আরেক মহামারী জয় ১৮৮৫ সাল...প্যারিস।

আরেক মহামারী জয় ১৮৮৫ সাল...প্যারিস।

ছবি: সংগৃহীত

বাড়ির সদর দরজার সামনে খেলা করছিল নয় বছরের ছেলে যোসেফ...যোসেফ মেইস্টার। যোসেফের মা মাদাম মেইস্টার ব্যস্ত ঘরের কাজে। হঠাৎ ছেলের কান্নার আওয়াজ শুনে চমকে উঠলেন তিনি। তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেলেন সদর দরজায়...সামনের দৃশ্য দেখে ভয়ে অসাড় হয়ে গেল তাঁর শরীর।

একটা কুকুর...অদ্ভুত তার চোখের চাউনি...মুখ দিয়ে লালা গড়াচ্ছে...চাপা গর্জনের সঙ্গে কুকুরটা সজোরে কামড়ে ধরেছে যোসেফের পা...যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে যোসেফ। সম্বিত ফিরে পেয়ে কুকুরটাকে একটা লাথি মারলেন মাদাম মেইস্টার...কুকুরটা একটু দূরে ছিটকে পড়লো। যোসেফের রক্তমিশ্রিত লালা ঝরছে তার মুখ থেকে। খানিকক্ষণ ক্রূর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে চলে গেল কুকুরটা।

কুকুরটাকে চিনতে পেরেছেন মাদাম মেইস্টার। এটা পাশের পাড়ার সেই পাগলা কুকুরটা...যেটা ইতোমধ্যেই দু'জনকে কামড়েছে...দু'জনেই ভর্তি রয়েছেন হাসপাতালে...ডাক্তার বলেছেন, জলাতঙ্ক হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা...বাঁচার কোনো আশা নেই! সেই কুকুরটাই কামড়েছে তাঁর একমাত্র ছেলে যোসেফকে!

মাথা খারাপ হয়ে গেল মাদাম মেইস্টারের। ছেলেকে নিয়ে ছুটলেন স্থানীয় ডাক্তারের কাছে...একটাই আর্জি…"ছেলেকে বাঁচিয়ে দিন"। যোসেফের পায়ের ক্ষতর ড্রেসিং করলেন ডাক্তার। বললেন, "এই রোগের কোনো ওষুধ নেই...মৃত্যু আসবে দু' সপ্তাহের বা খুব জোর হলে একমাসের মধ্যে...ভবিতব্যকে মেনে নিন...তা ছাড়া কোনো উপায় নেই"।

কাঁদতে কাঁদতে ডাক্তারের হাতে পায়ে ধরলেন মাদাম মেইস্টার…"কিছু একটা করুন...কিছু একটা করে যোসেফকে বাঁচান"। একটু চিন্তা করলেন ডাক্তারবাবু...বললেন, "এখান থেকে একটু দূরে লুই পাস্তুর নামে কেমিস্ট্রির এক প্রফেসর থাকেন। শুনেছি তিনি জলাতঙ্ক রোগের টীকা আবিষ্কার করবার চেষ্টা করছেন। আপনি তাঁর সঙ্গে কথা বলুন"।

যোসেফকে কোলে নিয়ে ডাক্তারখানা থেকেই লুই পাস্তুরের বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটলেন মাদাম মেইস্টার। দেখা করলেন পাস্তুরের সঙ্গে। বললেন, "আমার একমাত্র ছেলে...যেভাবে হোক বাঁচান"।

মাদাম মেইস্টারকে অনেক বোঝালেন পাস্তুর। বললেন, "একথা সত্যি যে আমি জলাতঙ্কর টীকা আবিষ্কার করবার চেষ্টা করছি এবং আংশিক সাফল্যও পেয়েছি। এই টীকা তৈরী করেছি জলাতঙ্কতে ভুগতে থাকা কুকুরের স্পাইনাল

