চীন-ভুটান বৈঠকের ওপরে কেন নজর রাখছে ভারত?

চীন-ভুটান বৈঠকের ওপরে কেন নজর রাখছে ভারত?

চীন-ভুটান বৈঠকের ওপরে কেন নজর রাখছে ভারত?

ভুটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চীন সফরে ওই দুই দেশ তাদের সীমানা নির্ধারণ নিয়ে অমীমাংসিত বিষয়গুলির সমাধানের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে জানা যাচ্ছে। একই সঙ্গে প্রথমবারের মতো কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের দিকেও এগোচ্ছে ওই দুটি দেশ।

সীমান্ত নিয়ে কীভাবে মীমাংসা হয় ভুটান আর চীনের মধ্যে, বিশেষত ডোকলাম নিয়ে তারা কী সিদ্ধান্ত নেয়, তার ওপরে সতর্ক নজর রাখছে ভারত।ভুটানের কোনও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এটাই প্রথম সরকারি চীন সফর।

চীনের সরকারি গণমাধ্যম শিনহুয়া জানিয়েছে যে ২০১৬ সালে থমকে যাওয়া সীমান্ত আলোচনা আবারও শুরু করতে চীনে গেছেন ভুটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী টান্ডি দোর্জি। তার সঙ্গে আছেন ভারতে নিযুক্ত ভুটানের রাষ্ট্রদূত অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ভি নামগয়াল।দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক যদি স্থাপিত হয়, তাহলে সেটা একটা নজির হয়ে থাকবে, কারণ জাতি সংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য, এমন কোনও দেশের সঙ্গেই কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই হিমালয়ের কোলে এই পার্বত্য রাষ্ট্রটির।

চীন, ভুটান 'চিরাচরিত বন্ধু'

চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ি-র সঙ্গে মি. দোর্জির সাক্ষাতকারের পরে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রক যে বিবৃতি দিয়েছে, তাতে মি. ওয়াংকে উদ্ধৃত করে লেখা হয়েছে, “চীন এবং ভুটান পর্বত আর নদীমালার মাধ্যমে সংযুক্ত এবং দুটি দেশের মধ্যে চিরাচরিত ভাবেই বন্ধুত্ব রয়েছে।““সীমানা নিষ্পত্তি এবং দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন হলে তা ভুটানের মৌলিক এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থরক্ষা করবে,” জানিয়েছেন মি. ওয়াং।

অন্যদিকে ভুটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. দোর্জিকে উদ্ধৃত করে চীনা সরকারি সংবাদ সংস্থা শিনহুয়া লিখেছে, “ভুটানকে সহায়তা দেওয়া ও তাকে মদত দেওয়ার জন্য চীনকে ধন্যবাদ দেন টাণ্ডি দোর্জি। তিনি এও বলেছেন যে ‘এক-চীন’ নীতিকে ভূটান জোরালো ভাবে সমর্থন করে।“সীমান্ত নিয়ে সমস্যাগুলির যাতে দ্রুত সমাধান করার যায় আর কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া যাতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সেই লক্ষ্যে ভুটান চীনের সঙ্গে যৌথ ভাবে উদ্যোগ নিয়ে আগ্রহী,” মি. দোর্জিকে উদ্ধৃত করে তাদের বিবৃতিতে জানিয়েছে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রক।

দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ ড. সঞ্জয় ভরদ্বাজ বলছিলেন যে ভুটান ও চীনের মধ্যে প্রায় ৭৬৪ বর্গ কিলোমিটার সীমানা এখনও অমীমাংসিত।তার কথায়, “সীমান্ত নিয়ে ভুটান ও চীন ১৯৮৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ২৪ দফা সীমান্ত আলোচনা চালিয়েছে আর এই সপ্তাহেরটিি ২৫ তম বৈঠক। বেশ কয়েকটি বিশেষজ্ঞ গোষ্ঠীরও বৈঠক হয়েছে।“

তবে ২০১৭ সালে ডোকলাম সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও চীনা পিপলস লিবারেশন আর্মি বা পিএলএ-র মধ্যে সংঘর্ষের পরে চীন-ভুটান সীমান্ত আলোচনা থমকে গিয়েছিল। এরমধ্যেই চীন ২০২০ সালে পূর্ব ভুটানের সাকতেং অভয়ারণ্যের ওপরেও দাবি জানায়। ভুটান সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিল।তারপরে এ বছরের শুরুতে একটি যৌথ কারিগরি দল সীমানা নির্ধারণ নিয়ে আলোচনায় বসেছিল প্রথমবারের মতো।তা থেকেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল যে দুটি দেশই সম্ভবত অমীমাংসিত সীমান্ত এলাকাগুলি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে আন্তরিকভাবেই এগোতে চাইছে।

ডোকলাম নিয়ে কেন বিতর্ক?

