পোশাকের দাম বৃদ্ধি বনাম শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি

পোশাকের দাম বৃদ্ধি বনাম শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি

ফাইল ছবি

আগামী ডিসেম্বর থেকে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশের দাম যৌক্তিকভাবে বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।

মার্কিন ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি এই অনুরোধ জানিয়েছেন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান। অন্যদিকে শ্রমিকদের মজুরি যৌক্তিকভাবে বাড়ানোর কথা বলছে ক্রেতাজোট। পাশাপাশি শ্রমিকনেতা শহীদুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের কথাও বলছেন তারা।

বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গত ২৭ জুলাই একটি চিঠি দেন আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের (এএএফএ) সভাপতি স্টিফেন ল্যামার। সেই চিঠির একটি অনুলিপি আমাকেও দিয়েছিল। আমি সেই চিঠির জবাব দিয়েছি। সেখানে আমি যা জানি সেটা বলেছি। শ্রমিকনেতার মৃত্যুর ঘটনায় কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। পাশাপাশি মজুরিবোর্ডও কাজ করছে। এখন নতুন মজুরিবোর্ড এলে পোশাকের মূল্য না বাড়ালে আমাদের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হবে। সে কারণেই আমি তাদের কাছে পোশাকের যৌক্তিক মূল্য বাড়ানোর কথা বলেছি।

স্টিফেন ল্যামারকে শুক্রবার পাঠানো চিঠিতে ফারুক হাসান উল্লেখ করেছেন, ‘শ্রমিকনেতার মৃত্যুসংক্রান্ত বিষয়ে আপনার উদ্বেগ আমরা বুঝতে পারি। আপনি হয়তো লক্ষ করেছেন, আমরা এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে যথাযথ তদন্ত ও দ্রুত বিচার চেয়েছি। ইতোমধ্যে সন্দেহভাজন ব্যক্তি গ্রেফতার হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে মামলার তদন্ত করছে। পাশাপাশি তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি পুনর্নিধারণের জন্য মজুরি বোর্ড কাজ করছে। ইতোমধ্যে বোর্ড কয়েকটি বৈঠক করেছে। তারা কারখানা পরিদর্শনের পাশাপাশি শ্রমিক ও মালিকদের সাথে আলোচনা করছে।’

তিনি আরো উল্লেখ করেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, এ বছর শেষ হওয়ার আগেই নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হবে। সর্বশেষ নিম্নতম মজুরি পর্যালোচনার প্রবণতা ও গত পাঁচ বছরের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি সমন্বয় করলে যৌক্তিকভাবে মজুরি বাড়বে। আজকের সময়ে বিশ্বে মূল্যস্ফীতি থেকে কারো রেহাই নেই, তা বাংলাদেশ কিংবা অন্য যেকোনো দেশ হোক। তা ছাড়া আপনি জানেন যে- ২০১৩ সালের মজুরি কাঠামোতে ৫ শতাংশ বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট বাধ্যতামূলক করা হয়। ফলে প্রতিবছর শ্রমিকের মূল মজুরি ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়। নিম্নতম মজুরি বোর্ড একটি স্বাধীন সংস্থা, যাতে সমানসংখ্যক হারে শ্রমিক-মালিক ও নিরপেক্ষ সদস্য রয়েছেন। মজুরি বোর্ড স্বাধীনভাবে কাজ করছে। ফলে কত মজুরি বাড়বে, সেটি অনুমান করা আমার পক্ষে কঠিন।’

ফারুক হাসান চিঠিতে আরো উল্লেখ করেন, ‘মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় আমাদের পোশাকশ্রমিকদের মানসম্মত জীবনযাত্রার ব্যয় নিশ্চিতে আমরা ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পোশাকের ন্যায্য ও নৈতিক মূল্য প্রত্যাশা করছি। এএএফএর সদস্যদের কাছে থেকে যুক্তিসংগতভাবে পোশাকের মূল্য বাড়াতে আপনার সম্পৃক্ততার দাবি জানাই। আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে উৎপাদিত ক্রয়াদেশের পোশাকের দাম যৌক্তিকভাবে বৃদ্ধির বিষয়টি মার্কিন ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান যাতে বিবেচনা করে, সে জন্য আপনার প্রতি অনুরোধ জানাই। নতুন মজুরি কাঠামোতে রূপান্তরের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আশা করছি, আপনি এই চিঠির বিষয়ে আপনার সদস্যদের সাথে অবগত করবেন।’

যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাক ও জুতা কোম্পানি ও তাদের সরবরাহকারীদের জাতীয় পর্যায়ের বাণিজ্য সংগঠন হচ্ছে এএএফএ। সংগঠনটি এক হাজারের বেশি জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করে। এই সংগঠনের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বছরে ৪৯০ বিলিয়ন বা ৪৯ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য বিক্রি করে থাকে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গত ২৭ জুলাই একটি চিঠি দেন এএএফএর সভাপতি স্টিফেন ল্যামার। সেই চিঠিতে এএএফএ সভাপতি শ্রমিকনেতা শহীদুল ইসলাম হত্যাকাণ্ড নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করেন। একই সাথে তিনি তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকের জন্য ন্যায্য মজুরি নির্ধারণের অনুরোধ জানান। পোশাকশ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি প্রস্তাব চূড়ান্ত করতে প্রকৃত শ্রমিক প্রতিনিধি, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষের সাথে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের উন্মুক্ত সংলাপেরও দাবি জানায় এএএফএ।

বিজিএমইএ'র সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, নতুন যে মজুরি বোর্ড আসছে সেখানে শ্রমিকদের বেতন যৌক্তিকভাবে বাড়ানো হবে। এখন শ্রমিকদের বেতন বাড়লে যদি পোশাকের মূল্য না বাড়ে তাহলে অনেক প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের পক্ষে শ্রমিকদের নিয়মিত বেতন ভাতা দেয়া কঠিন হয়ে যাবে। এই কারণেই আমরা পোশাকের মূল্য যৌক্তিকভাবে বাড়ানোর কথা বলেছি। এটা হলে শ্রমিক-মালিক সবার স্বার্থ রক্ষা হবে।’

এদিকে বাংলাদেশের প্রধান দুই বাজার উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে সামগ্রিক পোশাক রফতানি আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। চলতি বছরের প্রথম ৭ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি কমেছে এক-তৃতীয়াংশ ও ইউরোপের বাজারে কমেছে ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। দেশের মোট রফতানির প্রায় ৮০ শতাংশ যায় এ দুই বাজারে। এ দুটি বাজারে যেকোনো কারণে অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে তার বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে পড়ে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, এটা শুধু আমাদের না সবার ক্ষেত্রেই হয়েছে। চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, কাম্বোডিয়া, পাকিস্তানসহ যারা রফতানি করে সবারই কমেছে। বরং গত দুই বছরে আমরা নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করার কারণে আমাদের গ্রোথটা ধরে রাখতে পেরেছি। অন্যদের অবস্থা কিন্তু আমাদের চেয়েও খারাপ।’
পাশ্চাত্য ভোক্তাদের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপের কারণে পোশাকের খুচরা বিক্রি কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের পোশাক রফতানি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদারও মনে করেন শ্রমিকদের বেতন যৌক্তিকভাবে বাড়া উচিত।

ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, অক্টোবরেই মজুরি বোর্ডের মেয়াদ ৬ মাস শেষ হবে। এর মধ্যে মাত্র দুইবার মিটিং হয়েছে।

আগামী মাসের ৩ তারিখ আরেকটা মিটিং হওয়ার হওয়ার কথা। অক্টোবরের মধ্যে তাদের কাজ শেষ করতে হবে। কিন্তু এখন অগ্রগতি দেখে আমার সন্দেহ হয় সঠিক সময়ের মধ্যে এটা হবে কি না? যাই হোক নতুন যে মজুরি বোর্ড আসছে, সেখানে যৌক্তকভাবে বেতন বাড়ানোর দাবি জানিয়েছি।
সূত্র : ডয়চে ভেলে