ইসরাইলে যেভাবে ঢুকেছে হামাস

ইসরাইলে যেভাবে ঢুকেছে হামাস

ইসরাইলে যেভাবে ঢুকেছে হামাস

ঘটনার সময় বেশিরভাগ ইসরাইলি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। শনিবার দিনটি ইহুদিদের উৎসবের একটি দিন সাব্বাত ছিল। ওই দিনে ইসরাইলিরা বাড়িতে বসে পরিবারের সদস্যদের সাথে কাটানোর পরিকল্পনা করছিল। কেউ কেউ সিনাগগ কিংবা বন্ধু-বান্ধবদের সাথেও আড্ডা দিতে চেয়েছিল।কিন্তু ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে এক ঝাঁক রকেটের মুখোমুখি হয় তারা। যা ছিল একপ্রকার নজিরবিহীন।অনেক বছর ধরে ফিলিস্তিনের শহর গাজা থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পেরেছিল ইসরাইল। কিন্তু গত শনিবার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাদের ওই সুরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।

ঘটনার সূচনা হয়েছিল রকেট নিক্ষেপের মাধ্যমে
স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৬টার দিকে রকেট আসতে শুরু করে। প্রথম প্রথম ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের ছোড়া রকেট ইসরাইলের উন্নত আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ঠেকিয়ে দেয়া হতো। কিন্তু গত শনিবার খুব অল্প সময়ের মধ্যে হামাসের ছোড়া হাজার হাজার রকেট তা প্রতিহত করতে পারেনি।হামাস বলছে, প্রথম দফার তারা অন্তত পাঁচ হাজার রকেট ছুড়েছে। তবে ইসরাইলের দাবি, এই সংখ্যা অর্ধেক।গাজা থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে তেল আবিব ও পশ্চিম জেরুসালেমে রকেট ছোড়া হয়েছিল। ওই সময় সাইরেন বাজিয়ে সতর্ক করা হয়। ওই সময় ইসরাইলের বিভিন্ন শহর থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়।রকেট ছোড়ার পাশাপাশি গাজা সীমান্তে শক্তিশালী সীমানা প্রাচীর ভেঙে ইসরাইলে ঢুকে পড়ে হামাস যোদ্ধারা।

২০০৫ সালে গাজা থেকে সেটেলার ও সেনাদের প্রত্যাহার করেছিল ইসরাইল। কিন্তু তারপরেও সেখানকার আকাশ, সমুদ্র ও সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ ইসরাইলের হাতেই রয়েছে।এছাড়া গাজা সীমান্তে ইসরাইলি সেনারা নিয়মিত টহল দেয়। সীমান্তের কোথাও কোথাও কংক্রিটের দেয়াল, কোথাও আবার বেড়া রয়েছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ক্যামেরা ও সেন্সরও স্থাপন করা হয়েছে সেখানে। কিন্তু সব কিছু ফাঁকি দিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দফায় দফায় এসব সুরক্ষাব্যবস্থা ভেঙে ফেলে হামাস।

হামাস যেভাবে ইসরাইলে ঢুকে পড়ল?
কিছু কিছু হামাস যোদ্ধা বিকল্প উপায়ে সীমান্ত পার হয়েছেন। অনেকেই প্যারাগ্লাইডিং করে ইসরায়েলে ঢুকেছেন। আবার কেউ কেউ নৌকা নিয়ে ইসরাইলের ভেতরে প্রবেশ করেছেন।ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, তারা সৈকত দিয়ে দু’দফায় হামাসের অনুপ্রবেশের চেষ্টা ঠেকিয়ে দিয়েছে।

স্থানীয় সময় সকাল ৫টা ৫০ মিনিটে হামাসের সামরিক শাখা টেলিগ্রাম চ্যানেলে প্রথম ছবি প্রকাশ করে। স্থানটি ছিল গাজা ক্রসিংয়ের সর্বদক্ষিণে কেরেম শালম। ওই ছবিতে একটি চেকপোস্ট দিয়ে হামাস যোদ্ধাদের ইসরাইলে ঢুকতে দেখা গেছে। ওই সময় অন্তত দু’জন ইসরাইলি সেনার লাশ মাটিতে পড়ে ছিল।

আরেকটি ছবিতে দেখা গেছে, পাঁচটি মোটরসাইকেলে করে হামাস যোদ্ধারা কাটাতাঁরের বেড়া পার হয়ে ইসরাইলে প্রবেশ করছেন। জায়গাটি আগেই কেটে রাখা হয়েছিল। প্রতিটি মোটরসাইকেলে দুজন যোদ্ধা ছিলেন। তাদের কাঁধে রাইফেল দেখা গেছে। এক জায়গায় বুলডোজার দিয়ে বেড়া ভাঙতে দেখা গেছে। ওই সময় সেখানে কয়েক ডজন নিরস্ত্র মানুষ ছিল। বেড়া ভেঙে ফেলার পর খোলা জায়গা দিয়ে তারা দৌঁড়ে ইসরাইলে ঢুকে পড়েন।কেরেম শালম থেকে ৪৩.৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ইরেজ নামের গাজা ক্রসিংয় দিয়ে দল বেধে হামাস যোদ্ধারা ইসরাইলে প্রবেশ করেন।

