সর্বজনীন পেনশন স্কিম : এক মাসে কত জন অ্যাকাউন্ট খুলেছেন?

সর্বজনীন পেনশন স্কিম : এক মাসে কত জন অ্যাকাউন্ট খুলেছেন?

সর্বজনীন পেনশন স্কিম : এক মাসে কত জন অ্যাকাউন্ট খুলেছেন?

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর এক মাস পূর্ণ হলো আজ ১৭ই সেপ্টেম্বর।এ স্কিমের আওতায় সরকারি চাকুরীজীবী ব্যতীত দেশের সকল নাগরিককে পেনশন সুবিধার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ কারো বয়স ১৮ বছরের বেশি হলেই এখন অনলাইনে এটিতে নিবন্ধন করতে পারবেন।

অগাস্টের ১৭ তারিখ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি সাড়ম্বরে উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের পরপরই এতে অনেক সাড়া পড়ে বলে জানায় জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ।সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ স্কিম নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ দেখা গিয়েছে। তবে, সেইসাথে জনমনে নানান প্রশ্নও দেখা যায় পেনশন ঘিরে।ঠিক এক মাস পর এখন কী অবস্থায় দাঁড়িয়ে সর্বজনীন পেনশন স্কিম?

কত মানুষ অ্যাকাউন্ট খুলেছেন?

প্রথমবারের মত চালু হওয়া পেনশন স্কিমে এক মাসে কত মানুষ যুক্ত হয়েছেন, এ প্রশ্নে জবাবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা জানিয়েছেন, এতে নিবন্ধনের সংখ্যার তুলনায় অ্যাকাউন্ট খুলেছেন কম মানুষ।

“এক মাস কিন্তু খুব বেশি সময় না। একদম প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত যদি মানুষের কাছে পৌঁছাতে না পারি, প্রবাসীদের কাছে যদি পৌঁছাতে না পারি, তাহলে তো আমাদের খুব বেশি প্রত্যাশার সুযোগ নেই। আমরা এখন সে চেষ্টাটাই করে যাচ্ছি।”বিবিসি বাংলাকে মি. মোস্তফা বলেছেন, "এখন পর্যন্ত পেনশন স্কিমের আওতায় এসেছেন ১২ হাজার ৮৭৬ জন, যারা অ্যাকাউন্ট ওপেন করে চাঁদা পরিশোধ করেছেন। যদিও এতে নিবন্ধনের সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি।"তবে এ মূহুর্তে অ্যাকাউন্ট খোলার চাইতে পেনশন স্কিম নিয়ে সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছানোটাই তাদের প্রধান লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন তিনি।

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের এই কর্মকর্তা বলেছেন, যারা শুধু এটা সম্পর্কে জানতে পারছেন, তারাই এখানে নিবন্ধন করছেন।আর জানানোর জন্য জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ নানা উপায় বেছে নিয়েছে, বলে তিনি জানিয়েছেন।"এর অন্যতম গণমাধ্যম। জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন টক শো’র মাধ্যমে আমরা পেনশন স্কিমের ধারণা পরিষ্কার করার কাজ করছি," জানান মি. মোস্তফা।

এছাড়া বিদেশি মিশনগুলোর সঙ্গে আলাদা করে কাজ করছেন প্রবাসী স্কিমে নিবন্ধন বাড়াতে। আর মাঠ পর্যায়ে জেলা প্রশাসকদের যুক্ত করে চেষ্টা করা হচ্ছে প্রান্তিক মানুষদের কাছে পৌঁছানোর।এর আগে ১৭ই অগাস্ট উদ্বোধনের কয়েক ঘন্টা পর যখন এই কর্মকর্তার সাথে কথা হয়েছিল বিবিসি বাংলার, তখন তিনি জানিয়েছিলেন, একসাথে ১১০০-১২০০ লোক তাদের প্ল্যাটফর্মে। আর প্রথম দিনই নিবন্ধন করে হাজারের উপর।

সেই হিসেবে উদ্বোধনের মাসখানেক পর এসে মানুষের আগ্রহে খানিকটা ভাটা পড়েছে কি?“দেখুন, আমরা কিন্তু বলিনি এক মাসের মধ্যে আমরা এত হাজার আশা করছি। সে কারণে ঐ মূল্যায়ণে যাচ্ছি না, আমাদের এই মূহুর্তের কাজ স্কিমটাকে পরিচিত করা।” গোলাম মোস্তফা বলেন, “মানুষ যখন বুঝবে এরকম স্কিমে তার অর্থ সুরক্ষিত, কোন সমস্যা হবে না, তখন এমনি আগ্রহ বাড়বে।”

কোন স্কিমে আগ্রহ বেশি?

