রামমন্দির উদ্বোধনে ধর্মনিরপেক্ষতা কতটা বজায় ছিল?

রামমন্দির উদ্বোধনে ধর্মনিরপেক্ষতা কতটা বজায় ছিল?

রামমন্দির উদ্বোধনে ধর্মনিরপেক্ষতা কতটা বজায় ছিল?

ভারত ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু কখনো কখনো ধর্ম ও রাষ্ট্রের মাঝের রেখাটা বেশ অস্পষ্ট হয়ে যায়।প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গত ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় রামমন্দিরে ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ করেন। এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন একাধিক নেতা মন্ত্রীরা। কেন্দ্রের পাশাপাশি একাধিক রাজ্য ওই দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছিল।

অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, এর অর্থ কি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ভারত একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সামিল হয়েছে?ভারতের সংবিধান এবং আদালত ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে কী বলছে, সেটা জানার ধরার চেষ্টা করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।

ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা
ভারত একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। ইন্দিরা গান্ধীর আমলে ১৯৭৬ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।সংবিধানের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদ জনগণকে কিছু বিধিনিষেধসহ ধর্ম পালন ও তার প্রচারের স্বাধীনতা দেয়। আর সংবিধানের ২৯ ও ৩০ নম্বর অনুচ্ছেদে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেয়া হয়েছে।

এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রবীণ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. রাজীব ধাওয়ান বলছেন,‘ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার দুটো দিক রয়েছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ধর্মের মধ্যে বৈষম্য করা যাবে না। অন্য অংশে বলা হয়েছে, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে হবে।’

সংবিধান ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের তাদের নিজস্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার অধিকার দিয়েছে। একইসাথে এও উল্লেখ করা হয়েছে যে, সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে সরকার সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারে না।ড. ধাওয়ান বলেন, ‘ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হলো সব ধর্মের সমান গুরুত্ব। আমরা ধর্ম ও রাষ্ট্রকে কঠোরভাবে আলাদা করার নীতি অনুসরণ করি না।’কয়েকটা দেশে যদিও এই নীতি মেনে চলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ফ্রান্স রাষ্ট্র এবং ধর্মকে পৃথকীকরণের নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করে। সেখানে সার্বজনীনভাবে কিন্তু সমস্ত ধর্মের প্রতীক নিষিদ্ধ।

সাংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞ ড. জি মোহন গোপাল বলছেন, ‘ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা কী, তার উত্তর একটা বইয়ের সমান হতে পারে। গণপরিষদের আলোচনাতে এ বিষয়ে খুব কম স্পষ্টতা দেখা যায়। এই অস্পষ্টতা কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছে।’তার কথায়, ‘সব ধর্ম থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখার কথা, যে বিষয়ে মূলত আদালত জোর দিয়ে থাকে, সেই ধারণাও কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদী গ্রন্থ থেকে নেয়া।’

সুপ্রিম কোর্টের ১৯৯৪ সালের এক রায়ে বিচারপতি জে এস ভার্মা যজুর্বেদ, অথর্ববেদ ও ঋগ্বেদ থেকে ‘সর্বধর্মের প্রতি সমভাব’-এর নীতি উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হলো সব ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা।এটা বেশ আশ্চর্যজনক যে ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা দেয়া হচ্ছে ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে।

ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান
ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে সমালোচকরা বলছেন, ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো একক সংজ্ঞা নেই।

ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ জুডিশিয়াল সায়েন্সের আইন ও ধর্মনিরপেক্ষতা-বিষয়ক শিক্ষক বিজয় কিশোর তিওয়ারি বলেন,‘ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা কিন্তু পশ্চিমের ধারণা থেকে আলাদা। সাংবিধানিকভাবে ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিভাজনের প্রশ্নের বিষয়টা কিন্তু অস্পষ্ট। এমনকি সুপ্রিম কোর্টও ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো সংজ্ঞা দেয়নি যা অনুসরণ করা যেতে পারে। সেটা অবশ্য একদিক থেকে ভালো। কারণ এই বিষয়টা শীর্ষ আদালতের আওতাধীন নয়। ভারতের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র ও ধর্মকে একেবারে আলাদা করা সম্ভব নয়। একইসাথে তা প্রয়োজনীয়ও নয়।’

