ভারত এবং মালদ্বীপের মধ্যে কূটনৈতিক সংঘাতের সূত্রপাত হলো যেভাবে

ভারত এবং মালদ্বীপের মধ্যে কূটনৈতিক সংঘাতের সূত্রপাত হলো যেভাবে

সংগৃহীত

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক লাক্ষাদ্বীপ সফরের ছবিতে মালদ্বীপের মন্ত্রী মরিয়াম শিউনা এবং অন্যান্য নেতাদের আপত্তিজনক মন্তব্যকে ঘিরে কূটনৈতিক উত্তেজনা ও সংঘাতের পারদ ঊর্ধ্বমুখী।

গত বছর ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপতি মুহম্মদ মুইজ্জু ভারতীয় সেনাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলার বিষয়টিকে ঘিরে তরজা অব্যাহতত ছিল। মুইজ্জু রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর দুই দেশের সম্পর্কের ক্রমাগত অবনতি হয়েছে। তারপর মালদ্বীপ সরকারের মন্ত্রী মরিয়ম শিউনাসহ আরো দু’জনের মন্তব্য দুই দেশের সম্পর্কের প্রেক্ষিতে একটা বড় ধাক্কা বলেই মনে করা হচ্ছে।

ওই আপত্তিকর পোস্ট নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার পর সোমবার (৮ জানুয়ারি) ভারত মালদ্বীপের হাই কমিশনারকে তলব করেছে। সেখানে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজেদের অবস্থানের কথা স্পষ্ট ভাবে জানিয়েছে বলে জানা গেছে।

অন্যদিকে, ভারতের সাধারণ নাগরিক এবং একাধিক বিখ্যাত ব্যক্তি এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। #বয়কটমালদ্বীপ যেমন ভারতে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলিতে ট্রেন্ড করছে, তেমনই ট্রেন্ড করছে #এক্সপ্লোরলাক্ষাদ্বীপ-ও।

এদিকে, বিতর্ক জোরাল হতেই মালদ্বীপের মোহাম্মদ মুইজ্জু সরকার নিজেদের ক্ষতির পরিমাণ কমাতে সচেষ্ট হয়েছে।

প্রথমে, ওই মন্তব্যের সাথে সরকারের কোনো যোগ নেই বলে একটি লিখিত বিবৃতি জারি করা হয়।

পরে যারা ওই মন্তব্য করেছেন তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে বলে সরকারের তরফে দাবি করা হয়।

সাবেক ডেপুটি স্পিকার যা বলেছেন
মালদ্বীপ সরকারের পক্ষ থেকে এক বিবৃতি জারি করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতকে অপমান করে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করার বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি জারি করেছে। সরকারি পদে থাকাকালীন যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের পোস্ট করেছেন তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে।‘

রিপোর্ট বলছে, মরিয়ম শিউনা ছাড়াও বরখাস্ত করা হয়েছে মালশা শরিফ ও মাহজুম মজিদকেও।

মালদ্বীপের সাবেক ডেপুটি স্পিকার এবং সাংসদ ইভা আবদুল্লাহ মন্ত্রীদের বরখাস্তের বিষয়টি নিশ্চিত করে উল্লেখ করেছেন, মালদ্বীপ সরকারের উচিত ভারতের জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া।

সংবাদ সংস্থা এএনআই-কে তিনি বলেন, ‘মালদ্বীপ সরকার ওই মন্ত্রীর বক্তব্য থেকে নিজেদের দূরে রেখেছে এই বিষয়টা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। আমি জানি যে- সরকার ওই মন্ত্রীদের বরখাস্ত করেছে, তবে আমার মনে হয় মালদ্বীপ সরকারের ভারতীয়দের কাছে ক্ষমা চাওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ।’

তার কথায়, ‘মন্ত্রীর মন্তব্য লজ্জাজনক। তিনি বর্ণবাদী এবং তা মেনে নেয়া যায় না। এটা কিন্তু মালদ্বীপের আপামর জনসাধারণের ভারত ও ভারতীয়দের প্রতি মতামত নয়। আমরা ভারতের উপর কতটা নির্ভরশীল সেটা আমরা জানি। যখনই আমাদের প্রয়োজন হয়েছে, ভারতই প্রথমে সাহায্য করেছে।’

‘অর্থনৈতিক সম্পর্ক, সামাজিক সম্পর্ক, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাণিজ্য, পর্যটন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে আমরা ভারতের উপর নির্ভরশীল। মানুষ এটা জানে এবং তারা কৃতজ্ঞও। সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান সরকারের জোট-সহ সব রাজনৈতিক দল এই অবমাননাকর মন্তব্যের নিন্দা করেছে।’