সর্বজনীন পেনশন স্কিমে এখন আছে মোট চারটি ধরণ - প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা।একেক স্কিম একেক শ্রেণিকে লক্ষ্য করে তৈরি, তাই চাঁদার পরিমাণও একেক রকম।তবে এর মধ্যে প্রগতি স্কিমেই সবচেয়ে বেশি অ্যাকাউন্ট চালু হয়েছে, বলে জানান অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য নিযুক্ত হওয়া মি. মোস্তফা।প্রগতি স্কিমের মোট অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ছয় হাজার ১৭৬ টি, অর্থাৎ পেনশন স্কিমে মোট অ্যাকাউন্টের প্রায় অর্ধেক।

এই স্কিমটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের জন্য, এক্ষেত্রে তিন ভাগে চাঁদার হার ভাগ করা হয়েছে। কেউ চাইলে মাসে দুই হাজার, তিন হাজার বা পাঁচ হাজার টাকা করে দিয়ে এই স্কিমে অংশ নিতে পারবে।

আবার প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানের মালিকও প্রগতি স্কিমে অংশ গ্রহণ করতে পারবে। সেক্ষেত্রে মোট চাঁদার অর্ধেক কর্মচারী এবং বাকি অর্ধেক প্রতিষ্ঠান বহন করবে।উদ্বোধনের সময় সরকার মোট ছয়টি স্কিমের কথা ঘোষণা করে। তবে আপাতত বাকি দুটি চালু করার কোন লক্ষ্য নেই বলে জানিয়েছেন গোলাম মোস্তফা।

মানুষের মনে সন্দেহ কী দূর হয়েছে?

সরকার দেশে প্রথমবারের মতো সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর উদ্যোগ নেয়ার পর থেকেই এর সমালোচনা করে আসছে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো।এ স্কিমে জমা দেয়া অর্থ সুরক্ষিত থাকবে কী-না, মেয়াদ শেষে টাকা তুলতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হবে কী-না - এরকম নানা প্রশ্নও দেখা দেয় জনমনে।তবে পেনশন কর্তৃপক্ষ সবসময়ই বলে এসেছে এ নিয়ে শঙ্কা থাকার কোন কারণ নেই, কারণ সরকার নিজে এর গ্যারান্টি দিচ্ছে।

জাতীয় পেনশন স্কিমের কর্মকর্তা মি. মোস্তফা বলেন, “অন্য দেশে দেখবেন পেনশন হয় প্রজ্ঞাপন দিয়ে, আমরা কিন্তু এটা আইন করে চালু করেছি। যার মানে রাষ্ট্রীয় কমিটমেন্ট দিয়ে। যে কর্তৃপক্ষ করা হয়েছে সেটা সংবিধিবদ্ধ, কাজেই এটা তো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চলে গিয়েছে।”তারপর মানুষের মনে যেসব প্রশ্ন বা সংশয় আছে তা দূর করতে প্রতিনিয়ত কাজ করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।“আমরা নানাভাবে জবাব দিচ্ছি, আমাদের ওয়েবসাইটে, মিডিয়ায়, এছাড়া মাঠ প্রশাসন থেকেও এ ব্যাপারে কাজ করা হচ্ছে। এখন একদিনে তো সব হবে না, পর্যায়ক্রমে হবে।”

সরকার কি পেনশন স্কিমের অর্থ ঋণ নেবে?

শনিবার ১৬ই সেপ্টেম্বর সর্বজনীন পেনশন স্কিম নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, “এই স্কিম থেকে যদি ভালো পরিমাণ টাকা উঠে তাহলে আমরা এখান থেকে ঋণ করতে পারবো উন্নয়ন খাতের জন্য।”

তার এই বক্তব্য বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে মি. মোস্তফা মনে করেন এটা অর্থনীতির এক ধরণের 'স্বাভাবিক মেকানিজম'।এক্ষেত্রে তিনি ট্রেজারি বন্ডের উদাহরণ দেন - "মনে করেন, একই রকমভাবে সরকারের কাছে পেনশন স্কিম হল জনগণের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ।"“ঘটনা কিন্তু এমন না যে আমার কাছে সরকার চাইলো যে দুই হাজার কোটি টাকা ঋণ দাও। এটা বন্ডের মতো, আমি মালিক, টাকা সরকারের কাছে, দিনশেষে তারা আমাকে ফেরত দিচ্ছে।”

