ভারতের জ্ঞানবাপী মসজিদে পূজার অনুমতি আদালতের,সকাল থেকে পূজা শুরু

ভারতের জ্ঞানবাপী মসজিদে পূজার অনুমতি আদালতের,সকাল থেকে পূজা শুরু

ছবি : প্রতীকি

ভারতের উত্তরপ্রদেশের বারাণসির জ্ঞানবাপী মসজিদের ভূগর্ভস্থ একটি কক্ষে আদালতের অনুমতিতে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পূজা শুরু করেছে হিন্দুরা।বারাণসির আদালত হিন্দুরা যেন পূজা দিতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে বুধবার প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছিল।বারাণসির জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এস রাজালিঙ্গম বৃহস্পতিবার ভোরে সাংবাদিকদের এ কথা জানান।

তিনি বলেন, ‘আমাকে আদালত যে নির্দেশ দিয়েছে তা পালন করা হয়েছে।’কাকতালীয়ভাবে ৩৮ বছর আগে ১৯৮৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারিই অযোধ্যার বাবরি মসজিদের তালা খোলা হয়েছিল।এই মামলার একজন মামলাকারী সোহান লাল আরিয়া বৃহস্পতিবার বার্তাসংস্থা এএনআইকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আজ (বৃহস্পতিবার) একটি অত্যন্ত গর্বের মুহূর্ত বলে মনে হচ্ছে। সারা গায়ে শিহরণ লাগছে।’

কেন মসজিদে পূজার অনুমতি?
কয়েক দিন আগেই ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বা আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া জানিয়েছিল, হিন্দুদের একটি প্রাচীন মন্দির ভেঙ্গেই সেখানে মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল। জ্ঞানবাপী মসজিদের গা লাগোয়া হিন্দুদের অতি পবিত্র তীর্থস্থান বলে পরিচিত ভগবান বিশ্বনাথ বা শিবের মন্দির।

জ্ঞানবাপী মসজিদের ভূগর্ভস্থ ওই কক্ষটিতে পূজা দেয়ার অনুমতি চেয়ে আদালতে মামলা করেছিলেন কয়েক জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী।বারাণসির জেলা আদালতের আদেশের পরে হিন্দু-পক্ষের উকিল ভিষ্ণু শঙ্কর জৈন বলেন, সাত দিনের মধ্যেই ওখানে পূজার বন্দোবস্ত করতে জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

আদালতের ওই রায়ের সমালোচনা করে এআইএমআইএমের সভাপতি আসাদুদ্দিন ওয়েইসি বলেন, জ্ঞানবাপী মসজিদ পরিসরের ভূগর্ভস্থ কক্ষটিতে হিন্দুদের পূজা দেয়ার অনুমতি আইন বিরুদ্ধ।

বার্তাসংস্থা এএনআইকে তিনি বলেন, ‘যে বিচারক এই রায় দিয়েছেন, তার কর্মজীবনের শেষ দিন ছিল এটি। এই বিচারকই আগে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে রিসিভার হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন এবং এখন সরাসরি নির্দেশ জারি করলেন। তিনিই তো এর আগে বলেছিলেন, ওখানে ১৯৯৩ সাল থেকে কোনো পূজা হয় না। তিনি কী করে জানলেন যে সেখানে মূর্তি রয়েছে? এটা স্পষ্টতই উপাসনা-স্থল আইনের লঙ্ঘন।’এই মামলার মুসলিম পক্ষ ওই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে যাবে বলে জানিয়েছে।

অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি বিতর্ক চলাকালীন যেভাবে সেখানকার গর্ভগৃহের তালা খুলে দেয়ার জন্য গত শতাব্দীর আশির দশকে নির্দেশ দিয়েছিল আদালত, তার সাথে বারাণসির আদালতের নির্দেশের তুলনা করেন হিন্দু পক্ষের উকিল জৈন।হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো দীর্ঘ দিন ধরেই স্লোগান দিয়ে থাকে যে ‘অযোধ্যা তো সির্ফ ঝাঁকি হ্যায়, কাশি-মথুরা বাকি হ্যায়’, অর্থাৎ অযোধ্যা তো স্রেফ শুরু, কাশি-মথুরা বাকি আছে।প্রাচীন কাশি আর বর্তমানের বারাণসি বা বেনারস একই শহর।

মসজিদের নিচেই পূজা হতো, দাবি হিন্দুদের
আদালতের কাছে তাদের পিটিশনে হিন্দুদের তরফে দাবি করা হয়েছে, ‘পরিসরটির দক্ষিণ দিকে অবস্থিত ভূগর্ভস্থ কক্ষে মূর্তি পূজা হতো। পূজারি ব্যাসজীকে ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ব্যারিকেড এলাকায় ঢুকতে বাধা দেয়া হয়। এর ফলে ভূগর্ভস্থ কক্ষটিতে রাগ, ভোগ ইত্যাদি আচার অনুষ্ঠানও বন্ধ হয়ে যায়।’

হিন্দুদের দাবি, রাজ্য সরকার আর জেলা প্রশাসন কোনো কারণ না দেখিয়েই ভূগর্ভস্থ কক্ষটিতে পূজার ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।তারা আরো দাবি করে, পূজারি ব্যাসজীর নামাঙ্কিত ওই ভূগর্ভস্থ কক্ষটির ভেতরে হিন্দুদের পূজা-অর্চনার বিভিন্ন সামগ্রী, প্রাচীন মূর্তি আর ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু সামগ্রী রয়ে গেছে।ওই মূর্তিগুলোর নিয়মিত পূজা করা উচিত বলেও তাদের দাবি ছিল।

