ফুকুশিমা পরমাণু কেন্দ্রের বর্জ্য পানি সাগরে ফেলা কতটা নিরাপদ?

ফুকুশিমা পরমাণু কেন্দ্রের বর্জ্য পানি সাগরে ফেলা কতটা নিরাপদ?

ফুকুশিমা পরমাণু কেন্দ্রের বর্জ্য পানি সাগরে ফেলা কতটা নিরাপদ?

জাপানের ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে তেজস্ক্রিয় দূষণ-যুক্ত পানি প্রশান্ত মহাসাগরে ছাড়া শুরু হয়েছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ১২ বছর আগে সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।জাপানের এই বিতর্কিত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সে দেশেই প্রতিবাদ চলছে। দক্ষিণ কোরিয়াও এর প্রতিবাদ জানিয়েছে। অন্যদিকে চীন জাপানের সামুদ্রিক খাবারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।তবে জাতিসংঘের পরমাণু নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলছে, এই পানিতে তেজস্ক্রিয় দূষণের মাত্রা এত কম যে তা মানুষ এবং পরিবেশের ওপর খুব সামান্যই প্রভাব ফেলবে।কিন্তু সাগরে এই পানি ফেলা কি নিরাপদ?

জাপানে ২০১১ সালে এক ভূমিকম্পের পর যে সুনামি সৃষ্টি হয়, তা ফুকুশিমা পরমাণু কেন্দ্রটি প্রায় ধ্বংস করে ফেলে। পরমাণু কেন্দ্রটির শীতলীকরণ ব্যবস্থা বিকল হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে পরমাণু চুল্লীর কেন্দ্রটি সাংঘাতিক উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এই কেন্দ্রের পানি তখন তেজস্ক্রিয় পদার্থের সঙ্গে মিশে দূষিত হয়ে পড়ে।

এই দুর্যোগের পর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির মালিক টেপকো পরমাণু চুল্লীর ফুয়েল রডগুলি ঠাণ্ডা করার জন্য সেখানে পাম্প করে পানি ঢালছিল। এর মানে হচ্ছে, এটি থেকে প্রতিদিনই তেজস্ক্রিয় দূষণ-যুক্ত পানি বেরুচ্ছিল। এই পানি প্রায় এক হাজার ট্যাংকে ভরে রাখা হচ্ছিল। যে পরিমাণ দূষিত পানি এই কেন্দ্র থেকে বেরিয়েছে, তা দিয়ে ৫০০ অলিম্পিক সুইমিং পুল ভরে ফেলা যাবে।জাপান বলছে, যে জায়গায় এই পানির ট্যাংকগুলো আছে, সেই জায়গা দরকার হবে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পুরোপুরি অকেজো করে বন্ধ করে দেয়ার জন্য। এছাড়া কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এই পানির ট্যাংকগুলো ধসে পড়লে তখন কী হবে, সেটি নিয়েও উদ্বেগ আছে বলে জানিয়েছে জাপান।

ফুকুশিমা কেন্দ্র থেকে জাপান বর্জ্য পানি সাগরে ছাড়ছে ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা এই কাজ করার অনুমতি দিয়েছে। সব ট্যাংকের পানি ছাড়ার প্রক্রিয়াটি শেষ হতে সময় লাগবে তিরিশ বছর।জাপান যদি এই বর্জ্য পানি সাগরে ছাড়ার আগে সেখান থেকে সব তেজস্ক্রিয় পদার্থ তুলে নিতে পারতো, তাহলে হয়তো তাদের এই পদক্ষেপটি এত বিতর্কিত হতো না।

