স্থাপত্যশিল্পের অনন্য নিদর্শন, শতবর্ষী রংপুর জেলা পরিষদ ভবন

স্থাপত্যশিল্পের অনন্য নিদর্শন, শতবর্ষী রংপুর জেলা পরিষদ ভবন

সংগৃহীত

রংপুর জেলা পরিষদ ভবন দেশের ৬১টি জেলা পরিষদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন। প্রায় ১০৮ বছর আগে ভবনটি নির্মিত হয়। এমন জেলা পরিষদ ভবন দেশের আর কোথাও নেই। এর দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ ও আভিজাত্য নির্ভর শিল্পশৈলী চোখে পড়ার মতো। ভবনটি ইন্দোস্যারানিক আদলে নির্মিত স্থাপত্যশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন। যা বাংলার সমৃদ্ধশালী ইতিহাস মোঘলীয় নির্মাণ কৌশলকে মনে করিয়ে দেয়। এটি মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের পরিচায়কও বটে। দূর থেকে নজর কাড়ে দর্শনার্থীদের।

ইতিহাস থেকে জানা গেছে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার এদেশের শাসন ব্যবস্থায় স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনুভব করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কয়েক দফায় আইনের পরিবর্তন করা হয়। স্থানীয় সরকার আইনের ভিত্তিতে তিন স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান প্রবর্তন করা হয়। প্রত্যেক জেলায় গঠিত হয় জেলা পরিষদ বা ডিস্ট্রিক বোর্ড। সেই ধারাবাহিকতায় ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় রংপুর জেলা পরিষদ। আর এই অবকাঠামো গড়ে উঠে ১৯১৫ সালে।

শতবর্ষী এই জেলা পরিষদ ভবন চত্বরে রয়েছে একটি বিদ্যুৎ আদালত ও কম্পিউটার আলো নামে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। রয়েছে নামাজ আদায়ের জন্য একটি মসজিদও। প্রতিদিন স্থানীয়রা ছাড়াও দূর-দূরান্ত থেকে আসা অনেকেই একটু সময়ের জন্য গাছগাছালি ভরা সবুজে ঘেরা জেলা পরিষদ চত্বরে ঘুরতে আসেন। পাখির কিচিরমিচির ডাক আর সাদা মেঘের সাথে মিশে থাকা উঁচু মিনারগুলোতে খুঁজে পায় তৃপ্তি।

দুই সন্তানকে নিয়ে জেলা পরিষদ চত্বরে ঘুরতে দেখা যায়, এক নারীকে। তিনি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার গজঘণ্টা এলাকা থেকে এসেছেন। সুলতানা জেরিন নামে এই দর্শনার্থী বলেন, এখানকার পরিবেশটা ভালো। দেখতেও ভালো লাগে। সবমিলিয়ে অনেক সুন্দর ও দর্শনীয় স্থান। আমরা রংপুর শহরে কোনো কাজে এলেই ছেলে-মেয়েদের নিয়ে এখানে ঘুরে যাই। ছবি তুলি, ভিডিও করে রাখি।

তিনি আরও বলেন, দূর থেকে জেলা পরিষদের ফটক দেখলেই যে কারো মন চাইবে ভেতরটা একটু ঘুরে দেখতে। এটা দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় ভবন। জেলা পরিষদ চত্বরে দর্শনার্থীদের জন্য বসার ব্যবস্থা করা দরকার। এটা হলে সেবা নিতে আসা লোকজনও উপকৃত হবেন।  

বিপ্লব হোসেন নামে আরেক দর্শনার্থী বলেন, রংপুর জেলা পরিষদ ভবন এই বিভাগের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। আমরা সময় পেলেই ঘুরতে আসি। ভবনের মিনারগুলোর দিকে তাকালেই ভালো লাগে। চোখের সামনে প্রাচীন ঐতিহ্যময় ভবনগুলোর ছবি ও কারুকার্য ভেসে ওঠে। রংপুর ছাড়াও দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন এখানে ঘুরতে আসেন।

ইকবাল সুমন নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, আমরা চাই নান্দনিক এই স্থাপনাটি যাতে কালের বিবর্তনে হারিয়ে না যায়। স্থাপত্যশিল্পের এই অনন্য নিদর্শনকে টিকিয়ে রাখতে এবং পর্যটকের আকর্ষণ বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। শহরের প্রাণকেন্দ্রে জেলা পরিষদ ভবন, এ কারণে হঠাৎ করে কারো চোখে পড়লেই এটা দেখার ইচ্ছে জাগে। যদি কর্তৃপক্ষ এই ভবন চত্বরকে দর্শনার্থী উপযোগী করে তুলতে পারে তবে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের জানান আগ্রহ বাড়বে।    

