মোদির বিরুদ্ধে এবারের অনাস্থা প্রস্তাবকে কেন এত গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে?

মোদির বিরুদ্ধে এবারের অনাস্থা প্রস্তাবকে কেন এত গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে?

মোদির বিরুদ্ধে এবারের অনাস্থা প্রস্তাবকে কেন এত গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে?

ভারতে নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে বিরোধী জোট যে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছে, তার ওপর বিতর্কের দিনক্ষণ আগামীকালই (সোমবার) চূড়ান্ত হবে। এতে সরকারের কোনো আশু বিপদের সম্ভাবনা না থাকলেও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণে এই পদক্ষেপকে খুবই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের এমপি গৌরব গগৈর আনা এই অনাস্থা প্রস্তাবটিতে অন্যান্য ইস্যুর পাশাপাশি মণিপুরের চলমান সহিংসতার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।দেশের ২৬টি বিরোধী দলের জোট ‘ইন্ডিয়া’ এই প্রস্তাবটিকে সমর্থন করছে, যদিও সভার ফ্লোরে সরকারকে হারানোর মতো শক্তি তাদের হাতে নেই।

পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় দু’জন মনোনীতসহ যে মোট ৫৪৫ জন এমপি আছেন, তার মধ্যে সরকার কম করে হলেও ৩৩২ জনের সমর্থন পাবে ধরেই নেয়া হচ্ছে। ফলে এই প্রস্তাবে কিছুতেই সরকারের পতন হচ্ছে না এটা নিশ্চিত।অন্যতম বিরোধী দল আরজেডির এমপি মনোজ ঝা অবশ্য বলেছেন, ‘সংখ্যা আমাদের হাতে নেই এটা যেমন ঠিক, কিন্তু এটা আসলে কোনো নাম্বার গেমও নয়।’‘অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীকে অংশ নিতেই হবে, আর মণিপুর সঙ্কট নিয়ে তাকে পার্লামেন্টে মুখ খুলতে বাধ্য করাটাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য,’ বিবিসিকে বলেন মনোজ ঝা।

গত মে মাসের গোড়ায় মণিপুরে সংখ্যাগুরু মেইতেই আর সংখ্যালঘু কুকিদের মধ্যে রক্তাক্ত জাতি-সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়টি নিয়ে মোটের ওপর নীরবই থেকেছে।কয়েক দিন আগে মণিপুরে দুজন কুকি নারীকে নগ্ন করে ঘোরানোর ভিডিও সামনে আসার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিষয়টি নিয়ে প্রথমবারের মতো মুখ খোলেন – তবে সেটাও ছিল পার্লামেন্টের বাইরে।

এই পরিস্থিতিতে অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর আলোচনার সুবাদে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে পার্লামেন্টে বক্তব্য দিতেই হবে – আর সেটাকেই একটা বড় সাফল্য বলে বিরোধীরা মনে করছেন।তবে শাসক দল বিজেপি প্রকাশ্যে অন্তত বিরোধীদের আনা এই প্রস্তাবকে মোটেই গুরুত্ব দিতে রাজি নয়।

সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশী মন্তব্য করেছেন, ‘বিগত সরকারের আমলেও শেষ দিকে বিরোধীরা অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিলেন – কিন্তু দেশের মানুষ সেবার তাদের উচিত শিক্ষা দিয়েছিলেন। এবারেও যে দেবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই!’তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা অনেকেই মনে করছেন, যে অনাস্থা প্রস্তাবে ভোটাভুটির ফল জানাই আছে – তাকে ঘিরেও এতটা রাজনৈতিক আগ্রহ সাম্প্রতিককালে কখনোই দেখা যায়নি।আর ঠিক সে কারণেই এই প্রস্তাবটি সংসদীয় গণতন্ত্রে আর পাঁচটি অনাস্থা প্রস্তাবের চেয়ে একেবারেই আলাদা বলে তারা মনে করছেন।

অনাস্থা প্রস্তাবের ইতিহাস
১৯৫২ সালে ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় গৃহীত নিয়মাবলীতে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার অবকাশ রাখা হয়েছিল, যে প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটিতে হেরে গেলে ওই সরকারকে বিদায় নিতে হবে।তখন অনাস্থা প্রস্তাব আনতে গেলে অন্তত ৩০ জন এমপির সমর্থন জরুরি ছিল, এখন সেটাকেই বাড়িয়ে ৫০ জন করা হয়েছে।

তবে প্রথম দুটি লোকসভার মেয়াদে কোনো অনাস্থা প্রস্তাব আনাই হয়নি। এর পর থেকে স্বাধীন ভারতের সংসদীয় ইতিহাসে মোট ২৮ বার বিরোধীরা ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছেন।তবে এই ২৮টির মধ্যে শুধুমাত্র একটি ক্ষেত্রেই তা সরকারের পতন ডেকে এনেছিল – আর সেটা ছিল ১৯৭৯ সালে মোরারজি দেশাই সরকারের ক্ষেত্রে। ওই প্রস্তাবটি এনেছিলেন কংগ্রেসের ওয়াই বি চবন।এছাড়া ১৯৯০র দশকে প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমহা রাও দু’দুবার বেশ অল্পের জন্য অনাস্থা প্রস্তাবে পরাজয়ের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন।

