গাজায় এক মায়ের সন্তান জন্মের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা

গাজায় এক মায়ের সন্তান জন্মের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা

শিশু তালিয়া ২০২৩ সালের ১৩ অক্টোবর গাজায় জন্মগ্রহণ করে

এক মাস আগে গাজার বাসিন্দা জুমানা এমাদ গর্ভাবস্থার শেষ পর্যায়ে ছিলেন। আনন্দের সাথে সন্তান জন্মের অপেক্ষায় থাকা এই মা তার গর্ভাবস্থার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও শেয়ার করেছিলেন।তিনি জানতেন তার একটি মেয়ে হবে। তার স্বামী অনাগত সন্তানের জন্য অধীর অপেক্ষায় ছিলেন, হাসপাতালের ব্যাগ তৈরি ছিল আর তাদের চার বছরের মেয়ে তুলিনের ছোট বোনের সাথে দেখা করার তর সইছিল না।কিন্তু এরপরই সব বদলে গেল!

৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামলা চালায় হামাস। জবাবে গাজায় ইসরাইলের পাল্টা বিমান হামলায় এখন পর্যন্ত আট হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।‘আমি ভয়ে ছিলাম,’ বিবিসিকে বলেন জুমানা। ‘টানা গোলাগুলির মধ্যেই আমার প্রসব যন্ত্রণা ওঠে।’গাজার উত্তরাঞ্চল ছেড়ে যাওয়ার ইসরাইলি নির্দেশনা মেনে বাড়ি ছাড়েন ২৫ বছর বয়সী এই ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।

ইসরাইলের হামলা শুরুর দুই দিন পর তিনি গাজা শহর ছেড়ে দক্ষিণ দিকে চলে যান।ভীত ও নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা জুমানা তার মেয়েকে এক আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়ে যান। সাথে নেন মেয়ের জন্য কেবল একটা কাপড়, এক প্যাকেট দুধ আর একটা ছোট ব্যাগ।ভয়েস ম্যাসেজে তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি কঠিন ছিল।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা রাতে ঘুমাইনি। সেখানে প্রচুর গোলাবর্ষণ হওয়ায় আমাদের অন্য জায়গায় যেতে হয়েছিল। আমার মতো গর্ভবতী নারীদের হাঁটতে বের হওয়া উচিত কিন্তু যুদ্ধের কারণে আমরা খাবার কিনতেও বাইরে যেতে পারছি না।’এই কঠিন পরিস্থিতিতে সন্তান জন্ম দেয়া নিয়ে ভয় আর উদ্বেগের পাশাপাশি বার বার বিদ্যুৎ চলে যাওয়া, ইন্টারনেট বিঘ্নিত হওয়া ও পানি স্বল্পতার কথা বলেছিলেন জুমানা।১৩ অক্টোবর শুক্রবার জুমানার প্রসব বেদনা শুরু হয়।

তার পরিকল্পনা ছিল গাজা শহরের একটি বড় হাসপাতাল আল-শিফায় যাওয়ার। কিন্তু তাকে জানানো হয় যে হাসপাতালের অবস্থা খুবই কঠিন। তার পরিবর্তে গাজা উপত্যকার মাঝখানে নুসেইরাতের একটি ছোট হাসপাতাল আল-আওদায় যান জুমানা।কিন্তু সেখানে পৌঁছানোও কঠিন ছিল। প্রসব যন্ত্রণার মধ্যে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাউকে খুঁজে পেতেও হিমশিম খাচ্ছিলেন জুমানা। ‘ট্যাক্সি চালকরা ভীত ছিলেন আর মা হতে যাওয়া একজন নারীর জন্য অ্যাম্বুলেন্সও ছিল না,’ বলেন তিনি।প্রসব বেদনার সময়টিকে কঠোর ও ভয়ঙ্কর হিসেবে বর্ণনা করেন জুমানা।