বেলা গড়িয়ে বিকেল হলে গাছগাছালির নিচে অনেকেই আসেন পাখপাখালির কলতান উপভোগ করতে। আর সন্ধ্যার আকাশে দিনের আলো হারিয়ে গেলে রঙিন বাতিতে বদলে যায় জেলা পরিষদের রূপলাবণ্য। আলো আঁধারে আকর্ষণ বাড়ানো ভবনটি কাছে টানে দর্শনার্থীদের। বিশেষ করে জাতীয় দিবসগুলো মনোমুগ্ধকর আলোকসজ্জা দেখতে জেলা পরিষদ ভবন চত্বরে থাকে উপচে পড়া ভিড়। শত শত মানুষ আসে সেখানে নিজেকে আলোকসজ্জাময় শতবর্ষী ভবনের সঙ্গে স্মৃতিবন্দি করে রাখতে।

স্থানীয় মুলাটোল এলাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর কবির বলেন, আমাদের এই বিভাগীয় শহরে রংপুর জেলা পরিষদ ভবনটি একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা। এখানকার পরিবেশ দিনে একরকম, রাতে আরেকরকম। শতবর্ষী এই ভবনটাতেই যাত্রা শুরু করেছিল উপমহাদেশের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কারমাইকেল কলেজ। ১৯১৬ সালে কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ১৯১৮ সালে মূল ক্যাম্পাসে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই ভবনেই চলেছে কারমাইকেল কলেজের সকল কর্মকাণ্ড।

জেলা পরিষদের ভিতরে আবাসিকের বাসিন্দা আবদুল আউয়াল জানান, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ বিভিন্ন জাতীয় দিবসের আগের এবং পরের রাতে এখানে দর্শনার্থীদের ভিড় থাকে। ছোটবড় বিভিন্ন বয়সী মানুষের পদচারণায় জেলা পরিষদ ভবন এলাকা মুখরিত হয়ে উঠে। আলোকসজ্জা যতদিন থাকে ততদিন রাত অব্দি মানুষের ভিড় আনাগোনায় একটা অন্যরকম আবহ তৈরি হয়।

যথাযথ সংস্কার ও সংরক্ষণ সম্ভব হলে ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ শতবছরের এই ভবনটি বেঁচে থাকবে নতুন প্রজন্মের চোখে। এমনটাই মনে করছেন সাবেক ছাত্রনেতা ও ইতিহাস সংরক্ষক রিয়াদ আনোয়ার শুভ।

তিনি জানান, অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপত্যশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন রংপুরের জেলা পরিষদ ভবন। নগরীর প্রায় কেন্দ্রস্থলে শহীদ জররেজ সরণীর (মূল সড়ক) পাশে ৪.৬৬ একর জমির উপরে প্রতিষ্ঠিত মূল ভবনের পরিমাপ ২০০ ফিট x ৬৭ ফিট। ভবনটি ইন্দোস্যারানিক আদলে নির্মিত স্থাপত্যশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন, যা বাংলার সমৃদ্ধশালী ইতিহাস মোঘলীয় নির্মাণ কৌশলকে মনে করিয়ে দেয়। এই ভবনের নকশা এবং কারমাইকেল কলেজের মূল ভবনের নকশার মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। কারমাইকেল কলেজের মূল ভবনের মতো জেলা পরিষদ ভবনেও রয়েছে ৩টি গম্বুজ। যা মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের পরিচায়ক।

শুভ আরও জানান, জেলা পরিষদ ভবনে কার্নিশের সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে মারলন অলংকরণের কারুকাজ সন্নিবেশিত হয়েছে। এছাড়া রয়েছে ভবনটির চার দিকে বারান্দা এবং উত্তর দিকে বিস্তীর্ণ বাগান। সব মিলিয়ে ইন্দোস্যারানিক স্থাপত্য সৌকর্যের এক অপূর্ব নিদর্শন ভবনটি একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্য কীর্তি। যা পর্যটকদের প্রথম দর্শনেই সচকিত করে তুলতে যথেষ্ট।

বর্তমান সরকারের উন্নয়ন ধারাবাহিকতায় জেলা পরিষদ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাই শতবর্ষী এই ভবনকে আরও দৃষ্টিনন্দন করার কথা জানিয়ে বর্তমান চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোছাদ্দেক হোসেন বাবলু বলেন, সারাদেশে ৬১টি জেলা পরিষদের মধ্যে এটিই একমাত্র ভবন, যেটি শুধু রংপুরে আছে। এমন অনিন্দ্য সুন্দর জেলা পরিষদ ভবনের নিদর্শন অন্য কোথাও নেই। এখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে দর্শনার্থীরা আসছেন। সেবাপ্রত্যাশী মানুষসহ দর্শনার্থী ও পর্যটকদের কাছে এই ভবনকে আরও সুন্দরভাবে তুলে ধরতে আমরা চেষ্টা করছি।