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য

এই মূহুর্তে কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য হচ্ছে ১০ কোটি মানুষকে এ স্কিমের আওতায় আনা।মি. মোস্তফা বলেন, “এটা যতক্ষণ না পূরণ হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের লক্ষ্য পূরণ হয়েছে বলা যাবে না। আর আমরা ধারাবাহিকভাবে সেই পর্যায়ে যেতে চাই।”লক্ষ্য পূরণে এই মূহুর্তে পেনশন স্কিম সম্পর্কে মানুষকে জানানোটাকেই নিজেদের প্রধান কাজ বলছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ।

একইসাথে মানুষের মনে সংশয় দূর করতেও নানা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছে সংস্থাটি।পেনশন সম্পর্কিত যে কোন তথ্যের জন্য সপ্তাহের সাত দিন ২৪ ঘন্টার জন্য একটি কল সেন্টার চালু রাখছেন তারা।যেকোন মোবাইল নম্বর থেকে ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে যেকোন বাংলাদেশি নাগরিক এই স্কিমের খুঁটিনাটি জেনে নিতে পারবেন।

স্কিম কীভাবে খুলবেন?

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে , দেশের সর্বস্তরের জনগণকে সুবিধা দিতে পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।বিশেষ করে, গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। ফলে তাদের সামাজিক নিরাপত্তা দেবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা।

জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সকল শ্রেণী পেশার বাংলাদেশি নাগরিক এই স্কিমে অংশ নিতে পারবে। অর্থাৎ সর্বজনীন পেনশন স্কিমের অংশ হতে হলে জাতীয় পরিচয়পত্র আবশ্যক।তবে ব্যতিক্রম আছে, প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য।যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই তারা চাইলে পাসপোর্ট দিয়েও নিবন্ধন করতে পারবেন, কিন্তু সেক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে তার কপি জমা দিতে হবে।

সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধনের জন্য upension.gov.bd ওয়েবসাইটে যেতে হবে। সেখানে গিয়ে ব্যক্তি তার জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল নাম্বার এবং ইমেইল দিয়ে কয়েকটি ধাপে নিবন্ধন করবেন।এসময় ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য দরকার হবে। কেউ চাইলে এক বা একাধিক ব্যক্তিকে নমিনি করতে পারবেন।মাসিক চাঁদা ছাড়াও কেউ চাইলে তিন মাস পরপর বা বছরে একবার পুরো চাঁদা দিয়ে দিতে পারবেন।

নির্ধারিত তারিখের মধ্যে চাঁদা দিতে ব্যর্থ হলে তার পরের এক মাস পর্যন্ত জরিমানা ছাড়া চাঁদা পরিশোধ করা যাবে। এরপর থেকে প্রতি দিনের জন্য এক শতাংশ বিলম্ব ফি যুক্ত হবে।কেউ টানা তিন কিস্তি পরিশোধ না করলে তার অ্যাকাউন্টটি স্থগিত হয়ে যাবে।

তবে কেউ যদি নিজেকে অসচ্ছল ঘোষণা করে তাহলে ১২ মাস পর্যন্ত চাঁদা না দিলেও অ্যাকাউন্টটি স্থগিত হবে না।অনলাইন এবং যে কোন মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে চাঁদা পরিশোধ করা যাবে।আপাতত শুধুমাত্র সোনালী ব্যাংকে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের হিসাব খোলা হয়েছে। কেউ চাইলে সরাসরি সোনালী ব্যাংকে গিয়েও নিবন্ধন করতে পারবেন ও চাঁদা দিতে পারবেন।

যাদের বয়স ৫০ পেরিয়ে গেছে তারাও সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অংশ নিতে পারবেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে তিনি পেনশন পাবেন টানা ১০ বছর চাঁদা দিয়ে যাওয়ার পর।অর্থাৎ স্কিম অনুযায়ী ব্যক্তির বয়স ৬০ বছর হলেই তিনি সরকার থেকে পেনশন পেতে শুরু করবেন, তাকে আর চাঁদা দিতে হবে না।কিন্তু কেউ যদি ৫৫ বছর বয়সে এসে স্কিমে অংশ নেন তাহলে ৬৫ বছর বয়স থেকে তিনি পেনশন পেতে শুরু করবেন।

সূত্র : বিবিসি