ঠাকুরগাঁওয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী কারাম উৎসব

ঠাকুরগাঁওয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী কারাম উৎসব

ঠাকুরগাঁওয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী কারাম উৎসব

উৎসবমূখর পরিবেশে ঠাকুরগাঁওয়ে উদযাপিত হলো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ওঁরাও স¤প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী কারাম উৎসব।ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সমৃদ্ধ লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্যতম অংশ কারাম পূজা বা উৎসব। লাল-হলুদ শাড়ি আর খোপায় ফুল রঙিন সাজে বাদ্যের তালে নেচে গেয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ওঁরাও সম্প্রদায় উদযাপন করে কারাম উৎসব। সোমবার রাতে রাতভর গ্রামের আখড়ায় পুঁতে রাখা কারাম (খিল কদম) ডালকে ঘিরে নাচ-গান হয়।
আজ মঙ্গলবার সকালে আখড়া থেকে কারাম ডাল উঠিয়ে গ্রামের কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সের নারী-পুরুষ নেচে-গেয়ে গ্রামের বাড়ি-বাড়ি ঘুরে শেষে গ্রামের পুকুরে বিসর্জন দেয়। প্রতিবছর ভাদ্র মাসের শেষ বা আশ্বিন মাসের শুরুতে মঙ্গলের প্রতীক কারাম গাছকে ঘিরে ওঁরাও, মুন্ডাসহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ।

জেলা সদরের পাঁচপীরডাঙ্গা গ্রামে সন্ধ্যার পর পূর্জা আর্চনা শেষে স্বজনদের নিয়ে বাড়ির উঠনেই কারাম উৎসবের শুরু হয়। এ উৎসবকে ঘিরে সালন্দর ইউনিয়নের আশপাশের গ্রাম জামুরীপাড়া, মজাতিপাড়া, তেলিপাড়াসহ ৫টি গ্রামের মানুষ তাদের নাচ দেখতে ভিড় জমায়। এর আগে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের সৌহার্দপুর্ণভাবে বরণ করেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মেয়েরা।

কারামপূজা উদযাপন কমিটি’র সভাপতি বিশ্বানাথ কেরকাটার সভাপতিত্বে উৎসব অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন- অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক রাম কৃষ্ণ বর্মণ। গেস্ট অব অনার ছিলেন- অতিরিক্ত পুলিশ সুপার লিজা বেগম ও ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এড. অরুণাংশু দত্ত টিটো। বিশেষ অতিথি ছিলেন- সিনিয়র সহকারি জজ ও জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার এস এম শফিকুল ইসলাম, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন, জেলা পরিষদ সদস্য ও জেলা যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ দত্ত সমীর প্রমুখ।

প্রতিবছর জেলার গোবিন্দনগর, জগন্নাথপুর, চন্ডিপুরসহ কয়েকটি গ্রামে ওঁরাও সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ কারাম পূজা ও সামাজিক উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, জেলায় ৯টি স্থানে কারাম উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। জেলায় ৬৮ হাজার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মানুষের বাস।

উল্লেখ্য, কারাম উৎসবটি ওঁরাওদের বছরের সবচেয়ে বড় পর্ব হিসেবে বিবেচিত। এই কারাম উৎসব ৩টি পর্বে অনুষ্ঠিত হয়। একক কারাম যা একক প্রচেষ্টায় নিজ বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়, দোমাসি কারাম এটি ভাদ্র মাসের শেষে শুরু হয় এবং আশ্বিন মাসের শুরুতে শেষ হয়, ১০ কারাম এটি এলাকার সকলে মিলে পালন করে ভাদ্র মাসের চাঁদের ১০ম দিনে পালন করে। এ উৎসবটি সাধারণত যখন পৃথিবীতে মৌসুমি বায়ু চরমে থাকে এবং ধানের গাছগুলো মাঠে দাঁড়িয়ে থাকে ও ধানের গাছ কান পর্যন্ত বড় হয় নি এ সময় করা হয়ে থাকে। এ উৎসবটি মূলত ধান কাটার আগে এবং অবসর সময়ে “প্রচুর ফসল উৎপাদনক্ষম উৎসব” ও শস্য মাঠে দাঁড়ানোর শক্তি যোগানোর জন্য করা হয়ে থাকে।

এ ছাড়াও কারামে গ্রামবাসী গ্রামের যুবক-যুবতীদের সুসন্তান লাভের জন্যও প্রার্থনা করা হয়। কারাম উৎসবের প্রধান অনুষ্ঠানটি কারাম গাছের তিনটি ডাল কেটে গ্রাম্য আখড়ার মাঝখানে কারাম রাজা হিসাবে গ্রামের নারীদের দ্বারা পোতা হয়। ডালের চতুর্দিকে বসে কারামের কাহিনী শোনা হয়। এরপর গ্রামের ছেলে-মেয়েরা কারাম রাজার চর্তুদিকে সারারাত ধরে নাচে। পরের দিন সকালে যুবতী মেয়েরা বিশেষভাবে গোজানো জাওয়া পুঁপ তাদের ভাই ও আত্মীয়-সজনদের মধ্যে বিতরণ করে।

সকালের সুর্যের তাপ বাড়ার সাথে সাথে পাহান কারাম ডালগুলো তুলে কাছাকাছি পুকুর বা নদীতে সম্মানের সাথে ভাসিয়ে দেয় এবং পারিবারিক ভোজে অংশগ্রহণ করে। ঐতিহাসিকগণের বর্ননায় জানা যায় যে, বহুদিন পূর্বে পাটনার রোহিতাসগড় হতে আর্যদের দ্বারা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ওঁরাওরা প্রাণ রক্ষার্থে তাদের আশ্রয়স্থান ত্যাগ করে পালাতে থাকে এবং আর্যরা তাদের পিছু ধাওয়া করতে থাকে। অনেকদূর আসার পর ক্লান্ত ওঁরাওরা একটি কারাম গাছের নীচে আশ্রয় গ্রহণ করলে আশ্চর্যজনকভাবে আর্যরা ফিরে যায় এবং ওঁরাওরা বিপদমুক্ত হয়। ওঁরাওদের বিশ্বাস এ কারাম বৃক্ষ তাদের রক্ষা করেছে। এ বিশ্বাস থেকেই সেদিন ওঁরাওরা কারাম বৃক্ষের উপাসনা শুরু করে এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ওঁরাওরা এ স্মৃতি স্মরণ করে মর্যাদাসহকারে প্রতি বছরে এ উৎসবটি উদযাপন করে।

সূত্র : বাসস