হামাসের প্রচার শাখার একটি চ্যানেলে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, একটি কংক্রিটের প্রাচীর থেকে ধোঁয়া উড়ছে। যেকোনো হামলার আগেই ইসরাইলের ওই চেকপোস্ট থেকে বার্তা দেয়া হতো।ভিডিওতে দেখা গেছে, একদল যোদ্ধা বিস্ফোরণ স্থলের দিকে ছুটে যাচ্ছেন। রাইফেল হাতে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পড়া আটজন যোদ্ধাকে সেদিকে দৌঁড়ে যেতে দেখা যায়।একপর্যায়ে চেকপোস্টের দায়িত্বে থাকা ইসরাইলি সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছেন। এর কিছুক্ষণ পরে চেকপোস্টের মেঝেতে ইসরাইলি সেনাদের পড়ে থাকতে দেখা যায়।

হামাস যোদ্ধারা একটার পর একটা কক্ষ টার্গেট করেছিলেন। ভিডিও দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে তারা অত্যন্ত দক্ষ ও প্রশিক্ষিত।গাজায় সাতটি ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি ইসরাইল নিয়ন্ত্রণ করে। আর বাকি ক্রসিংয়ের নিয়ন্ত্রণ মিসরের হাতে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হামাস যোদ্ধারা ইসরাইলের ঢোকার রাস্তা বের করে ফেলেন।

ইসরাইলের অনেক ভেতরে হামলা চালানো হয়েছে
হামাস যোদ্ধারা গাজার সবগুলো ক্রসিং দিয়ে ইসরাইলে প্রবেশ করেছেন। ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জানা গেছে, তারা অন্তত ২৭টি স্থান থেকে হামলা চালিয়েছে। তারা চোখের সামনে যাকে পেয়েছে, তাকেই হত্যা করেছে।তারা গাজা থেকে সাড়ে ২২ কিলোমিটার দূরে ওফাকিম শহরেও হামলা করেছে।

গাজা থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে ইসরাইলের শহর এসদেরতে হামলা করেছে হামাস। একট পিকআপ-ট্রাকে করে শহর চষে বেড়িয়েছে তারা।ভেঙে ফেলা ইরেজ ক্রসিংয়ের উত্তরে অবস্থিত আশকেলন শহরের খালি রাস্তায় অন্তত এক ডজন যোদ্ধাদের ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে।

একই দৃশ্য দেখা গেছে ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলীয় বিভিন্ন শহরে। স্থানীয় বাসিন্দাদের ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেছে হামাস যোদ্ধারা।রেইম শহরের কাছে একটি সংগীত উৎসবে বন্দুকধারীরা গুলি চালায়। মরুভূমিতে আয়োজিত ওই সংগীত উৎসবে একদল তরুণ-তরুণী অংশ নিয়েছিল।এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছে যে কিভাবে অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত একটি ভ্যানে করে তিন ঘণ্টা হামাস যোদ্ধারা শহর চষে বেড়িয়েছে। এ সময় তারা হামলা করার জন্য ইসরাইলিদের খুঁজছিল।

সেনা ও সাধারণ মানুষকে জিম্মি করা হয়েছে
ইসরায়েল জানিয়েছে, ১০০ সেনা ও সাধারণ মানুষ অপহরণ করা হয়েছে।বেরি শহরের একটি ফুটেজে দেখা গেছে চার সাধারণ মানুষকে হামাস যোদ্ধারা ধরে নিয়ে যাচ্ছে।এছাড়া, অনলাইনে আরো অনেক ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। যেগুলোতে দেখা গেছে, গাজার ব্যস্ত সড়ক দিয়ে গুরুতর আহত ইসরাইলিদের হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।জিকিম ও রিমে দুটি সামরিক ঘাঁটিতেও হামলা করেছে হামাস।

রিম শহরের কাছের একট সামরিক ঘাঁটিতে হামলার ভিডিওতে দেখা গেছে, পুড়ে যাওয়া বেশ কিছু গাড়ি সড়কে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। গোলাগুলিতে কতজন আহত হয়েছে সেটি অবশ্য জানা যায়নি।এর কয়েক ঘণ্টা পরেই ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দেন, ‘আমরা যুদ্ধের মধ্যে আছি।’
সূত্র : বিবিসি