ইসরায়েল-হেজবোল্লাহ সংঘাত ও সীমান্তের মানুষের জীবন

ইসরায়েল-হেজবোল্লাহ সংঘাত ও সীমান্তের মানুষের জীবন

ইসরায়েল-হেজবোল্লাহ সংঘাত ও সীমান্তের মানুষের জীবন

ইসরায়েল ও হেজবোল্লাহের মধ্যে সংঘাত গত কয়েক সপ্তাহে বেড়েছে। এই সময় সীমান্তের মানুষ কীভাবে জীবন কাটাচ্ছেন?উত্তর ইসরায়েলের কিরিয়াট শামোনা শহর থেকে বরফে ঢাকা মাউন্ট হারমনের দৃশ্য বড়ই সুন্দর। কিন্তু গত তিন মাসে খুব বেশি মানুষ এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছেন না।কারণ, গত তিন মাস ধরে এই জনপদ রীতিমতো ভুতুড়ে শহরের চেহারা নিয়েছে। খালি রাস্তা। এক-দুটো বাদে সব দোকান বন্ধ। নিঃস্তব্ধ শহর মাঝেমধ্যে কেঁপে উঠছে বিস্ফোরণের প্রবল শব্দে।

এই শহর হলো ইসরায়েল ও লেবানন সীমান্তের কাছে। হেজবোল্লাহের সামরিক ঘাঁটি এখান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে।

পুরসভার এমার্জেন্সি টিমের সদস্য ওরিয়েল ফ্রিশ বলছিলেন, ''অ্যালার্টের শব্দ শোনার পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে আমাদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে হচ্ছে। তারপরই আমরা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। অনেক সময় বিস্ফোরণের শব্দের পর অ্য়ালার্টের শব্দ কানে আসছে। আমি যদি গাড়ি চালাই, তাহলে যে কোনো সময় আঘাত লাগতে পারে।''স্বাভাবিক সময়ে এই শহরে ২৩ হাজার মানুষ বাস করেন। কিন্তু হামাস যখন গাজার কাছে ইসরায়েলের শহর আক্রমণ করলো, তারপর সরকার সীমান্তের সাড়ে তিন কিলোমিটারের মধ্যে থাকা শহর ও গ্রাম খালি করার নির্দেশ দেয়।

তারপর ইসরায়েলের সীমান্ত এলাকা থেকে ৫০ হাজার মানুষ চলে গেছেন। সেনার হিসাব ৩৫ হাজার জনকে মধ্য ইসরায়েলে পুনর্বাসন দেয়া হয়েছে।

গাজায় যুদ্ধ শুরুর তিন মাস পর এখনো এটা স্পষ্ট হয়নি, তারা কবে আবার নিজেদের বাড়িতে ফিরতে পারবেন? গত সপ্তাহে ইসরায়েল যুদ্ধবিমান, কামান, রকেট নিয়ে আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়েছে।

হেজবোল্লাহের সঙ্গে সংঘাত বাড়বে?

ইসরায়েলের মিডিয়ায় প্রায় প্রতিদিন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। মিডিয়া রিপোর্টে বলা হচ্ছে, হেজবোল্লাহের সঙ্গে লড়াই ঝুঁকিপূর্ণ হলেও অবশ্যম্ভাবী। সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান স্থিতাবস্থা ভেঙে ইসরায়েল আগে আক্রমণ করতে পারে।গত ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের পর থেকে ইসরায়েলের সেনা কখনই আর অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়তে চাইবে না।ইসরায়েলের সেনাপ্রধান বলেছেন, ''আমি জানি না, কবে উত্তরের দিকে লড়াই শুরু হবে। আমি শুধু এই টুকু বলতে পারি, গত কয়েক মাসের তুলনায় আগামী কয়েক মাসে এই সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যাবে।''

কিরিয়াট শামোনা শহরে এখন দুই হাজারের মতো মানুষ থাকেন। তার মধ্যে একজন হলেন ফ্রিশ। তার পরিবার শহর ছেড়েছে। তিনি একটি স্কুলের প্রিন্সিপাল। এখন তিনি শহরের এমার্জেন্সি টিমের সদস্য।