এই সমস্যার মূলে রয়েছে হাইড্রোজেনের একটি তেজস্ক্রিয় উপাদান, যেটির নাম ট্রাইটিয়াম। পানি থেকে এটি আলাদা করা যায় না, কারণ এটি করার মতো কোন প্রযুক্তি এখনো পর্যন্ত নেই। এর পরিবর্তে এই দূষিত পানিতে আরও পানি মিশিয়ে এটিকে হালকা করে দেয়া হচ্ছে।বিশেষজ্ঞদের বেশিরভাগের মত হচ্ছে, এই দূষিত পানি এখন সাগরে ছেড়ে দেয়া নিরাপদ। কিন্তু এর কী প্রভাব আসলে পড়বে, সেটি নিয়ে সব বিজ্ঞানী একমত নন।বিশ্বের সব জায়গার পানিতেই ট্রাইটিয়াম পাওয়া যায়। অনেক বিজ্ঞানী যুক্তি দেন যে, ট্রাইটিয়ামের মাত্রা যদি খুব কম হয়, এর প্রভাব একেবারেই সামান্য।

তবে সমালোচকদের মত হচ্ছে, সাগরের তলদেশে, সামুদ্রিক প্রাণী এবং মানুষের ওপর এ কী প্রভাব পড়ে, সেটি নিয়ে আরও গবেষণা দরকার।আইএইএ বলছে, ফুকুশিমায় পরমাণু কেন্দ্রের কাছে ‘স্বাধীনভাবে করা বিশ্লেষণে’ দেখা যাচ্ছে সেখানে সাগরে ছাড়া বর্জ্য পানিতে ট্রাইটিয়ামের মাত্রা নিরাপদ সীমার অনেক নীচে আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাবার পানিতে ট্রাইটিয়ামের যে নিরাপদ সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে, ফুকুশিমার বর্জ্য পানিতে ট্রাইটিয়ামের পরিমাণ তার চেয়েও ছয়গুণ কম।

শুক্রবার টেপকো বলেছে, বৃহস্পতিবার বিকেলে সাগরের পানির যে নমুনা তারা সংগ্রহ করেছে, তাতে দেখা যায় পানিতে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা নিরাপদ সীমার মধ্যেই আছে। সেখানে ট্রাইটিয়ামের মাত্রা প্রতি লিটারে ১,৫০০ বিকিউ’র নীচে।জাপানের পরিবেশ মন্ত্রণালয় বলছে, তারাও শুক্রবার ১১ টি ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় সাগরের পানির নমুনা সংগ্রহ করেছে, এবং এই পানি পরীক্ষার ফল রবিবার প্রকাশ করবে।

পোর্টসমথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্ট এন্ড জিওলজিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক জেমস স্মিথ বলেছেন, “তাত্ত্বিকভাবে দেখলে, আপনি এই পানি পান করতে পারবেন। কারণ এই বর্জ্য পানি এরই মধ্যে দূষণ-মুক্ত করা হয়েছে, এরপর এটির সঙ্গে আরও পানি মিশিয়ে এর দূষণের ঘনত্ব আরও কমিয়ে দেয়া হয়েছে।”

একটি ফরাসী গবেষণাগারের একজন পদার্থবিদ ডেভিড বেইলি একথার সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, “মূল প্রশ্ন হচ্ছে সেখানে কী পরিমাণ ট্রাইটিয়াম আছে।”“যে মাত্রায় ট্রাইটিয়াম এই পানিতে আছে, তাতে সামুদ্রিক প্রাণীর কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। যদি না সেখানে হঠাৎ করে সামুদ্রিক জীবের সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে যায়।”

তবে কিছু বিজ্ঞানীর অভিমত হচ্ছে, সাগরে বর্জ্য পানি ছাড়ার ফল কী হবে সেটা আগে থেকে অনুমান করা যায় না।প্রফেসর এমিলি হ্যামন্ড যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির জ্বালানি এবং পরিবেশ আইন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, “ ট্রাইটিয়ামের মতো রেডিওনিউক্লাইডস নিয়ে চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে এটি এমন এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে যা উত্তর এখনো বিজ্ঞান পুরোপুরি দিতে পারছে না। অর্থাৎ খুবই কম মাত্রায় যখন তেজস্ক্রিয় দূষণ হচ্ছে, তখন সেখানে নিরাপদ মাত্রাটি আসলে কী?”

