সাহাবি যুগে জ্ঞানের আসর

সাহাবি যুগে জ্ঞানের আসর

প্রতীকী ছবি।

মজলিসে ফুকাহায়ে সাবআহ

মদিনা মুনাওয়ারায় ফুকাহায়ে সাবআর ‘আল-মজলিসুল ফিকহি’ মসজিদে নববিতেই অনুষ্ঠিত হতো। এ মজলিসের সব সদস্য কাতিবে ওহি হজরত জায়েদ ইবনু সাবিত (রা.)-এর ছাত্র ছিলেন। তারা ইসলামি ফেকাহ, নবসৃষ্ট নানা বিষয় ও বিশ্ব পরিস্থিতি, সমস্যা-সংকট এবং উত্তরণে ইসলামি দিকনির্দেশনা কী হতে পারে তা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করতেন।

দিতেন সমাধান। তারা হলেন-হজরত সাঈদ ইবনু মুসাইয়াব (মৃত: ৯৪ হিজরি), হজরত উরওয়াহ ইবনু জুবায়ের (মৃত: ৯৪ হিজরি), হজরত কাসিম ইবনু মুহাম্মদ ইবনু আবু বকর সিদ্দিক (মৃত: ১০৭ হিজরি), হজরত খারেজাহ ইবনু জায়েদ ইবনু সাবিত (মৃত: ১০০ হিজরি), হজরত আবু বকর ইবনু আব্দুর রহমান ইবনু হারিস (মৃত: ৯৪ হিজরি), হজরত সুলাইমান ইবনু ইসার হেলাল (মৃত: ১০৭ হিজরি), হজরত উবায়দুল্লাহ ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু উতবাহ (মৃত: ৯৮ হিজরি)। কেউ কেউ তাদের সঙ্গে সালিম ইবনু উবায়দুল্লাহ ইবনু আমরকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। (খাইরুল করুন কি দরসগাহ : ৩৭০) লেখক ইবনু রিশক কায়রানি তার ‘আল-উমদাহ ফি মাহাসিনিশ শি’রে ও নুকদাহ’ ফুকাহায়ে সাবআহকে নিয়ে আরবি একটি কবিতা লিখেছেন। (আল-উমদাহ ফি মাহাসিনিশ শি’রে ও নুকদাহ, ১ম খণ্ড : ২৫-২৬) হজরত আব্দল্লাহ ইবনু মুবারক (রহ.) বলেন-ফুকাহায়ে সাবআহর এ বৈঠক বিশেষ বিশেষ মাসআলার সমাধানের জন্য অনুষ্ঠিত হতো।

নবসৃষ্ট বিষয়ে মদিনার কাজি ফুকাহায়ে সাবআহর হাওয়ালা হতেন, তারা কুরআন, সুন্নাহ, তাআমুলে সাহাবা, সুন্নাতে মাজিয়াহ-এর ওপর গবেষণা করে ফতোয়া দিতেন। তাদের ফতোয়া অনুযায়ী মদিনার প্রশাসক-গভর্নর ফয়সালা দিতেন। ইসলামের ইতিহাসে এটি ছিল ইজতেহাদ ও ইজমার প্রাথমিক রূপরেখা। (তাহজিবুত তাহজিব, পূর্বোক্ত, ৩য় খণ্ড : ৪৩৭)।

মজলিসে আসহাবে শুরা

ফুকাহায়ে সাবআহসহ মদিনার অন্যান্য ফকিহ ও পরামর্শক উলামাগণকে নিয়ে গঠিত পরিষদকে ‘আসহাবে শুরা’ বলা হতো। এসব উলামা হজরাত তাদের বৈঠকে আলোচনা-পরামর্শ করে খিলাফত ও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তগুলো দিতেন। ফলে কখনো আমির-উমারাদের দরবারেও তাদের পরামর্শসভা বসত; যেটার গ্রহণযোগ্যতা ছিল ‘মজলিসে শুরা’র মতো।

