আফ্রিকায় কীভাবে চীন ও রাশিয়ার প্রভাব বাড়ছে?

আফ্রিকায় কীভাবে চীন ও রাশিয়ার প্রভাব বাড়ছে?

স্যান্ডটন শহরে ব্রিকস গ্রুপের সর্বশেষ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

স্যান্ডটন- দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রমবর্ধমান জরাজীর্ণ শহর জোহানেসবার্গের উপকণ্ঠে একটি ঝকঝকে শহর যেটি মূলত একটি ব্যাংক পাড়া। এখানেই ব্রিকস গ্রুপের সর্বশেষ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে বিশ্বে পশ্চিমা আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার একক ইচ্ছা থেকে গঠিত এই জোটটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলেও এখনো খুব একটা সুসংগঠিত নয়। এই জোটটিতে এখন অন্তত আরো কয়েক ডজন দেশ যোগ দেয়ার জন্য অপেক্ষায় আছে।

ব্রিকস সম্মেলন ঘিরে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্তমানে স্বস্তির যে বাতাস বইছে তা মূলত প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের এই সম্মেলন থেকে দূরে থাকার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের কারণেই।তিনি যদি সম্মেলনে আসার বিষয়ে জোর দিতেন তাহলে, ইউক্রেনে সংগঠিত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হবে কিনা সে বিষয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে তার নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে হতো।

সেই বিব্রতকর চ্যালেঞ্জকে পাশ কাটিয়ে আসতে পেরে দক্ষিণ আফ্রিকা এখন স্বাগতিক দেশ হিসেবে তাদের ভূমিকা পালন করছে- বেশ গর্ব নিয়েই তারা ব্রিকসের সকালের মিটিং, বাণিজ্য মেলা, পৌর সংলাপের মতো কার্যক্রম বিষয়ক মেইল দিয়ে সাংবাদিকদের ইনবক্স ভরিয়ে দিচ্ছে।

অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, এই অস্বাভাবিক দাপ্তরিক উদ্দীপনা আসলে ইঙ্গিত করছে যে, কত দ্রুত এই দেশটি পশ্চিমাদের কাছ থেকে দূরে আরো বহুমাত্রিক বিশ্বের দিকে, বিশেষ করে চীনের দিকে এবং এর থেকে কিছুটা কম করে হলেও রাশিয়ার কক্ষপথের দিকে সরে যাচ্ছে।সম্প্রতি কেপটাউনে অনুষ্ঠিত ব্রিকসের মূল সম্মেলনের আগে জোটটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকের সংবাদ সম্মেলনে একজন রুশ সাংবাদিক আমার দিকে ঝুঁকে এসে বলেছিলো: “তোমরা তোমাদের মানবাধিকারের স্বর্গরাজ্যকে নিজেদের (পশ্চিমে) কাছে রাখ, আমরা নতুন করে পৃথিবী গড়ছি।”

ব্রিকস হয়তো এখনো তার প্রাথমিক অবস্থাতেই রয়েছে, কিন্তু তারপরও এটি বাড়ছে- অন্তত কিছু সময় পর পর হলেও এর একটি মৌলিক এবং উদ্বেগজনক শক্তি ও উত্তেজনা অনুভব করা যায়।

দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের আয়োজিত একটি বৈদেশিক নীতি বিষয়ক কর্মশালায় আমার এক সহকর্মী যোগ দিয়েছিলেন, যিনি আমাকে বলেন যে, সেখানে চীন যে ভবিষ্যৎ শক্তি এবং পশ্চিমা প্রভাব যে কমে আসছে সে বিষয়ে একটি অপ্রতিরোধ্য ঐক্যমত্য ছিল।আর এখানেই দক্ষিণ আফ্রিকার অস্বস্তির দিকটি সমীকরণে আসে।

দেশটির প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা একজন ধনী ব্যবসায়ী যিনি ভাল করেই জানেন যে, কোভিডের কারণে স্থানীয় অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ বেকারত্ব ও বৈষম্যের মোকাবেলা করে চলেছে। আর সে কারণেই এই ঘনীভূত সংকট কাটাতে হলে আরো ব্যাপকহারে বৈদেশিক বিনিয়োগ দরকার।এর সমাধান অবশ্যই রাশিয়া নয়। দেশটির সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার বাণিজ্য সম্পর্ক নেই বললেই চলে।নিঃসন্দেহে চীন এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পক্ষ, কিন্তু দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার দীর্ঘদিনের বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের মাঝেই আচ্ছাদিত হয়ে আছে।

তাহলে এই গভীর অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা তার সেই গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমা সম্পর্ককে কেন ত্যাগ করবে? যদিও এই সম্পর্কে এরইমধ্যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে।এই প্রশ্নের অন্তত আংশিক হলেও জবাব রয়েছে দেশটির ক্রমবর্ধমান উদ্বিগ্ন এবং লক্ষ্যভ্রষ্ট ক্ষমতাসীন দলের কাছে।তিন দশক ক্ষমতায় থাকার পরও আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস তার নিজস্ব অন্তর্কোন্দল, দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে আসতে হিমশিম খাচ্ছে।