একবার তো তিনি মাত্র ১৪ ভোটের ব্যবধানে পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। সেই ভোটাভুটিতে প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়ার জন্য ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চার এমপিরা ঘুষ নিয়েছেন, এই অভিযোগে পরে তাদের জেলেও যেতে হয়েছিল।এবারের আগে ভারতীয় সংসদে শেষবারের মতো কোনো অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়েছিল ২০১৮ সালের ২০ জুলাই।দক্ষিণ ভারতের রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশকে কেন ‘বিশেষ মর্যাদা’ দেয়া হচ্ছে না, তার প্রতিবাদ জানাতে সেবার ওই প্রস্তাবটি এনেছিল তেলুগু দেশম পার্টি বা টিডিপি।

অন্ধ্রের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী ও টিডিপি নেতা চন্দ্রবাবু নাইডু ওই ইস্যুতে তখন বিজেপি জোট ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন, এবং দেশের বেশ কতগুলো বিরোধী দল পার্লামেন্টে তাদের সমর্থনও করেছিল।তবে পার্লামেন্টে ১২ ঘণ্টা ধরে চলা বিতর্কের শেষে নরেন্দ্র মোদি সরকার সেই ভোটাভুটিতে জিতেছিল ১৯৯ ভোটের বিশাল ব্যবধানে।ভারতে অনেকেই অবশ্য সেই বিতর্ককে মনে রেখেছেন সম্পূর্ণ অন্য কারণে।

তখনকার কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধী বিতর্কে তার ভাষণ শেষ করেই হঠাৎই ট্রেজারি বেঞ্চ অতিক্রম করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে গিয়ে জড়িয়ে ধরেন – যেটাকে অনেকেই পরে ‘জাদু কি ঝাপ্পি’ (ম্যাজিকের মতো আলিঙ্গন) বলে বর্ণনা করেছিলেন।রাহুল গান্ধী তখন বলেছিলেন, তার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর মনে যতই ঘৃণা বা বিদ্বেষ থাক – তিনি সেই আলিঙ্গনের মাধ্যমেই তা দূর করে দেবেন।

এবারে কী হতে যাচ্ছে?
ঠিক পাঁচ বছর আগামী সপ্তাহে পার্লামেন্টে যখন আবার অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে বিতর্ক শুরু হবে – প্রধানমন্ত্রীর আসনে নরেন্দ্র মোদি থাকলেও সভায় রাহুল গান্ধী কিন্তু থাকতে পারছেন না।‘মোদি’ পদবীধারীদের অপমান করার অভিযোগে গুজরাটের একটি আদালতের রায়ের জেরে রাহুল গান্ধীর লোকসভার সদস্যপদ খারিজ হয়ে গেছে কয়েক মাস আগেই।

দিল্লির সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আরতি জেরাথ মনে করেন, পার্লামেন্টে রাহুল গান্ধীর এই অনুপস্থিতিই এবারে অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর বিতর্ককে একটা আলাদা মাত্রা দেবে।তিনি বলেন, ‘আমরা জানি রাহুল গান্ধীই হলেন নরেন্দ্র মোদির প্রিয়তম ‘পাঞ্চিং ব্যাগ’। রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধেই সুবক্তা নরেন্দ্র মোদি তার সেরা আক্রমণগুলো শানিয়েছেন।’

‘বিজেপি এটাও জানে যে মোদি বনাম রাহুল, এই বাইনারিটাই তাদের এতদিন সবচেয়ে বেশি ফায়দা দিয়েছে। এখন পার্লামেন্টে নরেন্দ্র মোদি কিভাবে তার সেই পরীক্ষিত ও সফল ফর্মুলাটা পাল্টান, সেটা অবশ্যই দেখার বিষয় হবে,’ বলছিলেন আরতি জেরাথ।এছাড়া যেভাবে একটি শিউড়ে ওঠার মতো পাশবিক ভিডিও ও সেখানে সরকারি উদাসীনতার অভিযোগ এবারের এই অনাস্থা প্রস্তাবটিকে ‘ট্রিগার’ করেছে, সেটাও একটি নজিরবিহীন ঘটনা।ভারতের বিরোধী শিবির ঐক্যবদ্ধভাবে বিজেপি-নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের বিরুদ্ধে এই প্রস্তাবটি এনেছে – ফলে এবারের ‘ব্যাটল-লাইন’টিও গতবারের তুলনায় অনেকটাই আলাদা।

এই জন্যই ফলাফল জানা থাকা সত্ত্বেও এই অনাস্থা প্রস্তাবটি জাতীয় বা এমনকি আন্তর্জাতিক স্তরে এতটা আগ্রহের সৃষ্টি করেছে বলে আরতি জেরাথের ধারণা।তিনি বলেন, ‘আমি তো বলব এটা যত না সংখ্যার যুদ্ধ, তার চেয়ে বেশি ধারণার যুদ্ধ (পারসেপশন ব্যাটল)!’‘ভোটাভুটিতে অবশ্যই বিরোধীরা হারবেন। কিন্তু মণিপুরে যখন আজও আগুন জ্বলছে, তখন সভার ফ্লোরে এই বিতর্কটাই কিন্তু ঠিক করে দেবে সেই পারসেপশন ব্যাটলে সরকার না বিরোধীপক্ষ – কারা জিতছেন!’

সূত্র : বিবিসি