সাজানো ভিডিও দিয়ে ভারতে যেভাবে ধর্মীয় ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে

সাজানো ভিডিও দিয়ে ভারতে যেভাবে ধর্মীয় ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে

সাজানো ভিডিও দিয়ে ভারতে যেভাবে ধর্মীয় ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে

ভারতে লাখ লাখ মানুষ দেখেছে এবং শেয়ার করেছে এমন একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে এক ব্যক্তি কালো বোরকা পরিহিত একজনকে আক্রমণ করছে। বোরকা পরিহিত ব্যক্তির হাতে ধরা একটি শিশু। আক্রমণকারী জোরপূর্বক ওই লোকটির বোরকা খুলে ফেললে তার পরিচয় জানা যায়।

এই ভিডিওটির সাথে যুক্ত করে দেয়া হিন্দি এক বার্তায় লোকজনকে বোরকা পরিহিত অপরাধীদের ব্যাপারে ‘সতর্ক থাকতে’ বলা হয়েছে। কারণ অপরাধীরা এটি ব্যবহার করে নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে রাখে এবং ‘শিশুদের অপহরণ’ করে। সারা বিশ্বেই অনেক মুসলিম নারী এই পোশাকটি পরেন।এ বছরের শুরুর দিকে এই ভিডিওটি ইউটিউবে পোস্ট করা হয় এবং ডিলিট করার আগ পর্যন্ত এটি প্রায় দুই কোটি ৯০ লাখ বার দেখা হয়েছে।ভিডিওটিতে যা দেখানো হচ্ছে তা প্রকৃত কোনো ঘটনা নয়। এটা একটা নাটক এবং অপেশাদার অভিনেতারা এটি তৈরি করেছে।এ ধরনের সাজানো ভিডিও, যা মূলত বিনোদনের জন্য তৈরি, সেগুলো ভারতের সোশাল মিডিয়াতে সত্য ঘটনা হিসেবে তুলে ধরে শেয়ার করা হচ্ছে এবং এই প্রবণতা ক্রমশই বাড়ছে।

এসব ভিডিওতে প্রায়শই মিথ্যা তথ্য তুলে ধরা হয় যা ধর্মীয় ও নারীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে ব্যবহার করা হচ্ছে।ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি ২০১৪ সালের মে মাসে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়, বিশেষ করে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে উত্তেজনার ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।এসব মিথ্যা বক্তব্য বিভিন্ন সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে দেয়া হয়, এর পাশাপাশি এগুলোকে নারীর বিরুদ্ধেও ব্যবহার করা হচ্ছে।

এসব সাজানো ভিডিও ভারতের বিভিন্ন ভাষায় তৈরি করা হচ্ছে- হিন্দি, তামিল, মালয়লাম, গুজরাটি, মারাঠি এবং তেলেগু। কখনো কখনো স্থানীয় মিডিয়াও এসব ভিডিওকে ভুল করে সংবাদ হিসেবে প্রচার করে থাকে।এরকম সাজানো অনেক ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে লোকেরা শিশু অপহরণ করার জন্য বোরকা পরিধান করছে। বাস্তব জীবনে এসব ভিডিওর খারাপ প্রভাবও পড়েছে।গত কয়েক বছরে ছিনতাইকারী মনে করে ক্রুদ্ধ জনতার হাতে কয়েকজন আক্রমণের শিকার হওয়ার পর অনেক রাজ্যে কর্তৃপক্ষ এ ধরনের ভুয়া খবরের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে।

এসব ভিডিও কেন বিপদজনক?
এ ধরনের সাজানো ভিডিওগুলোতে মিথ্যা তথ্য থাকে, যা সোশাল মিডিয়ায় লোকজনকে বিভ্রান্ত করতে পারে। কোনো কোনো ভিডিওতে এগুলোর সত্যতার ব্যাপারে সতর্কবাণী উল্লেখ করা থাকে কিন্তু সেগুলো থাকে ভিডিওর মাঝখানে অথবা শেষের দিকে, যা চোখে পড়ে না।বেশিরভাগ সময় এই সতর্কবার্তা থাকে ইংরেজিতে, অনেকসময় দর্শকরা যা বুঝতে পারে না।শুরুতে বোরকা পরিহিত লোকটির যে ভিডিওটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, অল্ট নিউজ তার সত্যতা যাচাই করে দেখেছে যে আসল ভিডিওটিতে সতর্কবার্তা ছিল। তাতে বলা হয়েছিল যে ‘এটি একটি ফিকশন বা কল্পিত ঘটনা’। কিন্তু বার্তাটি মাত্র এক সেকেন্ডের জন্য দেখা গেছে।