“আইএইএ’র কাজের ওপর হয়তো অনেক ভরসা রাখা যায়। কিন্তু সেই সাথে এটাও মনে রাখা দরকার, কোন একটি মানদণ্ড মেনে চলার মানে এই নয় যে, পরিবেশ বা মানুষের ওপর এর প্রভাব একেবারেই শূন্য।”যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল এসোসিয়েশন অব মেরিন ল্যাবরেটরিজ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে একটি বিবৃতি দিয়ে বলেছে, তারা জাপানের প্রকাশ করা তথ্যে সন্তুষ্ট নয়।

ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াই এর মেরিন বায়োলজিস্ট রবার্ট রিচমন্ড বিবিসিকে বলেন, রেডিওলজিক্যাল এবং পরিবেশগত প্রভাবের ব্যাপারে যে মূল্যায়ন করা হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। আমরা এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমাদের আশংকা হচ্ছে, পানিতে কী দূষণ ঘটছে, জাপান হয়তো তা শনাক্ত করতে পারবে না। আর যদি তা পারেও, তখন পানি থেকে এই তেজস্ক্রিয় দূষণ সরানোর কোন উপায় থাকবে না। দৈত্য একবার বোতল থেকে বেরিয়ে গেলে সেটিকে তো আর বোতলে ভরা যাবে না।”গ্রীনপিসের মতো পরিবেশবাদী গোষ্ঠী ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ক্যারোলাইনার বিজ্ঞানীদের এপ্রিলে প্রকাশিত এক গবেষণার কথা উল্লেখ করে এক্ষেত্রে আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছে।

গ্রীনপিস ইস্ট এশিয়ার সিনিয়র নিউক্লিয়ার বিশেষজ্ঞ শন বার্নি বলেন, প্রাণী বা উদ্ভিদে যদি ট্রাইটিয়াম সরাসরি ঢুকে, তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এর ফলে সন্তান জন্মদানের সক্ষমতা কমে, ডিএনএ সহ কোষের গঠন ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।জাপান সাগরে বর্জ্য পানি ছাড়ার পর চীন জাপানি সামুদ্রিক খাবার নিষিদ্ধ করেছে। কোন কোন বিশ্লেষক মনে করেন, এটি হয়তো একটি রাজনৈতিক চাল। কারণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা এত কম যে, সামুদ্রিক খাবার নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কোন বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণ তারা দেখছেন না।

কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় যাদের নিত্যদিন যেতে হয়, তাদের অনেকে উদ্বিগ্ন।

দক্ষিণ কোরিয়ায় যে ঐতিহ্যবাহী সামুদ্রিক ডুবুরিরা ‘হাইনিও’ নামে পরিচিত, তারা বিবিসিকে বলেছেন, তারা দুশ্চিন্তায় আছেন।“এখন আমি সমুদ্রে ডুব দিতে নিরাপদ বোধ করবো না”, বলছেন কিম ইয়ান-আহ। তিনি জেজু দ্বীপে গত ছয় বছর ধরে ডুবুরির কাজ করছেন। “আমরা নিজেদের সাগরের অংশ বলে মনে করি। কারণ আমরা এই সাগরের পানিতে প্রতিদিন ডুব দিচ্ছি”, বলছিলেন তিনি।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্জ্য পানি সাগরের স্রোতে ভেসে যাবে, বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরের কুরুশিও স্রোতে।

অন্যদিকে জাপানের জেলেরা বিবিসিকে বলেছেন, তাদের সুনামের হয়তো একটা স্থায়ী ক্ষতি হয়ে গেল। তারা তাদের জীবিকা নিয়ে চিন্তিত।প্যাসিফিক আইল্যান্ডস ফোরামের সভাপতি এবং কুক আইল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক ব্রাউন বলছেন, আইএইএর মতো তিনিও মনে করেন, এখানে নিরাপত্তার মানদন্ড মেনে চলা হচ্ছে।তিনি বলেন, পুরো অঞ্চলের সবাই হয়তো এরকম একটা জটিল বিষয়ে একমত হবে না, তবে সবাইকে বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনার ওপর ভরসা রাখতে হবে।

সূত্র : বিবিসি