ভারত, ভুটান আর চীন এই তিনটি দেশের সীমান্তে অবস্থিত একটা সরু মালভূমি এই ডোকলাম।ভারত আর ভুটান, দুই দেশই দাবি করে যে এই মালভূমিটি ভূটানের অংশ।এই অঞ্চল নিয়ে আগে কোনও বিতর্ক না থাকলেও ১৯৬২-র ভারত-চীন যুদ্ধের পর থেকেই চীন দাবি করেিআসছে যে ডোকলাম তাদের এলাকা।

তারা ওই অঞ্চলে একটি রাস্তা তৈরির কাজ চালাচ্ছিল ২০১৭ সালে, তখনই ভুটানের রাজকীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা চীনা বাহিনীকে বাধা দেয়।এর দুদিন পরে ভুটানের আর্জিতে সাড়া দিয়ে ভারতীয় বাহিনী অস্ত্র আর বুলডোজার নিয়ে সেখানে হাজির হয়।দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে ডোকলাম নিয়ে চীনের সঙ্গে ভুটান আর ভারতের বিবাদ চলেছিল।

ডোকলাম যে কারণে ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ

ডোকলাম এলাকাটি যদিও ভুটানের বলেই দাবী করে থিম্পু আর দিল্লি, কিন্তু তা ভারতের কাছেও সামরিক কৌশলগত কারণে অতি গুরুত্বপূর্ণ।সেখানে যে কোনও ধরণের চীনা হস্তক্ষেপের ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে দেশের বাকি অংশের যোগাযোগ যে ‘শিলিগুড়ি করিডোর’ বা ‘চিকেন নেক’-এর মাধ্যমে, তার অনেক কাছাকাছি এসে পড়বে চীনা পিএলএ।

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজ বলছিলেন, “চিকেন নেক ভারতের সামরিক বাহিনীর কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ কারণ মাত্র ২৭ কিলোমিটার চওড়া ওই জায়গাটি দিয়েই উত্তরপূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখা হয়।“সেখান দিয়ে যেমন সমরাস্ত্র এবং বাহিনী চলাচল করে, তেমনই উত্তরপূর্বাঞ্চলের বেসামরিক নাগরিকদের কাছেও দেশের অন্য অঞ্চল থেকে রসদ পৌঁছয়,” বলছিলেন মি. ভরদ্বাজ।ভারতের জাতীয় দৈনিকগুলি বুধবার লিখেছে যে, সে কারণেই চীন-ভুটান সীমান্ত বৈঠকের ওপরে নজর রাখছে ভারত।

দিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনও আনুষ্ঠানিক কোনও বিবৃতি দেয় নি, তবে মন্ত্রকের সূত্রগুলি উদ্ধৃত করে জাতীয় সংবাদপত্রগুলি লিখেছে যে চীন আর ভুটানের মধ্যে অমীমাংসিত সীমান্তগুলির মধ্যে যেহেতু ডোকলামও আছে, তাই এটা খুবই স্বাভাবিক যে এই আলোচনার ওপরে ভারতের নজর থাকবে।সংবাদমাধ্যমে লেখা হচ্ছে যে ভারত-চীন-ভুটানের ত্রি-সীমানা বাদ দিয়ে বাকি ডোকলাম মালভূমির ওপরে যদি চীনকে নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দেয় ভূটান, তাহলে তা কৌশলগত দিক থেকে ভারতের বিপক্ষে যাবে।

কিন্তু অধ্যাপক ভরদ্বাজ বলছিলেন যে তিনি মনে করেন না যে ভুটান এমন কিছু করবে যা ভারতের বিপক্ষে যাবে।তার কথায়, “ভুটানের সঙ্গে ভারতের যে সম্পর্ক, তাতে আমার দৃঢ় ধারণা চীনের সঙ্গে সীমান্ত বিবাদ মেটাতে গিয়ে এমন কিছু তারা করবে না যা ভারতের বিপক্ষে যেতে পারে।""কারণ এটা ভুটান ভাল করেই জানে যে শিলিগুড়ি করিডোর সমর-কৌশলগত দিক থেকে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভারতের কাছে!“, মন্তব্য ড: ভরদ্বাজের।

সূত্র : বিবিসি