অনেকে এসব ভিডিও সিসিটিভির মতো করে তৈরি করেন যা দেখতে আরো বেশি বাস্তব বলে মনে হয়।বিভিন্ন ভাষায় তৈরি এরকম একটি ভিডিওতে, যা ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ভাইরাল হয়েছিল, কোনো ধরনের তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই তাতে দেখানো হয়েছে যে মুসলিম পুরুষরা খাবারের সাথে মদ মিশিয়ে হিন্দু নারীদের মাতাল করে ফেলার চেষ্টা করছে।এই ভিডিওর নিচে করা মন্তব্য থেকে ধারণা করা যায় অনেকেই এই দাবি সত্য বলে বিশ্বাস করেছেন। কেউ কেউ ইসলাম-বিদ্বেষী মন্তব্যও করেছেন। যেমন একজন লিখেছেন- লাভ জিহাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন।

মুসলিম পুরুষ প্রেমের ফাঁদে ফেলে হিন্দু নারীদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করছে- এমন একটি ষড়যন্ত্র ‘লাভ জিহাদ’ নামে পরিচিত।হায়দ্রাবাদ-ভিত্তিক ভেঙ্কট সিপানার তৈরি বেশিরভাগ ভিডিওতে সিসিটিভর মতো দেখতে রেকর্ডিং সাইন ও টাইম-স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হয়েছে। তার ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ১২ লাখের বেশি এবং সেখানে ৪০০-এর বেশি ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে।একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে এক দর্জি একজন নারীর সাথে অসদাচরণ করছে। এটি টুইটার ও ফেসবুকে বেশ কয়েকবার শেয়ার করা হয়েছে।

এতে দাবি করা হচ্ছে যে একজন মুসলিম পুরুষ হিন্দু এক নারীর সাথে খারাপ আচরণ করছে। তাতে বলা হয়েছে- ‘হিন্দু বোন ও কন্যাদের অনুরোধ করা হচ্ছে তারা যেন মুসলিমদের দোকানে না যান, তারা খারাপ মানসিকতার মানুষ।’সিপানা বিবিসিকে বলেছেন যে- ‘বাস্তব জীবন তুলে ধরা ও সচেতনতা তৈরি করার জন্য’ তিনি এসব ভিডিও তৈরি করেছেন।আলিশান জাফরি নামের একজন সাংবাদিক, যিনি এ ধরনের ভুয়া খবর নিয়ে গবেষণা করেন, তিনি বলছেন- এ ধরনের সাজানো ভিডিও হয়তো শারীরিক সহিংসতার জন্ম দেয় না, কিন্তু এগুলোকে ধর্মীয় পক্ষপাতকে আরো গভীর করে।

‘যেসব বিষয় সমাজকে বিভক্ত করে রেখেছে এসব ভিডিও সেগুলোকে উস্কানি দিচ্ছে। বেশিরভাগ ভিডিও নির্দিষ্ট কিছু সম্প্রদায়, বিশেষ করে মুসলিমদের উদ্দেশে তৈরি করা। এগুলো যখন ভাইরাল হয়ে যায়- তখন সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংস মনোভাব তৈরি হয়,’ বলেন তিনি।কখনো কখনো অনলাইনে ভুয়া খবর ছড়িয়ে দেয়ার জন্য এ ধরনের সাজানো ভিডিও ব্যবহার করা হয়। কোনোটাতে বন্ধু, পরিবারের সদস্য এবং বয়সের অনেক ব্যবধান আছে- এরকম মানুষের মধ্যে অবৈধ সম্পর্ক দেখানো হয়। গত মে মাসে এরকম দুটো ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, যাতে হিন্দুদের ওপর হামলার মিথ্যা খবর প্রচার করা হয়।

একটি ভিডিওতে জাফরান রঙের, যার সাথে হিন্দু ধর্মের সম্পর্ক রয়েছে, কাপড় পরিহিত এক ব্যক্তি বলছেন যে তিনি তার বোনকে বিয়ে করছেন। অন্য ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে ওই একই নারী তার পাশে বোরকা পরে দাঁড়িয়ে আছেন এবং বলছেন যে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করার জন্য তিনি তাকে বিয়ে করছেন।কেউ কেউ টুইটারে এই ভিডিওটি ব্যবহার করে দাবি করেছে যে এই লোকটি হিন্দু এবং তিনি তার বোনকে মুসলিম নারী সাজিয়ে ভিডিওটি তৈরি করেছেন।এই দুটো ভিডিওর দুজন পুরুষ ও নারীকে আরো কিছু ভিডিওতে অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গেছে।

