯৫১ সালের শীতকালটা ছিল বেশ তীব্র হিমশীতল একটা সময়।

“ভয়াবহ ঠাণ্ডা ছিল। জাতিসংঘের বদৌলতে আমি ঠিকঠাক খাবার পাচ্ছিলাম। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার যেসব শরণার্থীদের জিনিসপত্র বহন করার জন্য দক্ষিণ কোরিয়া বা জাতিসংঘের বাহিনীতে রাখা হয়েছিল তাদের অবস্থা ছিল জটিল। তাদের খাবার বা পোশাকের ভালো ব্যবস্থা ছিল না।""আমাদের কোম্পানিতে যেসব উত্তর কোরিয়ার স্কুল শিক্ষকরা কাজ করছিলেন তাদেরকে স্রেফ যুদ্ধের যন্ত্রণায় মরতে দেখেছি,” স্মৃতিচারণ করেন মিঃ লী।

এটা তার মনে ছাপও ফেলেছিল। পাঁচ হাজার বছরের একই ইতিহাস বহন করে যাওয়া আর একই ভাষায় কথা বলা সত্ত্বেও তাদের এমন মৃত্যু হতে দেখে মিঃ লীর মধ্যে হতাশা কাজ করতো।“তারা এতো সহজে মারা যেতো না যদি অন্তত আমাদের এটুকু মানবতাবোধ থাকতো যে ‘এ আমরা কী করছি?’ আমাদের সেই সুযোগটুকুও ছিল না। হে ঈশ্বর! কতো মানুষ যে মারা গেছে সেসময়! এটা ভেবে খুব কষ্ট হয়” বলেন লী।

বলা হয় কোরিয়ার সে যুদ্ধে ২০ থেকে ৪০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এর মাঝে ২০ লক্ষ সাধারণ মানুষ, ১৫ লক্ষ পর্যন্ত কমিউনিস্ট বাহিনীর সদস্য, ৪ লক্ষ দক্ষিণ কোরিয়ান সেনা, ৩০ হাজার যুক্তরাষ্ট্রের ও এক হাজার যুক্তরাজ্যের সেনা মৃত্যুর ধারণা করা হয়।সে যুদ্ধ দেশটির রাজনীতিতেও প্রভাব রেখে চলেছে। পরিবেশেরও একটা বড় পরিবর্তন হয়েছিল এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে।“যেদিকেই যেতাম যথেষ্ট গাছগাছালি দেখতে পেতাম না। রান্না করতে জ্বালানী হিসেবে লোকের গাছ কেটে নিতে হতো। শুধু মানুষ না, পুরো প্রাকৃতিক পরিবেশটাই মরুভূমি হয়ে হয়ে গিয়েছিল,” বলছিলেন মিঃ লী।

১৯৫৩ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত সে যুদ্ধ চলেছিল। সে বছর ২৭শে জুলাই যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে সে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের। যদিও কোনো আনুষ্ঠানিক শান্তি চুক্তি হয়নি। কোরিয়া এখনও বিভক্তই আছে।যুদ্ধ শেষ হবার একটু আগে দিয়ে মিঃ লী নিজেকে যুদ্ধে আক্রান্ত মানুষের সেবায় নিয়োজিত করার চিন্তা করেন। উত্তর কোরিয়া থেকে আসা হাজারো শরণার্থীর মাঝে নিজের জীবনকে খুঁজে নেন তিনি। এর একটা বড় অংশ ছিল আন্তর্জাতিক সংস্থা রেড ক্রসের সাথে।বিবিসিকে এই সাক্ষাৎকারটি দিয়েছিলেন ২০১০ সালে।

সূত্র : বিবিসি