সংঘমিত্রা পাধি নিউ জার্সির রেম্যাপো কলেজের আইন ও সামাজিক বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক। তিনি বলছেন, ‘এই বিষয়ে কিছু মামলায় আদালত আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছে এবং জানিয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতীয় সংবিধানের এমন একটি বিধান, যা সংশোধন করা যায় না।’

তিনি আরো বলেন,‘একইসাথে অন্য কয়েকটি মামলায় সুপ্রিম কোর্টে স্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থের প্রতি সংবেদনশীল থেকেছে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকারকে আঘাত করেছে। অন্য কয়েকটি ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের বিশেষ অধিকার দেয়া হয়েছে।’

সংশোধনের মাধ্যমে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটা অন্তর্ভুক্ত করার চার বছর আগে অর্থাৎ ১৯৭২ সালে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ। এর অর্থ হলো, জনগণের কাছ থেকে এটা কেড়ে নেয়ার ক্ষমতা কোনো সরকারের নেই।যদিও ১৯৭৪ সালে, সুপ্রিম কোর্টের দু’জন বিচারক লিখেছিলেন যে ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র’ শব্দটি ভারতের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় কি না সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ ভারতে বিভাজনের পাঁচিল নেই।শীর্ষ আদালতের ওই দুই বিচারক লিখেছিলেন, ‘সংবিধানে এমন কিছু বিধান রয়েছে যা আমাদের রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ হতে বাধা দেয়।’

উল্লেখ্য, ১৯৯৪ সালে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়ে অন্যতম শক্তিশালী রায় দিয়েছিল ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালতের নয় সদস্যের বেঞ্চ বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার পর রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও হিমাচল প্রদেশের বিজেপি সরকারকে বরখাস্ত করার রায় বহাল রাখে।

এই রাজ্যগুলোতে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয় এবং বিধানসভা স্থগিত করা হয়। আদালত তার রায়ে উল্লেখ করে এই রাজ্যগুলোর সরকার সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোকে সমর্থন করেছিল এবং মসজিদ ভাঙতে সাহায্য করেছিল। এই রাজ্যগুলোর রাজ্যপালরা জানিয়েছিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও রাজ্যের সাংবিধানিক ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে।

এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্র ও ধর্মকে আলাদা করার উপর জোর দিয়েছিল।রায় প্রদানকারী এক বিচারপতি লিখেছেন, ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি বা মতবাদ ধর্মকে রাজনৈতিক শাসনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সমান যা সংবিধানে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আদালত আরো জানিয়েছিল, আইনের পাশাপাশি নির্বাহী বিভাগকেও তার কাজে ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে।

ভারতীয় আদালতে ধর্মনিরপেক্ষতা
পরে অবশ্য এই মামলা দুর্বল হয়ে পড়ে। ‘মহারাষ্ট্রে প্রথম হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে’ এক নেতার এমন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ১৯৯৫ সালে আদালত বলেছিল এটি ধর্মের ভিত্তিতে ভোট চাওয়ার সমতুল্য নয়।

এনসিইআরটি ২০০২ সালে যে পাঠ্যক্রম তৈরি করেছিল তা এই যুক্তিতে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল যে এতে সংস্কৃত, বৈদিক গণিত ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই মামলায় আদালত ওই পাঠ্যক্রম বহাল রেখেছিল। এক বিচারক লিখেছিলেন,‘নিরপেক্ষতার নীতি দেশের কোনো ভালো করেনি।’এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি আফতাব আলম ২০০৯ সালে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘পাঠ্যসূচিতে শুধু ধর্মীয় শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে- এই বিষয়টা ওই রায়ে উপেক্ষা করা হয়েছিল।’সাম্প্রতিক সময়ে আদালতের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ না হওয়ার একাধিক অভিযোগ উঠেছে।