আসল ক্লিপটি যে ইউটিউব চ্যানেলে পাওয়া যাবে তার অনুসারীর সংখ্যা চার লাখের বেশি এবং এই চ্যানেলে সাধারণত সাজানো ভিডিও পোস্ট করা হয়।এই চ্যানেলের মালিক ভিক্রম মিশ্রকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এসব ভিডিওকে যে অনেকেই বাস্তব বলে ধরে নিচ্ছে- এ বিষয়ে তিনি অবহিত আছেন কিনা। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই হিট করতে চাই। আমি এমন ভিডিও বানাই যেসব বিষয়ে নিয়ে সমাজে আলোচনা হচ্ছে।’তিনি বলেন, শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য এসব ভিডিও তৈরি করা হয়েছে। কারণ আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে যে ১২ জন কাজ করেন তারা এখান থেকে অর্জিত অর্থ দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করেন।এ ধরনের সাজানো ভিডিওর বিষয়ে সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর নীতিমালা সম্পর্কে জানতে বিবিসির পক্ষ থেকে তাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল।

ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মালিক কোম্পানি মেটার একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘ফেসবুকে যেসব কনটেন্ট সহিংসতা ছড়াতে পারে সেগুলোর বিষয়ে নীতিমালা পরিষ্কার, এগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।ইউটিউবের পক্ষ থেকেও একই ধরনের মন্তব্য করা হয়।আরেকটি সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্স- যা আগে টুইটার নামে পরিচিত ছিল- তারা স্বয়ংক্রিয় জবাব পাঠিয়ে বলেছে যে তারা এ বিষয়ে বিবিসির সাথে ‘দ্রুত যোগাযোগ’ করবে।

সাজানো ভিডিও কিভাবে চেনা যায়?
‘অনেক ভিডিও দেখেই বোঝা যায় যে এগুলো সাজানো। এ ধরনের ভিডিও অন্যান্য দেশেও তৈরি ও শেয়ার করা হয়। কিন্তু ভারতের মতো দেশের লোকেরা এগুলোকে বিশ্বাস করে এবং তারপর এসব ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। কারণ এগুলো রক্ষণশীল দর্শকদের টার্গেট করে তৈরি,’ বলেন ফ্যাক্ট ক্রেসেন্ডো নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হারিশ নায়ের।

তিনি বলেন, ভারতীয়রা যেসব ভিডিওকে জনস্বার্থমূলক বলে মনে করেন সেগুলো শেয়ার করে থাকে।তার মতে, এই সাজানো ভিডিও ভারতে ভুয়া তথ্যের ট্রেন্ড নয়। তবে সমাজে এগুলোর বড় ধরনের প্রভাব আছে, কারণ এগুলো বর্তমান বিশ্বাস ও সেন্টিমেন্টকে বৈধতা দিয়ে থাকে।

দিল্লি-ভিত্তিক সংস্থা ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের নীতি-বিষয়ক পরিচালক প্রতীক ওয়াঘরে বলেন, এই সমস্যার একটা দিক হচ্ছে মিডিয়া ব্যবহারে লোকজনের দক্ষতার অভাব, কিন্তু এটা এমন এক সমাজে ঘটছে যেখানে নানা ধরনের বিভাজন রয়েছে এবং লোকজন সেভাবেই ভাবছে।তবে একটি ভিডিও সাজানো কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখার উপায় আছে।ভারতে তথ্য যাচাইকারী সংস্থা নিউজচেকারের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক রুবি ধিঙরা বলেছেন, ভিডিওর ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল, স্থান, প্রতিক্রিয়া এবং যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তার ব্যাপারে লোকজনের সতর্ক থাকা দরকার।

এসব খেয়াল করলেই তারা বুঝতে পারবে যে ভিডিওতে যাদের দেখা যাচ্ছে- তারা ক্যামেরা থেকে তাদের মুখ সরিয়ে রাখছে কিনা, অথবা তারা স্বাভাবিকের চেয়ে উচ্চস্বরে কথা বলছে কিনা, অথবা অতিরিক্ত অভিনয় করে ফেলেছে কিনা।ধিঙরা আরো বলেছেন, সাজানো ভিডিওতে একটা ঘটনা যতোগুলো ক্যামেরায় এবং কোনো ধরনের বিঘ্ন ছাড়াই ধারণ করা হয়, বাস্তব কোনো ঘটনা সেভাবে ধারণ করা একেবারেই সম্ভব নয়। সূত্র : বিবিসি