ফ্রিসের ব্য়াখ্যা, এখানে যে মানুষরা ছিলেন, তারা এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। অধিকাংশই হোটেলে থাকছেন। কিছু মানুষ বেসরকারি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন। বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে। গ্রামের দিকে ব্যবসা বাণিজ্য প্রায় বন্ধ, চাযের খেত এমনিই পড়ে আছে।২০০৬ সালের যুদ্ধ ছয় সপ্তাহ স্থায়ী হয়েছিল। ফ্রিশের বক্তব্য, এবারের যুদ্ধ হামাসের আক্রমণের পর শুরু হয়েছে। কিন্তু এবার হেজবোল্লাহের সঙ্গে লড়াইও শুরু হয়ে যেতে পারে। 

হামাসের থেকে হেজবোল্লাহ ভয়ংকর

কয়েক বছর আগে হেজবোল্লাহ একটি পরিকল্পনার কথা জানায়, যেখানে তাদের যোদ্ধারা ইসরায়েলের উত্তরের অংশ অধিকার করে নেবে। ২০১৮ সালে ইসরায়েলের সেনা জানতে পারে, হেজবোল্লাহ পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে লম্বা টানেল খুঁড়েছে, যা একেবারে ইসরায়েলের জনবসতির কাছে চলে এসেছে।

ফ্রিশ জানিয়েছেন, ইসরায়েলে বেশির ভাগ মানুষ মনে করতেন, ''হেজবোল্লাহ কনোদিন আক্রমণ করবে না। কারণ, ইসরায়েল তাদের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। কিন্তু ৭ অক্টোবরের ঘটনার পর সব ধারণা বদলে গেছে। হেজবোল্লাহের তুলনায় হামাস অনেক কম শক্তির ও কম প্রস্তুতি নেয়া সংগঠন। তারা ইসরায়েলকে আক্রমণ করার পর আমরা বিপদের মাত্রাটা বুঝতে পারছি।'' 

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ইসরায়েলের সেনার নর্দার্ন কম্য়ান্ডের এক অফিসার জানিয়েছেন, উত্তর ইসরায়েলের মানুষ মনে করছেন, তাদের বাড়ি ফেরাটা অবিলম্বে হবে না। হেজবোল্লাহ যতদিন সীমান্তের কাছে থাকবে, ততদিন বেসামরিক মানুষদের শহরগুলিতে ফেরা সম্ভব হবে না।এখনো পর্যন্ত এই সীমান্তে ইসরায়েলের নয়জন সেনা ও ছয়জন বেসামরিক মানুষ মারা গেছেন। ইসরায়েলের সেনার মতে, হেজবোল্লাহের কাছে এক লাখ পঞ্চাশ হাজার অত্য়াধুনিক মিসাইল আছে।

ইয়োগেভের কাহিনি 

মেইতাল ইয়োগেভ এখন সীমান্ত-শহর থেকে দূরে একটি হোটেলের দুইটি ঘর নিয়ে থাকেন। ৭ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি তার পার্টনার ও দুইটি শিশুর সঙ্গে লেবানন সীমান্তের কাছের একটি শহরে থাকতেন।

তিনি বলেছেন, ''নিজের ঘরবাড়িই হলো আমাদের কাছে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। সীমান্তের কাছে থাকা সত্ত্বেও এটা মনে হয়েছে।  হঠাৎ, বুঝতে পারি সেটা আর নিরাপদ নয়।''

তার প্রথমে মনে হয়েছিল, কয়েকদিনের মধ্যে আবার নিজের বাড়িতে ফিরতে পারবেন। কিন্তু তা হয়নি। ইয়োগেভ বলছেন, ''ভবিষ্যতে কী হবে তা বলতে পারছি না। কী করে জঙ্গিদের সঙ্গে চুক্তি হবে, তাও বুঝতে পারছি না। এটা ইসরায়েলের অস্তিত্বের লড়াই।''

যুদ্ধের শুরুতেই তার পার্টনার সেনার রিজার্ভ ফোর্সে যোগ দিয়েছে। দিন পনেরো আগে তিনি বাড়ি এসেছিলেন। কিন্তু তাকে এবার উত্তর ইসরায়েলে যেতে বলা হয়েছে।ইয়োগেভ জানিয়েছেন, ''আমার আবার ভয় করছে। আমার রাগ হচ্ছে। রাজনীতিবিদদের উপর রাগ হচ্ছে। কী করে এটা থামবে? আমাদের কী হবে?''

সূত্র : ডয়চে ভেলে