ঐতিহাসিক ইবনু সাআদের বর্ণনামতে-খলিফা ওমর ইবনু আব্দুল আজিজ এবং খলিফা ওলিদ ইবনু আব্দুল মালিক কর্তৃক মদিনার আমির নিয়োগ করার পর্ব এলেই তারা মদিনায় এসে মসজিদে নববিতে জোহরের নামাজ আদায় করে মদিনার ১০ জন ফুকাহা-উলামাদের একত্র করতেন।

তারা হলেন-হজরত উবায়দুল্লাহ ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু উতবাহ ইবনু মাসউদ, হজরত সাঈদ ইবনু মুসাইয়্যাব, হজরত উরওয়াহ ইবনু জুবায়ের, হজরত কাসিম ইবনু মুহাম্মদ ইবনু আবু বকর সিদ্দিক, হজরত খারেজাহ ইবনু জায়েদ ইবনু সাবিত, হজরত আবু বকর ইবনু আব্দুর রহমান ইবনু হারিস, হজরত সুলাইমান ইবনু ইয়াসার হেলাল, আবু বকর ইবনু সুলাইমান ইবনু আবু হায়সামা, সালিম ইবনু আব্দুল্লা ইবনু ওমর, আবদুল্লাহ ইবনু আমির ইবনু রবিআ (রহ.)।

তাদের সামনে হামদ-সালাতের পর সংক্ষিপ্ত খুতবা দিয়ে বলতেন : আমি আপনাদের এমন এক কাজের জন্য আহ্বান করছি যেখানে আজর-সওয়াব রয়েছে। আপনারা সত্যের সাহায্যকারী ও বন্ধু। আমি চাচ্ছি না আপনাদের পরামর্শ ছাড়া কিংবা এখানে যারা উপস্থিত হয়েছেন আপনাদের পরামর্শ ব্যতীত চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে। আপনারা যদি শরিয়তের কোনো সীমালঙ্ঘন দেখেন অথবা নিয়োগকৃত আমার কোনো প্রশাসকের জুলুম নির্যাতনের খবর পান তো আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে অবগত করবেন।

এ কথা শুনে উপস্থিত সবাই জাযাকাল্লাহ বলে ওঠেন। (তাবাকাতে ইবনু সাআদ, ৫ম খণ্ড : ৩৩৪; খাইরুল করুন কি দরসগাহ : ৩৭২)। ৯১ হিজরি সনে খলিফা ওলিদ এর হুকুমে ওমর ইবনু আব্দুল আজিজ মসজিদে নববি পুনর্নির্মাণ ও প্রশস্ত করতে উল্লিখিত উলামা-ফুকাহার পরামর্শ নেন। তারা মহানবি (সা.) যুগের মসজিদের সীমানা বর্ণনা করেন এবং সে অনুযায়ী নকশা বানিয়ে নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়। (আল-আখবার আত-তিওয়াল : ৩১৩)।

সাহিত্য আসর

মসজিদে নববিতে ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক আসর অনুষ্ঠিত হতো। কবি, সাহিত্যিক, ভাষাবিদ, পণ্ডিতদের আলোচনা শোনে উপস্থিত লোকেরা নিজেদের সমৃদ্ধ করত। এ বিষয়ে প্রসিদ্ধ ছিলেন আলে-জুবায়ের। হজরত সাবিত ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু জুবায়ের ভাষা-সাহিত্যে যেমন ছিলেন পণ্ডিত, ঠিক তেমনি বক্তৃতা, বীরত্ব ও দানশীলতায় খ্যাতি অর্জন করেন। যেন তিনি ছিলেন কুরাইশ বংশের তরজুমান-বিশ্লেষক। (হামজাতু নসবে কুরাইশ ও আখবারিহা : ৮৯) মিসওয়ার ইবনু আব্দুল মালিক বলেন, আমরা মসজিদে নববির সাহিত্য আসরে বসতাম আর সাবিত ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু জুবায়ের ভাষা-সাহিত্যালংকারের বন্যায় ভাসিয়ে দিতেন। তার পাণ্ডিত্য আমাদের আসরে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করত।