এর আগে সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ, সাবেক প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মুহম্মদ সোলিহ এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লাহ শাহিদ এই বিবৃতির নিন্দা করে তাদের দেশের সরকারকে পরামর্শ দেন।

সাম্প্রতিককালে মালদ্বীপ এবং ভারতের সম্পর্কের সমীকরণ বদলেছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে মুইজ্জু প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে কিন্তু তিক্ততা বেড়েছে।

তার আগে মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ছিলেন ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলিহ। সে সময়ে সরকার 'ইন্ডিয়া ফার্স্ট' নীতি অনুসরণ করেছে।

অন্যদিকে, মুইজ্জু 'ইন্ডিয়া আউট' স্লোগান দিয়েই ভোটে লড়েন। নির্বাচনে জেতার পর রাষ্ট্রপতি মুইজ্জুর সিদ্ধান্তে দুই দেশের সম্পর্কে ক্রমশ দূরত্ব বেড়েছে।

মুইজ্জুকে ভারতের থেকে বেশি ‘চীনের কাছের’ বলে মনে করা হয়।

লাক্ষাদ্বীপে প্রধানমন্ত্রী মোদির সফর
চলতি সপ্তাহের শুরুতে লাক্ষাদ্বীপ সফরে গিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। এই সফরের ছবিগুলো তার অফিসিয়াল এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলে পোস্ট করা হয়েছিল।

ছবিগুলি শেয়ার করে তিনি লিখেছেন, যারা 'অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন' তাদের অবশ্যই লাক্ষাদ্বীপে আসতে হবে।

প্রধামন্ত্রীকে ‘স্নর্কেলিং’ (স্নর্কেল মাস্ক পরে ডুব সাঁতার) করতেও দেখা যায়। দেখতে গেলে প্রধানমন্ত্রী লাক্ষাদ্বীপের পর্যটনের প্রচারও করেছেন।

তার পোস্ট করা ছবি দেখে কয়েক লাখ মানুষ হঠাৎ গুগলে লাক্ষাদ্বীপ সার্চ করতে থাকেন। মালদ্বীপের পরিবর্তে লাক্ষাদ্বীপে মানুষের ছুটি কাটাতে যাওয়া উচিএই আলোচনায় সরগরম হয়ে ওঠে সমাজ মাধ্যম।

প্রসঙ্গত, ভারত থেকে প্রতি বছর দুই লাখেরও বেশি মানুষ মালদ্বীপ ঘুরতে যান।

মালদ্বীপে ভারতীয় হাইকমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দুই লাখ ৪১ হাজার এবং ২০২৩ সালে প্রায় দু’লাখ মানুষ মালদ্বীপ ঘুরতে গিয়েছিলেন।

মন্ত্রীর আপত্তিকর বক্তব্য
মালদ্বীপের পরিবর্তে লাক্ষাদ্বীপে যাওয়ার আলোচনা যখন ভারতের সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র হয়ে ওঠে, তখন প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে মালদ্বীপ থেকেও।

এর মধ্যে একটি মন্তব্য ছিল মালদ্বীপ সরকারের মন্ত্রী মরিয়ম শিয়ুনার। তিনি প্রধানমন্ত্রী মোদীর ছবি নিয়ে আপত্তিকর কথা বলেন। পরে অবশ্য মুছে ফেলেন টুইট।

অন্য একটিস টুইটে মরিয়ম লেখেন, 'মালদ্বীপের ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রয়োজন নেই।’

মরিয়ম সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন অনেক টুইট শেয়ার করেছেন যেখানে মালদ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে পাওয়া যাচ্ছে এবং ভ্রমণপিপাসুদের মালদ্বীপে আসতে বলা হয়।

মরিয়ম ছাড়াও মালদ্বীপের একাধিক নেতা একই ধরনের মন্তব্য করেছেন, যা ভারতীয়দের ক্ষুব্ধ করেছে। ওই মন্তব্যগুলোকে ঘিরে ভারতে তীব্র প্রতিক্রিয়াও দেখতে পাওয়া গিয়েছে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বলিউডের তারকা এবং বিখ্যাত খেলোয়াড়রাও ভারতের সমর্থনে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

এর প্রভাব দেখা গিয়েছে মালদ্বীপেও। মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ নাশিদ তার দেশের সরকারকে বিষয়টি সামাল দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

