দেশী তামাকজাত কোম্পানিগুলোর প্রতি অন্যায় আচরণ কার স্বার্থে?

দেশী তামাকজাত কোম্পানিগুলোর প্রতি অন্যায় আচরণ কার স্বার্থে?

ফাইল ছবি

মিজানুর রহমান শাহীন

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) ও নীতিনির্ধারনী মহলের একটি কুচক্রী অংশের বিমাতাসুলভ আচরণে বিলীন হবার দোরগোড়ায় দেশীয় তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত নীতিমালায় বিদেশী তামাকজাত পণ্য উৎপাদন কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর একের পর এক সুবিধা প্রাপ্তি ধ্বংসের দাঁড়প্রান্তে টেনে এনেছে দেশীয় কোম্পানিগুলোকে৷ একদিকে দেশীয় কোম্পানিগুলোর এমন বেহাল অবস্থা অথচ বিদেশি কোম্পানিটিকে রাজস্ব ছাড়সহ একের পর এক সুবিধার আওতাভুক্ত করা হচ্ছে গত বেশ কিছু বছর ধরেই।

তামাকজাত পণ্য উৎপাদন খাতে গত দুই যুগ ধরেই দেশীয় মালিকানাধীন কোম্পানির দখল ছিলো ৭০ শতাংশ এবং বাকি ৩০ শতাংশ ছিলো বিদেশী কোম্পানি ব্যাটের দখলে। কিন্তু বিগত ১০ বছরে এই চিত্র ঘুরে গেছে ঠিক ১৮০ ডিগ্রী। দেশের তামাকজাত পণ্যের বাজারে বর্তমানে বিদেশী কোম্পানির দখল প্রায় ৯০ শতাংশ। সীমিত বাজার দখলে রেখেও এতোদিন নানানভাবে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছিলেন দেশীয় উদ্যোক্তারা৷ প্রতি বাজেটে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর নিত্য নতুন সুবিধা লাভ তাদেরকে এখন ছিটকে ফেলেছে প্রতিযোগিতা থেকেই। যারা ফলশ্রুতিতে বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

গত দুই মেয়াদে দেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিভিন্ন সময় নানান বেফাঁস মন্তব্য করে সমালোচিত হন সাবেক এই মন্ত্রী। তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার সময় তার পুত্রবধূ মানতাশা আহমেদের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (NBR) উপর। তার মাধ্যমেই ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর সাথে ব্যবসায়িক সুবিধা দেয়ার সমঝোতায় আসেন তৎকালীন NBR কর্মকর্তারা। তাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে দেশী-বিদেশি সকল সিগারেট কোম্পানিকে একই পরিমাণ রাজস্ব প্রদানের আওতায় আনা হয়, যা অন্যান্য পন্যের বেলায় বিদেশি কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রায় ৪-৫ গুণ!

মানতাশা আহমেদের পরিকল্পনা অনুযায়ীই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (NBR) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, যিনি নিজেই কিনা ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর একজন পরিচালক ছিলেন৷ এমনকি তার ভাই কামরুল হোসাইন ভূঁইয়া সেসময় BAT এর উচ্চপদস্থ একজন হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কামরুলের পরিকল্পনাতেই সিগারেটের উপর অস্বাভাবিক হারে কর বৃদ্ধি কর‍তে থাকে NBR, যা আদতে দেশীয় কোম্পানিগুলোকে বন্ধের দিকে ঠেলে দেয়। কারণ তারা নিশ্চিত ছিলো, বিদেশী কোম্পানির সমান কর দিলে দেশীয় কোম্পানিগুলো কোনোভাবেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না।

এমন নীতির ফলে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো পৃথিবীর নামীদামী ব্র‍্যান্ডের সিগারেট দেশে খুব কম দামে বিক্রির সুযোগ পাচ্ছে, এতে দেশীয় তামাকজাত পণ্য উৎপাদন কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। ভোক্তারা তাদের বাজেটের মধ্যে বিদেশি ব্র‍্যান্ডের সিগারেট পাওয়ায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন দেশী ব্র‍্যান্ডগুলো থেকে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড অন্যান্য সকল পণ্যের ক্ষেত্রে বিদেশি কোম্পানিগুলোর উপর স্বভাবতই চড়া কর আরোপ করে যেনো দেশীয় কোম্পানিগুলো বাজারে টিকে থাকতে পারে এবং দেশের বিপুল অর্থ বিদেশে না চলে যায়। কিন্তু তামাকজাত পণ্যের ক্ষেত্রে তাদের উল্টো নীতি অনেকদিন ধরেই প্রশ্নবিদ্ধ। এক্ষেত্রে রীতিমতো অন্যায় সুযোগ সুবিধা নিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছে সবচেয়ে বড় সিগারেট উৎপাদন কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো।

ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো এমন বাজার দখলের পাশাপাশি নীতিনির্ধারণী মহলের একটা বড় অংশকে দখলে নেয়ার ইতিহাস বাংলাদেশেই প্রথম নয়। এর আগে আফ্রিকাতেও একই কাজ করে সমালোচিত হয়েছে কোম্পানিটি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের স্বেচ্ছা অন্ধত্বের সুযোগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই দেশের বিশাল বৈদেশিক রিজার্ভ লাভের টাকা দেখিয়ে বিদেশে পাচার করছে কোম্পানিটি৷ দেশীয় কোম্পানিগুলোকে এমন অবস্থায় ফেলে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর এমন কার্যক্রম আমাদের অর্থনীতির জন্য চরম অশনী সংকেত বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা ।

সৌজন্যে: এই সময়২৪.কম