মদিনার নানা শ্রেণির লোকজন তার কথামালা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকতেন। (খাইরুল করুন কি দরসগাহ : ৩৭৫) হজরত আবদুল্লাহ ইবনু মুসআব ইবনু সাবিত তার সময়ের প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ ও বক্তা ছিলেন। ফাসাহত-বালাগত, সাহিত্য, বীর বাহাদুরি ও দানশীলতায় স্বীয় দাদাভাইয়ের সুদক্ষ প্রতিনিধিত্ব করেন। তার সাহিত্য মজলিস মসজিদে নববিতে অনুষ্ঠিত হতো। হজরত আব্দুর রহমান ইবনু মুগিরাহ হাজামি বলেন-আমরা মসজিদে নববিতে বসে থাকতাম শুধু আবদুল্লাহ ইবনু মুসআবের কথামালা শোনার জন্য। তার কথাসাহিত্যের জাদু আমাদের আকৃষ্ট করে ওখানে নিয়ে যেত। (হামজাতু নসবি কুরাইশ ও আখবারিহা : ১১২) পরে সাহিত্যের এ ধারাটি অব্যাহত রাখেন তারই নাতি জুবায়ের ইবনু বাক্কার (রহ.)।

তিনি ভাষা-সাহিত্যের পাশাপাশি ইতিহাস, বংশজ্ঞান, আখবার-আছার, হাদিস ও ফিকহের ইমাম ছিলেন। তার লেখা ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘হামজাতু নসবি কুরাইশ ও আখবারিহা’-এর একটা অংশ বিলুপ্ত হয়ে যায়, বাকি অংশ আজও ইতিহাসের খোরাক। পূর্বপুরুষের অনুসরণে তার জ্ঞানসভা ও সাহিত্য আসর মসজিদে নববিতে অনুষ্ঠিত হতো। যেখানে মদিনার কবি-সাহিত্যিক, জ্ঞানী-গুণী, প্রশাসক-বিচারপতিরা অংশগ্রহণ করতেন। তার আসরে অংশ নেওয়া হাশিমি এক ব্যক্তি একদিন জুবায়ের ইবনু বাক্কারকে জিজ্ঞেস করলেন ‘ফরজদম’ কবি জাহিলি না তামিমি? তার এ কাণ্ডজ্ঞানহীন প্রশ্ন শুনে জুবায়ের তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বলতে লাগলেন-ইয়া আল্লাহ! কুরাইশকে আগের মানমর্যাদায় ফিরিয়ে দাও।

সেই কবির নাম ছিল-ফরজদক। (তারিখে বাগদাদ, ৮ম খণ্ড : ৪৭০)। হামামা ইবনু গালিব, উমাইয়া শাসনামলের প্রসিদ্ধ এক কবি এবং কবি জরিরের সমসাময়িক ছিলেন। তার সম্পর্ক তমিমি গোত্রের সঙ্গে ছিল। জুবায়ের ইবনু বাক্কার নিজেই তার সাহিত্য আসরের এক ঘটনা বর্ণনা করেন-মদিনার কাজি আবু গাজওয়া মুহাম্মাদ ইবনু মুসা আনসারি (ইমাম মালিক (রহ.)-এর ছাত্র) প্রায় আমার সাহিত্য আসরে যোগ দিতেন।

একদিন এশা আর মাগরিবের মধ্যখানে আমার সঙ্গে বাক্যালাপের মাঝে কবি ও কবিতা প্রসঙ্গ চলে আসে এবং তিনি বলে ওঠেন-ইবনু আবু সাবাহ মুজানি (আদি ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনু আবু সাবাহ মুজানি) বড় মাপের কবি ছিলেন। তিনি আপনার চাচাকে নিয়ে কবিতাও লিখেছেন। (তারিখে বাগদাদ, ৮ম খণ্ড : ৪৭০)।

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক