ঘুষের ভয়াবহ পরিণতি

ঘুষের ভয়াবহ পরিণতি

সংগৃহীত

ঘুষ একটি অন্যায় কাজ- একথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন। অথচ দুঃখজনক যে, এটি দেশের সর্বত্র বহাল তবিয়তে চালু রয়েছে। এতে একজনের প্রাপ্তি এবং অন্যজনের ক্ষতি ও মনঃকষ্ট, মানুষে মানুষে ঘৃণা, ক্ষোভ, আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা ইত্যাদি নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে পুরো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ক্রমে বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হয়। অপরদিকে সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ অখুশি হন। এর অশুভ পরিণতি এক সময় নিজের ওপর ও পরবর্তী প্রজন্মের ওপর বর্তায়। তাই স্বভাবতই এর নগ্ন চেহারা ও অশুভ পরিণতি নিয়ে আলোচনা এখন খুবই প্রাসঙ্গিক এবং সময়ের অনিবার্য দাবি।

ঘুষের প্রকৃতি: সাধারণভাবে ঘুষের প্রকৃতি ও পরিচয় প্রায় সবারই জানা। কিন্তু এর সবচেয়ে বড় জাদুকরি দিক হলো- এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কেউই এটিকে ঘুষ বলতে চান না। তারা বরং এটিকে ৫%, ১০% অফিস খরচ, বখশিশ, চা-মিষ্টি, হাদিয়া এসব নামে অভিহিত করতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। একেকটি অফিস বা প্রতিষ্ঠানে এক এক নামে এটি পরিচিত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, নাম বদল করে তারা এ অপরাধকে কিছুটা হালকাভাবে দেখতে চান। এজন্যই বুঝি ওমর বিন আব্দুল আজিজ (রহ.) বলেছিলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে উপঢৌকন হাদিয়া ছিল। আর এখন তা ঘুষ।’ (বুখারি, অনুচ্ছেদ-১৭)

কিন্তু ওহির জ্ঞানের ফায়ছালার দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে একজন কর্মচারী কিছু মাল এনে বলল, এটা আপনাদের (সরকারি) মাল, আর এটা আমাকে দেয়া হাদিয়া। রাসুলুল্লাহ (সা.) এতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, সে তার বাবা-মার ঘরে বসে থাকল না কেন, তখন সে দেখতে পেত, তাকে কেউ হাদিয়া দেয় কি না? (বুখারি: ২৫৯৭)

 

তঃপর নবী (সা.)-এর মন্দ দিক তুলে ধরে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেন। এ থেকে বোঝা যায়, যত সুন্দর নামেই এর নামকরণ করা হোক কিংবা জনগণ খুশি হয়ে প্রদান করুক অথবা কাজের বিনিময় হিসেবে দিয়ে থাকুক, অর্পিত দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে বেতন-ভাতা বাদে অন্যের কাছ থেকে যে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করা হয় তার সবই ঘুষ এবং অন্যায়। এতে একপক্ষ অধিক লাভবান হয় এবং অন্যপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা ইসলাম ও সাধারণ বিবেক কোনটিই সমর্থন করে না।

আপাতদৃষ্টিতে ঘুষকে একটিমাত্র অপরাধ মনে করা হলেও বস্তুত এটি বিভিন্ন পথ ও পন্থায় অসংখ্য অপরাধের দায়ে ঘুষখোরকে অভিযুক্ত করে কীভাবে তার ধ্বংস সুনিশ্চিত করে তা বোঝা যায় পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ থেকে।

 

লুমের দায়ে অভিযুক্ত: ঘুষের মাধ্যমে অন্যের প্রতি আর্থিক ও মানসিক জুলুম করা হয় বলে ঘুষখোররা জালেম হিসেবে অপরাধী। জুলুমের শাস্তি সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, ‘কেবল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে, যারা মানুষের প্রতি জুলুম করে এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করে বেড়ায়। তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।’ (সুরা শূরা: ৪২)।

হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহ বলেন, ‘হে আমার বান্দারা! আমি আমার নিজের জন্য জুলুমকে হারাম করেছি এবং তোমাদের মধ্যেও সেটিকে হারাম গণ্য করেছি। সুতরাং তোমরা পরস্পর জুলুম করো না।’ (মুসলিম: ২৫৭৭)

 

ষখোর হারাম ভক্ষণকারী হিসেবে শাস্তিযোগ্য: এরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না।’ (সুরা বাকারা: ১৮৮)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা অন্যায়ভাবে আল্লাহর সম্পদ আত্মসাৎ করবে, কিয়ামতের দিন তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে জাহান্নাম।’ (বুখারি: ৩৯৯৫) তিনি আরও বলেন, ‘হারাম খাদ্য দ্বারা গঠিত শরীর জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মিশকাত: ২৭৮৭)

আমানতের খিয়ানতকারী: রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি যাকে ভাতা দিয়ে কোনো কাজের দায়িত্ব প্রদান করেছি, সে যদি ভাতা ব্যতীত অন্য কিছু গ্রহণ করে তাহলে তা হবে আমানতের খিয়ানত।’ (আবু দাউদ: ২৯৪৩) আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমানতের খিয়ানতকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আনফাল: ৫৮)

আমানতের খিয়ানত মুনাফিকের অন্যতম আলামত।’ (বুখারি: ৩৩) আর মুনাফিকের শাস্তি জাহান্নাম। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করবে। আর তুমি তাদের কোনো সাহায্যকারী পাবে না।’ (সুরা নিসা: ১৪৫)

ঘুষখোররা সুদের মতো মারাত্মক গুনাহের অভিযোগে অভিযুক্ত ও দণ্ডনীয়: রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কারও জন্য কোনো সুপারিশ করল এবং সেই সুপারিশের প্রতিদানস্বরূপ সে তাকে কিছু উপহার দিল ও সে তা গ্রহণ করল, তবে সে সুদের দরজাসমূহের একটি বড় দরজায় উপস্থিত হলো।’ (আবু দাউদ: ৩৭৫৭)

তিনি আরও বলেন, ‘সুদের ৭০টি গুনাহের স্তর রয়েছে। তার মধ্যে নিম্নতম স্তর হচ্ছে আপন মাতার সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া।’ (ইবনু মাজাহ: ২৮২৬) রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি যদি এক দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) সুদ জ্ঞাতসারে গ্রহণ করে, তাতে তার পাপ ৩৬ বার ব্যভিচার করার চেয়েও অনেক বেশি হয়।’ (আহমাদ: ২৮২৫)

ঘুষখোর জালেমরা নিরীহ মজলুমদের বদদোয়ার শিকার: রাসুল (সা.) বলেন, ‘তুমি মজলুমের বদদোয়া থেকে বেঁচে থাকো। কেননা মজলুমের বদদোয়া ও আল্লাহর মাঝে কোনো পর্দা নেই।’ (বুখারি: ১৭৭২) অর্থাৎ মজলুমের দোয়া ব্যর্থ হয় না। তাছাড়া কিয়ামতের দিন অন্যের সম্পদ ভক্ষণকারী জালিমের কাছ থেকে তার নেকি থেকে মজলুমের বদলা পরিশোধ করা হবে। নেকি শেষ হয়ে গেলে মজলুমের পাপ জালিমের ওপর চাপানো হবে। পরিশেষে তাকে নিঃস্ব অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (বুখারি: ৫১২৬)

ঘুষ লেনদেনকারীরা রাসুল (সা.) কর্তৃক অভিশপ্ত: রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘুষ গ্রহীতা ও ঘুষ দাতার ওপর লানত বা অভিশাপ করেছেন।’ (ইবনু মাজাহ: ৩৭৫৩)

ঘুষ কিয়ামতের দিন বিপদের বোঝা হয়ে ঘুষখোরের কাঁধেই চেপে বসবে: রাসুলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত জনৈক কর্মচারীর হাদিয়া গ্রহণের কথা শুনে এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ! সদকার মাল থেকে স্বল্প পরিমাণও যে আত্মসাৎ করবে, সে তা কাঁধে নিয়ে কিয়ামত দিবসে উপস্থিত হবে। সেটা উট হলে তার আওয়াজ করবে, গাভী হলে হাম্বা হাম্বা শব্দ করবে এবং বকরী হলে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করতে থাকবে।’ (বুখারি: ২৫৯৭)

ঘুষখোররা ইবাদত ও দান-খয়রাত করেও ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত: রাসুলুল্লাহ (সা.) দীর্ঘ সফরে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত, ধুলামলিন এলোকেশে ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে বলেন, সে আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করছে, ‘হে আমার প্রতিপালক! হে আমার প্রতিপালক! অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম। আর তার দেহও হারাম উপার্জন দ্বারা গঠিত। তার প্রার্থনা কবুল হবে কীভাবে?’ (মুসলিম: ২৭৬০) অর্থাৎ হারাম ভক্ষণ করায় তার প্রার্থনা কবুল হবে না যদিও মুসাফিরের প্রার্থনা সাধারণত কবুল হয়ে থাকে।

পরিশেষে আমরা শুধু এতটুকু বলতে চাই, ঘুষ মোটেও কোনো সাধারণ অপরাধ নয়। বরং এটি অনেক বড় বড় অপকর্মের জন্মদাতা, মানবাত্মার সর্বনাশ সাধনকারী অসংখ্য গুনাহের সমষ্টি এবং জান্নাত লাভের অন্যতম প্রতিবন্ধক।