‘হাসপাতালের পাশের একটি বাড়িতে তীব্র গোলাবর্ষণ হচ্ছিল আর সেই শব্দ এতটাই জোরে ছিল যে আমি ভেবেছিলাম গোলাগুলি হাসপাতালেই হচ্ছিল। অনবরত আহত মানুষরা আসছিল। আমি চারদিক থেকে চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি আমার বড় মেয়ের কথাও ভাবছিলাম। সে আমার থেকে দূরে থাকায় তাকে নিয়ে চিন্তিত ছিলাম।’‘আমি কেবল ভেবেছিলাম, যাই হোক না কেন আমি আমার সন্তানকে জন্ম দিতে চাই।’সেদিনই সন্ধ্যার কয়েক ঘণ্টা পর একটি কন্যা সন্তান জন্ম দেন জুমানা। তিনি তার নাম রাখেন তালিয়া। সেই সময়ের অনুভূতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ওর কান্না শুনে মনে হচ্ছিল তখনো আমরা সবাই বেঁচে আছি।’

প্রসবের পরপরই জুমানার জন্য কোনো বিছানা পাওয়া যায়নি। ব্যথা ও রক্তপাতের মধ্যেই তাকে একটি বিছানা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছিল।‘আমি ভাগ্যবান ছিলাম যে আমার জন্য একটি বিছানা পাওয়া গিয়েছিল, অন্য নারীরা সন্তান জন্ম দেয়ার পর হাসপাতালের করিডোরের সোফা আর মেঝেতে শুয়েছিল,’ বলেন তিনি।

জাতিসঙ্ঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) অনুমান মতে, গাজায় প্রায় ৫০ হাজার গর্ভবতী নারী রয়েছে যাদের মধ্যে সাড়ে পাঁচ হাজার নারী আগামী ৩০ দিনের মধ্যে সন্তান প্রসব করবে।সংস্থাটি বলেছে, হাসপাতালগুলোতে প্রচুর ভিড় আর ওষুধ ও মৌলিক সরবরাহও শেষ হয়ে যাচ্ছে।সন্তান জন্ম দেয়ার পরদিন জুমানা একটি ভিডিও পাঠান, যেখানে দেখা যায় ট্যাক্সির ভেতরে সাদা কম্বলে মোড়ানো শিশুকন্যাকে নিয়ে তিনি বসে আছেন।

হাসপাতাল ছেড়ে পরিবারের কাছে যাওয়ার সময়ও খুব কঠিন ছিল।‘বিদ্যুৎ না থাকায় লিফটটি কাজ করছিল না,’ বলেন তিনি। ফলে বের হওয়ার জন্য প্রসবের পরে ব্যথা নিয়েই সন্তানকে কোলে করে হাসপাতালের চারতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে হয়।হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পর বাড়ি ফিরতে গাড়ি পেতেও তাকে বেগ পেতে হয়।

‘আমরা এক ঘণ্টা ধরে ট্যাক্সি খুঁজেছি। কিন্তু কোনো ড্রাইভারই আমাদের নিতে রাজি হয়নি। সকালে কাছাকাছি জায়গাতেই গোলাগুলি হওয়ায় তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা একজনকে পেয়েছিলাম, কিন্তু তিনি ভাড়া বেশি চেয়েছিলেন আর আমাদের বাড়ির সামনেও নামাননি।’জুমানা বলেন যে এমন কঠিন পরিস্থিতিতে সন্তান প্রসব তার ক্ষতি করেছে।‘আমি মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমার আর কিছু করার ইচ্ছা নেই,’ বলেন তিনি।কিন্তু শিশু তালিয়া ভালো আছে বলে জানান তিনি। ‘ও আমার, ওর বাবা আর বোনের মিশ্র চেহারা পেয়েছে।’

‘যুদ্ধ যদি না থাকত ওর জন্মের এক সপ্তাহ পর সুন্দর অনুষ্ঠান আয়োজন করতাম। আমার পরিবারের সবাইকে আমন্ত্রণ জানাতাম আর তার আকীকা করতাম,’ বলতে বলতে চুপ হয়ে যান জুমানা।তিনি জানেন না তার পরিবারের জন্য কী ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। তবে সন্তানের জন্য তিনি কৃতজ্ঞ, ‘যুদ্ধ আর মৃত্যুর এই জীবনে সেই আমার আশা।’

সূত্র : বিবিসি