এলাকা-আয় ভেদে বিদ্যুৎ ও পানির দাম নির্ধারণের প্রস্তাব কী কার্যকর হবে?

এলাকা-আয় ভেদে বিদ্যুৎ ও পানির দাম নির্ধারণের প্রস্তাব কী কার্যকর হবে?

এলাকা-আয় ভেদে বিদ্যুৎ ও পানির দাম নির্ধারণের প্রস্তাব কী কার্যকর হবে?

বিদ্যুৎ ও পানির বিল এলাকা, পরিবার বা আয়ের ওপর ভিত্তি করে আলাদা আলাদা নির্ধারণ হবে এক মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর দেশজুড়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।

মহানগর বা গ্রামীণ এলাকায় সেবাদাতা কোম্পানির ধরন অনুযায়ী বিদ্যুৎ ও পানির সেবামূল্যে সামান্য পার্থক্য থাকে। কিন্তু সরকার থেকে বলা হচ্ছে, এখন এসব সেবার মূল্য আয় অনুযায়ী নির্ধারণ করা হবে।বৃহস্পতিবার একনেক সভাশেষে সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, ‘সরকার বিদ্যুৎ ও পানিতে সাবসিডি দেয় আর সেটার সুবিধা সবাই ভোগ করে। কিন্তু সেটা যুক্তিসঙ্গত নয়। সাবসিডি থেকে সরে আসতে হবে, এজন্য এলাকা, আয় ও পরিবার অনুযায়ী বিল নির্ধারণ করতে হবে।’

সরকার গত কয়েক বছর ধরেই এলাকাভিত্তিক বিদ্যুৎ-পানির মতো জরুরি সেবার দাম নির্ধারণের কথা বলে আসছে। অর্থাৎ যেসব এলাকার মানুষের আয় বেশি তাদের বিলও বেশি আসবে। আর যেসব এলাকায় নিম্নআয়ের মানুষ বেশি সেসব এলাকাও বিলও হবে কম।কিন্তু কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ-ক্যাব মনে করে, এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশে এই পণ্যগুলোর দাম এমনিতেই অনেক বেশি। সেটা আগে কমিয়ে তারপর ট্যারিফ ঠিক করা যেতে পারে।

সরকার কী বলছে?
বৃহস্পতিবার ছিল বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে শেষ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক।

বৈঠকের এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুৎ ও পানির ভর্তুকি থেকে ধীরে ধীরে সরে আসার নির্দেশনা দেন। তার পরামর্শ হলো, আয় অনুযায়ী এলাকাভিত্তিক বিদ্যুৎ ও পানির দাম নির্ধারণ করা।বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে সেটাই জানিয়ে দেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান। ‘আমাদের ভর্তুকি থেকে সরে আসতে হবে।’

তিনি জানান, সাবসিডির উপকার সবাই ভোগ করে। তিনি নিজেও সাবসিডির উপকার ভোগ করেন, আবার ক্লিনার যে (মন্ত্রীর) আবাসিক এলাকায় বসবাস করে, সেও একই রেটে নিচ্ছে। এটা তিনি (প্রধানমন্ত্রী) মনে করেন সঙ্গত নয়। এটাকে আমরা এরিয়াভিত্তিক, পরিবারভিত্তিক, আয়ভিত্তিক করে আমাদের চার্জ ধারণ করতে হবে।এর আগেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন প্রস্তাবের কথা বলেছেন।তবে একেক এলাকায় পানির দাম একেক রকম করার কথা প্রথম প্রস্তাব করে ঢাকা ওয়াসা। ২০২০ সালে এক অনুষ্ঠানে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান এ প্রস্তাব দেন।

তিনি বলেন, ‘পানির যা উৎপাদন খরচ হয়, তার চেয়ে আমরা অনেক কম দামে পানি দিচ্ছি। বাকি টাকা সরকার ভর্তুকি হিসাবে দেয়। দুঃখজনক হলো, এখন উচ্চবিত্তরাও সেই ভর্তুকি পাচ্ছেন। তাদের সেটা পাওয়া উচিত নয়। সব শ্রেণির মানুষের জন্য পানির দাম এক হওয়া উচিত নয়। তাই আমরা এখন চিন্তা করছি, এলাকাভিত্তিক পানির দাম নির্ধারণ করব।’তবে সেটি এখনো কার্যকর হয়নি। এছাড়া পানির দাম বাড়ানোর বিষয়ে আদালতেরও নিষেধাজ্ঞা ছিল।

এর দু’বছর পর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন (এলজিআরডি) ও সমবায়মন্ত্রী মো: তাজুল ইসলামও একই কথা বলেন।

তবে এখন ভর্তুকি থেকে সরে আসতে বিদ্যুৎ ও পানির এলাকাভিত্তিক বিল নির্ধারণের যে প্রস্তাব সরকার দিয়েছে সেটা আসলে কতোটা গ্রহণযোগ্য?‘এটা কোনমতেই গ্রহণযোগ্য নয়’-বলেন ক্যাবের জৈষ্ঠ্য সহ সভাপতি ও জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম।

