নতুন মন্ত্রিসভায় আগের মন্ত্রীরা কেন বাদ পড়লেন? বাদ পড়া মন্ত্রীরা কী বলছেন?

নতুন মন্ত্রিসভায় আগের মন্ত্রীরা কেন বাদ পড়লেন? বাদ পড়া মন্ত্রীরা কী বলছেন?

নতুন মন্ত্রিসভায় আগের মন্ত্রীরা কেন বাদ পড়লেন? বাদ পড়া মন্ত্রীরা কী বলছেন?

বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যে নতুন মন্ত্রীসভা গঠন করতে যাচ্ছে সেখানে বড় ধরণের পরিবর্তন এসেছে।মন্ত্রী পরিষদ সচিব মাহবুবুর রহমান বুধবার সন্ধ্যায় ৩৭ সদস্য বিশিষ্ট যে তালিকা প্রকাশ করেছেন সেখানে দেখা যাচ্ছে, বিগত মন্ত্রীসভার ৩০জন সদস্য বাদ পড়েছেন।বিগত মন্ত্রীসভায় পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে ছিলেন, অথচ এবারের মন্ত্রীসভায় ঠাঁই হয়নি এমন ব্যক্তিরা হলেন - কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং পরিকল্পনা-মন্ত্রী এম এ মান্নান।

এছাড়াও বাদ পড়েছেন বর্তমান পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী গাজী গোলাম দস্তগীর, মৎস্য ও প্রাণি সম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ।এ তালিকায় আরো আছেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, বন ও জলবায়ু বিষয়কমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈ সিং, রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।

কেন বাদ পড়লেন এই মন্ত্রীরা?

মন্ত্রীসভা গঠনের পুরোপুরি এখতিয়ার সংবিধান অনুসারে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তিনি কাকে অন্তর্ভুক্ত করবেন এবং কাকে বাদ দেবেন সেটি তার এখতিয়ার।তবে, বেশ কিছু মন্ত্রীর বাদ পড়ার কারণ নিয়ে দলের ভেতরে নানা আলোচনা ও অনুমান করা হচ্ছে।আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সাথে কথা বলে বোঝা যাচ্ছে, এই মন্ত্রীসভা গঠনের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে।

প্রথমত: নবীন ও প্রবীণের সমন্বয়ে মন্ত্রী গঠন করা। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর যতগুলো মন্ত্রীসভা হয়েছে তার সবগুলোতে নবীন-প্রবীণ সমন্বয়ের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বলে দলটির নেতারা বলছেন।

দ্বিতীয়ত: আঞ্চলিক হিসেবে-নিকেশ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যাতে মন্ত্রীসভার প্রতিনিধিত্ব থাকে সে বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়েছে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগ নেতারা।

তৃতীয়ত: দীর্ঘদিন মন্ত্রীসভায় থাকা ব্যক্তিদের এবার কম বিবেচনা করা হয়েছে বলে অনেকে ধারণা করছেন।

চতুর্থত: এবারের মন্ত্রীসভায় কেউ কেউ স্থান পেয়েছেন যারা প্রধানমন্ত্রীর আস্থা ভাজন হিসেবে পরিচিত।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য অধ্যাপক সাদেকা হালিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, যারা বাদ পড়েছেন তারা যে আবার ফিরে আসবেন না এমন কোন কথা নেই।

"তারা হয়তো কিছুদিন পরে ফিরেও আসতে পারেন। যারা বাদ পড়েছেন তারা আবারো ফিরেআসতে পারেন। সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায়না," বলে মনে করেন অধ্যাপক সাদেকা হালিম।এবারের মন্ত্রীসভায় পূর্নাঙ্গ মন্ত্রী হিসেবে যারা নতুন এসেছেন তাদের মধ্যে একজন হলেন ডা. সামন্ত লাল সেন।তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, মন্ত্রীসভায় ডাক পাওয়া তার জন্য একবারেই অপ্রত্যাশিত।

“আমি কল্পনাই করতে পারি নাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে আশা সেটা যাতে আমি ফুলফিল (পূরণ) করতে পারি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. সেন।“গতকাল যখন ক্যাবিনেট ডিভিশন থেকে ফোন আসলো তখন আমি খুবই আশ্চর্য হয়ে গেছি, নার্ভাস হয়ে গেছি।”

“আমি হয়তো সিনসিয়ারলি কাজ করেছি সারা জীবন, উনি হয়তো দেখেছেন। ”চিকিৎসক সামন্ত লাল সেনের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত পরিচয় রয়েছে। অনেকে মনে করেন তিনি শেখ হাসিনার আস্থা ভাজন।এ বিষয়টি মন্ত্রী হবার ক্ষেত্রে কাজ করেছে কী না?এমন প্রশ্নে মি. সেন বলেন, “আমি ঠিক বলতে পারবো না।”

বাদ পড়া মন্ত্রীরা কী বলছেন?

সুনামগঞ্জের সংসদ সদস্য এমএ মান্নান গত ১০ বছর যাবত থেকে মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। শুরুতে তিনি অর্থ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন পাঁচ বছর। এরপর তিনি পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন।এবারের মন্ত্রিসভায় তিনি নেই। মন্ত্রিসভায় কেন জায়গা হয়নি - সেটি নিয়ে কোন ধারণা করতে পারছেন না মি. মান্নান।