ভূগর্ভস্থ কক্ষ যার, ওপরের মসজিদের জমিও তার?
জ্ঞানবাপীকে নিয়ে ১৯৩৬ সালে দীন মোহাম্মদ মামলায় আদালতে দাখিল করা একটি মানচিত্রে দক্ষিণ দিকে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে, ‘ব্যাসের মালিকানাধীন ভূগর্ভস্থ কক্ষ।’

জ্ঞানবাপীর মালিকানা দাবি করে ১৯৯১ সালে সোমনাথ ব্যাসের দায়ের করা মামলায় যে মানচিত্র পেশ করা হয়, সেখানেও দক্ষিণ দিকে ‘ভূগর্ভস্থ কক্ষটির মালিকানা বাদী নম্বর দুইয়ের’ এমনটা লেখা রয়েছে।মানচিত্রে জ্ঞানবাপী কমপ্লেক্সের আশপাশের সমস্ত জমিতে হিন্দু পক্ষগুলোর দখল দেখানো হয়েছে।পণ্ডিত সোমনাথ নিজেকে ‘ব্যাস জ্ঞানবাপী পরিসর’-এর ‘সিংহাসন’-এর পণ্ডিত বলে দাবি করতেন এবং আদালতে তিনি ভগবান বিশ্বেশ্বরের ‘বন্ধু’ হয়ে জ্ঞানবাপীর জমি নিয়ে একটি সম্পত্তির মামলা দায়ের করেছিলেন।

তিনি দাবি করেন, ‘৯১৩০ নম্বর প্লটে ভেঙ্গে ফেলা আদি বিশ্বেশ্বরের মন্দিরের কিছু অংশ এখনো রয়ে গেছে।সোমনাথ ব্যাস তার আবেদনে লিখেছিলেন, হিন্দুরা ওখানে পূজা করে আদি বিশ্বেশ্বরের মন্দির হিসেবে পরিক্রমাও করে।সোমনাথ ব্যাস দাবি করেছিলেন, যেহেতু ভূগর্ভস্থ কক্ষটি এবং সেখানকার জমি তার দখলে রয়েছে, তাহলে সেই যুক্তিতে ওপরের কাঠামোর (মসজিদ) মালিকানাও তাদের।

মুসলিম পক্ষ কী বলছে?
মুসলিমদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যে ভূগর্ভস্থ কক্ষটিতে পূজা করার অনুমতি চাইছে হিন্দুরা, সেখানে ব্যাস নামের কোনো পরিবারের সদস্য কখনোই পূজা করত না। তাই ভূগর্ভস্থ কক্ষটিতে ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বর থেকে পূজা বন্ধ হয়ে গেছে, এই প্রশ্নটাই অবান্তর।

ওই কক্ষে কোনো মূর্তি ছিল না বলেও মুসলিমদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে আর হিন্দুদের এই দাবিও তারা নাকোচ করছে যে ব্রিটিশ আমলে সেখানে ব্যাস পরিবার পূজা করত।মুসলিম পক্ষের আরো দাবি, ব্যাস পরিবার বা কোনো ভক্ত কখনো ভূগর্ভস্থ কক্ষে কোনো পূজা করেননি এবং এটি শুরু থেকেই মসজিদের পাশে দখল করে রাখা হয়েছে।

মসজিদের পক্ষ থেকে আরো বলা হয়েছে, ৯১৩০ নম্বর প্লটে জ্ঞানবাপী মসজিদ হাজার বছর ধরে বিদ্যমান, ভূগর্ভস্থ কক্ষটিও ‘মসজিদ আলমগিরি’ (জ্ঞানবাপী) অংশ।আবেদনে মসজিদ পক্ষ ১৯৩৭ সালের দীন মোহাম্মদ মামলার রায়ের কথা উল্লেখ করে বলেছে, ওই মামলার রায়ে ঘোষণা করা হয়েছিল যে মসজিদ, এর আঙ্গিনা এবং এর সাথে সংযুক্ত জমি হানিফা মুসলিম ওয়াকফের সম্পত্তি এবং সেখানে মুসলমানদের নামাজ পড়ার অধিকার রয়েছে।

প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কী বলছে?
আদালতের নির্দেশে ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, এএসআই জ্ঞানবাপী পরিসরে যে সার্ভে করেছে, ব্যাসজীর নামাঙ্কিত ভূগর্ভস্থ কক্ষটি সেই সার্ভের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তবে প্রত্নতাত্ত্বিকরা জ্ঞানবাপীর অন্য ভূগর্ভস্থ কক্ষগুলো পরীক্ষা করে এ সম্পর্কে তাদের রিপোর্ট দেন।

এএসআই জানিয়েছে, মসজিদের পূর্ব অংশে নামাজের জন্য ভূগর্ভস্থ কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছিল এবং মসজিদে একটি চাতাল এবং আরো জায়গা তৈরি করা হয়েছিল যেন বেশি সংখ্যক লোক নামাজ পড়তে পারেন।এএসআই জানিয়েছে, মন্দিরের স্তম্ভগুলো পূর্ব দিকের ভূগর্ভস্থ কক্ষ তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল।এন২ নামে চিহ্নিত একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষে এমন একটা স্তম্ভ ব্যবহার করা হয়েছিল, যেখানে ঘণ্টা, প্রদীপ রাখার জায়গা আর কিছু শিলালিপি দেখা গেছে।আবার এস২ নামের একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষে মাটির নিচে চাপা পড়া হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তিও পাওয়া গেছে।
সূত্র : বিবিসি