ড. গোপাল বলছেন, ‘এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে আদালত সিদ্ধান্তের জন্য ধর্মীয় গ্রন্থের আশ্রয় নিয়েছে।’তিনি যোগ করেছেন, ‘অযোধ্যা মামলার রায়ের সংযোজন একটা ধর্মীয় আদেশ।’অযোধ্যা রায়ে একটি অতিরিক্ত সংযোজন রয়েছে। যেখানে বাবরি মসজিদ ছিল সেখানে ভগবান রাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন- এই বিশ্বাসের ওপর সেটা জোর দেয়।

ড. ধাওয়ান এটাও মনে করেন যে ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে আদালতগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন,‘জ্ঞানবাপী মামলায় উপাসনাস্থল আইন পুরোপুরি ভুলে যাওয়া হয়েছিল।’ড. তিওয়ারি বলেন, ‘আদালত বারবার অভিন্ন দেওয়ানি বিধির দাবি জানিয়েছে। এটা কিন্তু রাজনৈতিক দলের অ্যাজেন্ডার মতোই।’

রামমন্দিরের প্রাণ প্রতিষ্ঠা কি ধর্মনিরপেক্ষ ছিল?
ড. ধাওয়ানের মতে, ভারত যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে ২২ জানুয়ারির কর্মকাণ্ড তার পরিপন্থী।তিনি বলেন,‘কোনো ধর্মকে সমর্থন বা সেটা নিয়ে রাজনীতি করা উচিত নয়, যেভাবে সেদিন তা করা হয়েছিল। নিরপেক্ষ দাবি করে রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে ব্যবধান তৈরি করা- সেটা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে ভালো নয়।’

একটা ধর্মকে সরিয়ে রেখে আরেক ধর্মের পক্ষ নেয়া যেতে পারে না। এ কথার উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, মসজিদ তৈরি হলেও কি প্রধানমন্ত্রী সেখানে যাবেন?ড. তিওয়ারির কথায়,‘সংখ্যালঘুদের প্রতি আমাদের সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি হলো বৈষম্যহীন ধর্মীয় স্বাধীনতা। দুঃখজনকভাবে, এই অধিকারগুলো শঙ্কায় রয়েছে এবং তারা নিরাপদ বোধও করেন না।’

সেন্টার ফর স্টাডি অফ ডেভেলপিং সোসাইটিজের অধ্যাপক হিলাল আহমেদের মতে, অযোধ্যার ঘটনাকে দুটো দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে।কেউ বলতেই পারেন এটা একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল, তাই আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে সরকারের অংশ নেয়ার বিষয়টা গ্রহণযোগ্য। ভারতের প্রেক্ষাপটে একটি মসজিদ, মন্দির বা কোনো রাজনীতিবিদকে চাঁদা দেয়া বা মন্দিরের সংস্কারের জন্য অনুদান দেয়া সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য।

অধ্যাপক হিলাল বলেন, ‘দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গি হলো এই পুরো বিষয়টায় সাংবিধানিক নৈতিকতার আলোকে পর্যবেক্ষণ করা। রাষ্ট্র ধর্মীয় বিষয়ে নীতিগত দূরত্ব বজায় রাখবে- এটাই আশা করা হয়। এখানে দুটো প্রশ্ন রয়েছে : এটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান কি না? সব ধর্মের মানুষ কি এরমধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে, না কি তারা কোণঠাসা বোধ করবেন?’তিনি বলছেন, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে অযোধ্যায় রামমন্দিরের ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাংবিধানিক নৈতিকতার পরিপন্থী হতে পারে।

সূত্র : বিবিসি