ইউক্রেনের যুদ্ধের বিষয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা নানা ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শুরুতে তারা আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েছে, পরে আবার নিন্দা জানাতে অসম্মতি জানিয়েছে, নেটোকে দোষারোপ করেছে, মি. পুতিনের প্রশংসা করেছে, শান্তির মধ্যস্থতাকারী হওয়ার প্রস্তাবনা দিয়েছে, রাশিয়ার নৌ মহড়া আয়োজন করেছে, ওয়াশিংটনের কাছে সাফাই দিতে দৌড়ে গেছে, এবং ক্রেমলিনের বিষয়ে বার বার আলোচনা সামনে এনেছে।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের তোলা অভিযোগ অনুযায়ী, গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকা রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিলো কিনা সেটি নিয়ে এখনো রহস্য রয়েছে।অবশ্য প্রেসিডেন্ট রামাফোসা রাশিয়ার আগ্রাসন নিয়ে যে গভীর অস্বস্তিতে রয়েছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একই সাথে তিনি নিজেকে আরো বেশি বহু-মেরুর বিশ্ব গঠনের বিষয়ে একজন জ্ঞানী ও নিরপেক্ষ প্রবক্তা হিসেবে তুলে ধরতে ব্যাকুল।

কিন্তু তাঁর সরকার ও দলের অনেকেই তাঁর এই অবস্থানকে ভাল চোখে দেখে না। বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রামের সময় মস্কোর সমর্থন দেয়ার বিষয়টি ছাড়াও তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি নিয়েও সন্দেহ কাজ করে।এই ধরণের এলোমেলো বার্তা দ্বন্দ্বে জড়িত সব পক্ষের মধ্যেই বিরক্তির উদ্রেক করেছে এবং এতে দক্ষিণ আফ্রিকার দুর্বলতা ও সিদ্ধান্তহীনতা আরো বেশি করে সামনে এসেছে।নেলসন ম্যান্ডেলার ‘রেইনবো নেশন’ বা বহু বর্ণের দেশ এখন যে ধুকছে- সেটা নিশ্চিত। অনেকে মনে করেন যে খুব শিগগিরই এই দেশটি “ব্যর্থ রাষ্ট্রে” পরিণত হবে।কিন্তু এর বিপরীতে এই সপ্তাহের ব্রিকস সম্মেলন ক্রেমলিনকে তাদের নিজস্ব, আরো কৌশলগত এবং কার্যকর কূটনীতি দেখানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম দেবে।

এই উপমহাদেশের সাম্প্রতিক সংবাদ শিরোনামগুলোতে প্রাধান্য পেয়েছে নিজেরের সেনা অভ্যুত্থান এবং রাশিয়ার সুবিধাবাদী ওয়াগনার গ্রুপের ভাড়াটে যোদ্ধাদের তাদের নিজস্ব স্বার্থে বিশৃঙ্খলাকে ব্যবহারের ঘটনাগুলো। এমন ঘটনা তারা এর আগে মালি ও সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক-সিএআর'র মতো দেশগুলোতেও ঘটিয়েছে।তবে “ঔপনিবেশিক” আফ্রিকায় পশ্চিমা প্রভাবের বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প হিসেবে রাশিয়া নিজেকে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্যের সাথে মস্কো এটি করেছে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সফর এবং চাতুর্যের সাথে মিডিয়াকে ব্যবহার করে বার্তা প্রদানের মাধ্যমে।

দারিদ্র্য-পীড়িত দেশগুলোতে যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, ক্রমবর্ধমান তরুণ জনসংখ্যা, বর্ধিত বেকারত্ব, স্থিতিশীলতা নিয়ে হতাশা রয়েছে, সেখানকার মানুষেরা নতুন বিকল্পের বিষয়ে বেশ উদার।এখানে প্রশ্ন আসে যে- রাশিয়াকে রুখতে পশ্চিমা দেশগুলো কী করছে?তবে অবশ্যই এই মহাদেশ নিয়ে সাধারণ কোনো উপসংহার টানাটা বিপদজনক এবং নতুন করে শুরু হওয়া স্নায়ুযুদ্ধে আফ্রিকার সরকারগুলোকে তুরুপের তাস ভাবাটা ভুল এবং আপত্তিকর হতে পারে।

কিন্তু ব্রিকসের পশ্চিমা সংস্করণ কোথায়? যুক্তরাজ্যের একজন “আফ্রিকা বিষয়ক মন্ত্রী” রয়েছেন। কিন্তু কেউই এই পদে এক বছরের বেশি সময় ধরে থাকার কথা চিন্তা করেননি।উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ততা, কঠোর শর্ত এবং পছন্দের আফ্রিকান নেতাদের জন্য সুবিধাজনক বিদেশি আমন্ত্রণের মতো পদক্ষেপ এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করেছে যে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো এখনো এই মহাদেশকে সমর্থনযোগ্য কোনো অংশীদার নয় বরং একটি সংকট হিসেবেই গণ্য করে।

এটা হয়তো ন্যায়সঙ্গত নয়। সবকিছুর পরও, পশ্চিমা দেশগুলো দশকের পর দশক ধরে এই মহাদেশের স্বাস্থ্যসেবা, ব্যবসা এবং সরকারগুলোকে সহায়তা করতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শক্তি এবং অর্থ খরচ করেছে।কিন্তু পশ্চিমা সামরিক বাহিনীর ভূমিকা, বিশেষ করে নিজের এবং সোমালিয়ায় ফরাসি সেনা এবং আমেরিকার ড্রোন ব্যবহার করাটা কঠোর সমালোচনা উস্কে দিয়েছে।এর থেকে একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় যে, ব্রিকসের এই বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি কেন এই মহাদেশে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে এবং চলতি সপ্তাহে স্যান্ডটনের সমাবেশে এই জোটটি কেন সরব আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরবে।

সূত্র : বিবিসি