কর্ডের টিস্যুকে ফর্মালিন দিয়ে আংশিকভাবে অকেজো করে। এই টীকা কুকুরের দেহে প্রয়োগ করে সাফল্য পেয়েছি...এই টীকা কুকুরের শরীরে জলাতঙ্ক প্রতিরোধ করতে সক্ষম। কিন্তু মানুষের শরীরে এর প্রয়োগ এখনও করা হয়ে ওঠেনি...অর্থাৎ 'হিউম্যান ট্রায়াল' এখনও হয়নি। 'হিউম্যান ট্রায়াল' এ সফল হলে তবেই একমাত্র এই টীকা মানুষের শরীরে দেওয়ার উপযুক্ত বলে গণ্য হবে...তার আগে নয়"।

সব শুনে লুই পাস্তুরের সামনে যোসেফকে শুইয়ে দিলেন মাদাম মেইস্টার। বললেন, "ওর উপরেই 'হিউম্যান ট্রায়াল' করুন। ওকে পাগলা কুকুরে কামড়েছে...আজ না হোক কাল ও মরবেই...আপনার টীকার দৌলতে যদি বাঁচে!"

পাস্তুর পড়লেন আতান্তরে! একটা ন' বছরের বাচ্ছার উপর হিউম্যান ট্রায়াল! ওইটুকু শরীর কি এই মারাত্মক রোগের টীকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সহ্য করতে পারবে? যদি টীকা'র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্যই যোসেফ মারা যায়...নিজের অন্তরাত্মাকে কি জবাব দেবেন তিনি?

পাস্তুর পরামর্শ করলেন নিজের সহকারীদের সঙ্গে, কথা বললেন যোসেফের বাবার সঙ্গে। স্থির হলো...যোসেফের উপরেই প্রথম প্রয়োগ করা হবে পাস্তুরের তৈরী টীকা!

প্রয়োগ করা হল। পাস্তুর এবং তাঁর সহকর্মীদের নেকনজরে রইলো নয় বছরের যোসেফ। একদিন...দুদিন...কেটে গেলো তিরিশটা দিন...যোসেফের শরীরে জলাতঙ্কর কোনো লক্ষণ দেখা গেল না...হিউম্যান ট্রায়াল সাকসেসফুল...আবিষ্কার হল জলাতঙ্কর টীকা!

Person who saves one life saves the entire mankind। লুই পাস্তুরের আবিষ্কৃত ওই টীকা প্রয়োগ করে এর পরের প্রায় একশো বছর ধরে প্রাণ বাঁচানো হয়েছে কোটি কোটি মানুষের। কয়েক বছর আগে অবধি ওই টীকাই ভারত সরকার প্রত্যেক সরকারী হাসপাতালে সাপ্লাই করতো। বিজ্ঞান কখনও থেমে থাকে না। হিউম্যান ডিপ্লয়েড সেল কালচার ভ্যাকসিন বাজারে চলে আসার পরে পাস্তুরের তৈরী ভ্যাকসিনের ব্যবহার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু "ফাদার অফ মাইক্রোবায়োলজি" লুই পাস্তুরের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে এবং চিরদিন লেখা থাকবে...পথ প্রথমবার তিনিই দেখিয়েছিলেন।

যে বাড়িতে যোসেফের উপর এই হিউম্যান ট্রায়াল করা হয়েছিল...সেই বাড়ি আজ মহীরুহর আকার ধারণ করেছে...নাম "পাস্তুর ইনস্টিটিউট"...দেশ বিদেশের বিজ্ঞানীরা এই ইনস্টিটিউটে কাজ করার জন্য মুখিয়ে থাকেন।

কিন্তু সেই ন' বছরের যোসেফ মেইস্টার...তাঁর কি হলো? আপনি শুনলে অবাক হবেন...তিনি বেঁচেছিলেন পঁয়ষট্টি বছর বয়স অবধি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি ফ্রান্সের হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। যুদ্ধ থেকে ফেরার পরে লুই পাস্তুর যোসেফকে 'পাস্তুর ইনস্টিটিউট' এর কেয়ারটেকারের পদে বহাল করেন। আমৃত্যু তিনি 'পাস্তুর ইনস্টিটিউট' এর পাহারাদার ছিলেন।