সমাজমাধ্যমে নিজের মত প্রকাশ করে নাশিদ লিখেছেন, ‘মালদ্বীপ সরকারের মন্ত্রী কী ভয়ঙ্কর ভাষায় কথা বলেছেন এবং সেটাও এমন একটি দেশের সম্পর্কে যেটি মালদ্বীপের সুরক্ষা ও সমৃদ্ধির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুইজ্জু সরকারের উচিত এ ধরনের বক্তব্য থেকে দূরে থাকা। এছাড়াও, এটা স্পষ্ট করে দেয়া উচিত যে- এগুলি সরকারের মতামত নয়।’

মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহামেদ সোলিহ ওই মন্তব্য ‘অসংবেদনশীল’ এবং দুই দেশের সম্পর্ককে ‘নষ্ট’ করার মতো বলে বর্ণনা করেছেন।

তিনি বলেন, ‘ভারতের বিরুদ্ধে মালদ্বীপের সরকারি কর্মকর্তাদের সমাজ মাধ্যমে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের নিন্দা জানাই। ভারত সবসময়ই মালদ্বীপের ভালো বন্ধু। আমাদের দুই দেশের পুরনো বন্ধুত্বকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে এমন অসংবেসদনশীল মন্তব্য আমাদের মেনে নেওয়া উচিত নয়।’

মালদ্বীপের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লাহ শাহিদ একটি পোস্টে লিখেছেন, ‘বর্তমান মালদ্বীপ সরকারের উপমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন জোটের এক রাজনৈতিক দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও ভারতীয়দের বিরুদ্ধে সমাজমাধ্যমে যে অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন তা নিন্দনীয় ও ন্যক্কারজনক।’

‘সরকারের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সরকারি পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের শালীনতা বজায় রাখা উচিত। তাদের মেনে নিতে হবে তার পক্ষে সোশ্যাল আক্টিভিজম সম্ভব নয় এবং তাকে দেশের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে।’

আবদুল্লাহ শাহিদের কথায়, ‘আমাদের সম্পর্ক পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জনগণের দৃঢ় বন্ধনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ভারতের বন্ধুত্বের নজির আমরা আগেও দেখেছি।’

মালদ্বীপ সরকারের ব্যাখ্যা
এর কয়েক ঘণ্টা পর মালদ্বীপ সরকার একটি বিবৃতি প্রকাশ করে বিষয়টি স্পষ্ট করে।

রোববার প্রকাশ করা সেই বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ‘বিদেশী নেতা এবং শীর্ষ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সমাজ মাধ্যমে করা অবমাননাকর মন্তব্য সম্পর্কে সরকার অবগত। এই মতামতগুলো একেবারে ব্যক্তিগত এবং তা মালদ্বীপ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করে না।’

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সরকার বিশ্বাস করে যে বাকস্বাধীনতাকে গণতান্ত্রিক ও দায়িত্বশীল ভাবে বিবেচনা করা উচিত যাতে ঘৃণা, নেতিবাচকতা বৃদ্ধি না পায় বা আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে মালদ্বীপের সম্পর্ককে প্রভাবিত না করে।’

বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো এ ধরনের অবমাননাকর মন্তব্যকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করবে না।’

ভারত জুড়ে প্রতিক্রিয়া
মালদ্বীপের মন্ত্রীর মন্তব্যকে কেন্দ্র করে ভারত আপাতত উত্তাল। দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে সোমবার ডেকে পাঠানো হয় ভারতে মালদ্বীপের হাই কমিশনার ইব্রাহিম সাহিদকে।

সুত্রের খবর, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

এদিকে অবমাননাকর মন্তব্যকে ধিক্কার জানিয়ে সরব হয়েছেন সাধারণ মানুষ, বলিউড তারকা, খেলোয়াড়-সহ অনেকেই।

একাধিক বড় তারকা ঘুরতে যাওয়ার জন্য মালদ্বীপের পরিবর্তে লাক্ষাদ্বীপকে বেছে নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। লাক্ষাদ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা জানিয়ে কেউ বা সেখানেই শুটিং করার কথা জানিয়েছেন।

ভারতের ভ্রমণপিপাসুদের অনেকেই মালদ্বীপের যাওয়ার আসন্ন পরিকল্পনা বাতিল করেছেন বলে জানিয়েছেন।

একটি বেসরকারি ভ্রমণসংস্থা ঘোষণা করেছে তারা মালদ্বীপের বুকিং বাতিল করছে। দেশের প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য থেকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের দেখাদেখি অন্যান্য ভ্রমণসংস্থাও একই পন্থা নিয়েছে।
সূত্র : বিবিসি