“আই এম ভেরি হ্যাপি হোয়াট আই ডিড (আমি যা করেছি তাতে আমি খুশি)। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় জনগণের আড়ালে থাকা একটি বিষয় ছিল। আমি সেটাকে মানুষের সামনে আসতে পেরেছি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. মান্নান।“গ্রামের লোকেরাও 'একনেক' শব্দটা ব্যবহার করতো। একনেক সভা নিয়ে তারা ওয়েট করতো।”মি. মান্নান মনে করেন, মন্ত্রিসভায় পরিবর্তনের বিষয়টি এমন নয় যে কেউ ব্যর্থ হয়েছে। এখানে ভারসাম্যের একটি বিষয় জড়িত।মন্ত্রিসভা থেকে ‘বাদ পড়া’ বিষয়টিকে নেতিবাচক শব্দ হিসেবে মনে করেন তিনি।

“মানুষ মনে করে হয়তো পারে নাই, সেজন্য বাদ পড়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা ও রকম না। আমার ধারণা ছিল আমি হয়তো থাকবো না। পরপর দুইবার মন্ত্রিসভায় থাকার পরে তৃতীয়বার কাউকে মন্ত্রী করেনা,” বলেন মি. মান্নান।সর্বশেষ মন্ত্রিসভায় টেকনোক্রেট কোটায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন মোস্তফা জব্বার।তিনি বলেন মন্ত্রিসভা গঠনের বিষয়টি সম্পূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার।

“এখানে আমার মন্তব্য করার কিছু নাই। তিনি কাউকে যোগ্য মনে করতে পারেন, আবার কাউকে অযোগ্য মনে করতে পারেন।”“আমি একেবারে মহা যোগ্য বা ব্যর্থ – এসব কিছুই বিষয় নাই। মন্ত্রী পরিষদ গঠন করার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার সাংবিধানিকভাবে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. জব্বার।

মন্ত্রী তালিকা থেকে যারা বাদ পড়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, মন্ত্রিসভা গঠন করা প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। যে মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়েছে সেখানো সবাই যোগ্য বলে মনে করেন মি. সুজন।"আমি তো সংসদ সদস্য, আমার তো দায়িত্ব চলে যায়নি। মন্ত্রী হিসেবে এতোদিন আমি অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছি। এখন আমি নির্বাচনী এলাকায় বেশি সময় দিতে পারবো। আমি একজন আইনজীবী আদালতে আমার পুরনো পেশায় ফিরে যেতে পারবো," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. সুজন।

যারা বাদ পড়েছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। তিনি শুধু মন্ত্রীই ছিলেন না, দলের ভেতরেও গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন।আওয়ামী লীগের নির্বাচন ইশতেহার প্রণয়ণ কমিটির আহবায়ক ছিলেন। ২০০৯ সালে তিনি খাদ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন।কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর মন্ত্রিসভায় স্থান না পেলেও ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর তিনি আবারো মন্ত্রিসভায় ফিরে আসেন। এবার কেন তিনি বাদ পড়লেন সেটি নিয়ে কেউ কোন ধারণা করতে পারছেন না।

মন্ত্রিসভা নিয়ে নানা অনুমান

এবারের মন্ত্রিসভায় যে দুই বিষয় নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে সেটি হলো অর্থ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী।পররাষ্ট্র, অর্থ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং স্থানীয় সরকার - এসব মন্ত্রনালয় সরকারের অগ্রাধিকারের মধ্যে থাকে বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক সাদেকা হালিম।অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবারের মন্ত্রিসভায় জায়গা পাননি। তিনি ২০১৪ সাল থেকে টানা ১০ বছর পরিকল্পনা ও অর্থ মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন।

তার বাদ পড়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ভেতরে নানা ধারণা রয়েছে। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে – তিনি দীর্ঘদিন মন্ত্রী ছিলেন সেজন্য হয়তো এবার তার জায়গা হয়নি।দ্বিতীয় আরেকটি কারণ হতে পারে – গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। এজন্য অনেকে অর্থমন্ত্রীর নানা নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করেন।

এবারের মেয়াদে অর্থনীতিতে সরকারের জন্য নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সে বিষয়টি মাথায় রেখে প্রধানমন্ত্রী হয়তো অর্থ মন্ত্রণালয়ে পরিবর্তন আনতে চাইছেন বলে আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতা মনে করছেন।আরেকটি আলোচিত বিষয় হচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এবং প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বাদ পড়েছেন।পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করছেন, গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন ইস্যুতে আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে পশ্চিমা দেশগুলোর, বিশেষ করে আমেরিকার একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে।

গত ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার ভারত, চীন, রাশিয়া এবং আমেরিকার সাথে ভারসাম্যপূর্ণ একটি সম্পর্ক বজায় রেখেছে। কিন্তু ২০১৮ সালের পর থেকে সেটি বদলে যেতে থাকে এবং পশ্চিমাদের একটি দূরত্ব তৈরি হয়।এই দূরত্ব ঘোচানোর ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের নেতৃত্ব কতটা কাজ করতে পেরেছে সেটি নিয়ে আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতার মধ্যে নানা প্রশ্ন রয়েছে।সে কারণেই পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে পরিবর্তন আসতে পারে বলে তারা ধারণা করছেন।

অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, কয়েকটি মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রীদের কথাবার্তা ও কাজ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। কোন প্রেক্ষাপটে কোন কথা বলতে হবে সেটি কোন কোন মন্ত্রী বুঝতে পারেননি।তাদের 'হালকা মন্তব্য' সরকারকে একটা 'বিব্রতকর জায়গায়' নিয়ে গেছে বলে তিনি মনে করেন।"প্রতি পাঁচ বছর পরপর নতুন ক্যাবিনেট হয়। কেউ কেউ পুনরায় নিয়োগ পান, আবার কেউ কেউ পুনরায় নিয়োগ পাননা। কেউ কেউ আবার পরবর্তীতে নিয়োগ পান। সেক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে বিষয়টি ডিল করছেন," বলেন অধ্যাপক সাদেকা হালিম।

সূত্র : বিবিসি