১৯৪০ সাল...দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ফ্রান্স দখল করেছে জার্মানির নাৎসী বাহিনী...প্যারিস শহরে হত্যালীলা চলছে। পাস্তুর ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা পালিয়ে গেছেন...নিজের স্ত্রী সন্তানদের নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিয়ে পাস্তুর ইনস্টিটিউটের গেট আগলে বসে আছেন পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধ যোসেফ মেইস্টার! তিনি পালিয়ে যাননি...যে ইনস্টিটিউট একদিন তাঁর প্রাণ বাঁচিয়েছিল...নরপিশাচদের হাতে সেই ইনস্টিটিউটকে ছেড়ে যেতে তাঁর মন সায় দেয়নি।

বিশাল নাৎসী বাহিনী যখন পাস্তুর ইনস্টিটিউটের গেটের সামনে, অশক্ত শরীরে নিজের সার্ভিস রিভলবার তাঁদের দিকে তাক করলেন যোসেফ মেইস্টার…"স্টপ"। নাৎসীরা বৃদ্ধ যোসেফের উপর ফায়ার করলো না...রাইফেলের কুঁদোর ঘায়ে তাঁকে ধরাশায়ী করে বেধড়ক মারধোর করলো। মার খেতে খেতে যোসেফ শুনলেন যে তাঁর স্ত্রী সন্তানেরা নাৎসীদের হাতে ধরা পড়েছেন। ওই অবস্থাতেও তিনি নাৎসীদের অনুরোধ করেছিলেন...লুই পাস্তুরের সমাধিটা যেন নষ্ট না করা হয়…"He saved millions of lives"।

মার খেয়ে মৃতপ্রায় যোসেফ কোনোমতে বাড়ি ফিরলেন। বুঝলেন...তাঁর স্ত্রী সন্তানেরা বন্দী...পাস্তুর ইনস্টিটিউট নাৎসীদের কবলে। নিজের সার্ভিস রিভলবার নিজের কপালে

ঠেকিয়ে ট্রিগার টেনে দিলেন তিনি।

যোসেফের অনুরোধ মেনে নাৎসীরা পাস্তুরের সমাধি নষ্ট করেনি। যোসেফের স্ত্রী সন্তানরাও নাৎসীদের হাত এড়িয়ে শেষ অবধি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।

আজ সমগ্র পৃথিবী করোনা মহামারীর কবলে। এই ভাইরাসের মারন ক্ষমতা প্রায় ৩%। জলাতঙ্কর জন্য দায়ী রেবিস ভাইরাসের মারন ক্ষমতা কতো জানেন? ১০০%! একবার এই রোগ শিকড় গেড়ে বসলে কেউ বাঁচে না। সেই মৃত্যু বড় যন্ত্রণাদায়ক...বড় ভয়ংকর। লুই পাস্তুর নিজের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন দ্বারা সময়মত 'পোস্ট এক্সপোজার প্রোফাইল্যাক্সিস' এর মাধ্যমে এই ১০০% কে প্রায় ০% এ নামিয়ে এনেছিলেন! সেই পাস্তুর ইনস্টিটিউট আজও আছে। আমি নিশ্চিত...সেখানে দেশ বিদেশের বিজ্ঞানীরা আজও অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন করোনা'র ভ্যাকসিন তৈরী করবার জন্য। আমি নিশ্চিত...আজ না হোক কাল তাঁরা সফল হবেন।

তাই আশা ছাড়বেন না...ভেঙে পড়বেন না। আমরা মানুষ..."আশরাফুল মাখলুকাত"...পৃথিবীর সবচাইতে বুদ্ধিমান জীব...আমরা পারবো না তো আর কে পারবে? সফল আমরা হবোই হবো ইনশাআল্লাহ ।

আপাততঃ সবাই সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন,সৃষ্টিকর্তার আরাধনা করুন, জীবে দয়া করুন। সবার জন্য দোয়া শুভকামনা।

সংগৃহীত