তিনি মন্তব্য করেন, বিদ্যুৎ ও পানি এই দু’টি সেক্টরেই ভয়াবহ উদ্বেগের জায়গা আছে। এই খাতে যেমন মামলা চলমান আছে, তেমনি আদালতের নির্দেশনাও আছে এ নিয়ে। সেগুলো না মানতে সরকারের এটি একটি কৌশল বলে মনে করেন তিনি।‘দেখুন এগুলোর মূল্য বৃদ্ধির করার জন্য যেমন ঘাটতি বেশি দেখানো হয়, সেভাবে সাবসিডিও বাড়ানো হয়েছে। আর এসব কিছুই করা হয় সরকারে থাকা একটা স্বার্থান্বেষী মহলের সুবিধার জন্য। এটা মোটেই ভোক্তাবান্ধব কিছু নয়,’ বলেন শামসুল আলম।

এছাড়া সরকার ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার যে যুক্তি দিচ্ছে, সেটা নিয়েও আপত্তি এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞের।‘ভর্তুকি তো ভোক্তারা চায় না, ভোক্তারা চেয়েছে যে ব্যয় হচ্ছে সেটা যেন যুক্তিসঙ্গত হয়। সেই বিষয়টা নিয়ে সরকারের আগে কাজ করতে হব।’শামসুল আলম বলেন, এ খাতকে জনকল্যাণমুখী করতে হলে আগে বিদ্যুৎ, পানির মতো পণ্যকে সেবা হিসেবে সরকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

কিভাবে বাস্তবায়ন হতে পারে এটি?
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সংবাদ সম্মেলনে এলাকাভিত্তিক বিলের প্রস্তাব তুলে ধরার সময় পরিষ্কার করে বলেন যে ‘এটি আজকের অর্ডার নয়, যারা এটি নিয়ে কাজ করে তাদের জন্য এটি বলা।’তবে সরকার বিষয়টি বাস্তবায়নে এবার বেশ সিরিয়াস বলেই সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

এই বৈঠকে ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য এ কে এম ফজলুল হক। তিনি জানান প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ছিল পানি এবং বিদ্যুতের অপচয় রোধ করতে একটা পলিসি বা নীতিমালা তৈরি করা।‘আমার ধারণা বিশেষজ্ঞদের দিয়ে হয়ত এটি বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণ করা হবে,’ বলেন ফজলুল।তবে শামসুল আলম জোর দিয়ে বলেন, গণশুনানি ছাড়া যাতে কোনো মূল্য নির্ধারণ না হয়, আদালতের এমন আদেশ বহাল আছে।

তবে গত বছর বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলটরি কমিশন আইন সংশোধন করেছে সরকার। ফলে গণশুনানি ছাড়াই তেল, বিদ্যুৎ বা গ্যাসের মতো জ্বালানির দাম নির্ধারণ করতে পারছে সরকার।জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের একেকেটি এলাকায় নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ বসবাস করে। আয়ের ভিত্তিতে ভাগ করতে গেলে তাদের সবার তথ্য সংগ্রহ করে সেই অনুযায়ী আলাদা আলাদা মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। সরকারের পক্ষে সেটি সঠিকভাবে করার মতো সক্ষমতা আছে কিনা, সেই প্রশ্নও রয়েছে।

ক্যালিফোর্নিয়ায় কী হচ্ছে?
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটে গত বছর একটা আইন পাশ হয়েছে, আর সেটা হলো বাৎসরিক আয়ের ভিত্তিতে প্রতি মাসে ইলেকট্রিক ও গ্যাস বিল পরিশোধ করতে হবে। এ আইনিটি কার্যকর হওয়ার কথা আগামী বছরের জুলাই থেকে।সেদেশে সরকারের এমন সিদ্ধান্তের পেছনে কাজ করেছে দু’টি বিষয়- মাসিক বিল নির্দিষ্ট করে ফেলা এবং ধীরে ধীরে নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে অগ্রসর হওয়া।

তবে এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে সেখানে চলছে নানা তর্ক বিতর্ক। সেখানে নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়ের ভিত্তিতে ভাগ করা হয়েছে কে কত বিল দেবে।

যেমন যাদের আয় বছরে ২৮ হাজার ডলারের নিচে তারা প্রতি মাসে দেবে ২৪ ডলার করে। আর মাসে সর্বোচ্চ ১২৮ ডলার দেবে যাদের আয় বছরে এক লাখ ৮০ হাজার ডলার বা তার বেশি।

কিন্তু কারা, কিভাবে এটি বাস্তবায়ন করবে, সরকার কোন তৃতীয় পক্ষ বা অ্যাজেন্সিকে এ কাজ দেবে কি না সেসব নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন।এছাড়া শুধু ইনকাম ট্যাক্সের তথ্য দেখে বিল নির্ধারণ করা রাজনৈতিকভাবেও সেখানে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিরোধীরা এটাকে কোনো সত্যিকার সমাধান বলে মানতে রাজি নয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এম শামসুল আলম মনে করেন, ‘এখানে সবক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রমাণ আছে। সরকার ট্যাক্স নিতে পারে না। কিন্তু গুলশানে বাস করে বলে বিদ্যুৎ বিল বেশি নেবে এটা হাস্যকর। আয় সৎ নাকি অসৎ সেটা না দেখে কারো কাছ থেকে বেশি পয়সা নেয়া সেটা অসাধু।’তিনি বলেন, যদি আগে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হয়, সমস্ত দুর্নীতি বন্ধ করে যদি আগে ন্যায্য দাম ঠিক করা হয়, তারপর ট্যারিফ ভাগ করা যেতে পারে এবং তখন দরকার হলে নিম্নআয়ের মানুষদের ফ্রি-তেও এসব সেবা দেয়া যেতে পারে।

সূত্র : বিবিসি