ভারতে কি ধর্মনিরপেক্ষতার কোনও ভবিষ্যৎ আছে?

ভারতে কি ধর্মনিরপেক্ষতার কোনও ভবিষ্যৎ আছে?

ভারতে কি ধর্মনিরপেক্ষতার কোনও ভবিষ্যৎ আছে?

ভারতের ৭৫তম প্রজাতন্ত্র দিবসের চার দিন আগে ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় নতুন রাম মন্দিরের ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রায় ৭৩ বছর আগে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদও গুজরাটের সোমনাথ মন্দিরে একই ধরনের এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন।

অভিযোগ করা হয়, আফগান আক্রমণকারীদের বেশ কয়েকবারের হামলায় সোমনাথ মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল একাদশ শতাব্দীতে মাহমুদ গজনির আক্রমণের কারণে।স্বাধীনতার পর এই মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করা হয় এবং রাজেন্দ্র প্রসাদের উপস্থিতিতে মন্দিরে পূজা শুরু হয়।দেশের রাষ্ট্রপতির এরকম একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার স্বপক্ষে মত দেননি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু।

নেহরু ১৯৫১ সালে রাজেন্দ্র প্রসাদকে লিখেছিলেন, ‘প্রিয় রাজেন্দ্র বাবু, সোমনাথের বিষয়টি নিয়ে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমি যেটা আশঙ্কা করেছিলাম যে এই বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যাখ্যা করা হবে, সেটাই হয়েছে। আমাদের জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে যে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সরকার কিভাবে এরকম একটা ঘটনার সাথে যুক্ত হতে পারে। বিশেষ করে যখন এই কর্মসূচিকে ধর্মীয় পুনর্জাগরণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি থেকে উঠে এসেছেন আর নেহরুর উত্থান হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হাত থেকে দেশকে স্বাধীন করার সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে।নেহরুর জাতীয়তাবাদ ছিল উপনিবেশবাদ বিরোধী, যার কেন্দ্রে সংখ্যাগুরুত্ববাদ নয় বরং ছিল বহুত্ববাদ।

অন্যদিকে মোদির জাতীয়তাবাদ আসলে তার দলের আদর্শগত ভিত্তি যে সংগঠনের, সেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএসের জাতীয়তাবাদ। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, উপনিবেশবিরোধী জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করেছে আরএসএস।

সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদ
নেহরুর জাতীয়তাবাদে ভারতকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দাস হিসেবে বিবেচনা করা হতো, কিন্তু মোদি এবং আরএসএস মনে করে ভারত আসলে ১২০০ বছর ধরেই দাস হয়ে ছিল।আরএসএস এটাও মনে করে যে পুরো মধ্যযুগ ধরেই ভারত আসলে গোলাম হয়ে থেকেছে। সেজন্যই মুসলিম শাসকদের প্রতীক ও নির্মাণগুলো মুছে ফেলাই আরএসএস আর বিজেপির ভাবাদর্শের অংশ।

জওহরলাল নেহরু চেয়েছিলেন সরকার যাবতীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকুক, অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদি নিজেই রাম মন্দিরে ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ কর্মসূচির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিলেন।ঐতিহাসিক মুকুল কেশবন মনে করেন এই দুটি ঘটনাই ভারতীয় রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মুকুল কেশবন বিবিসিকে বলেন, ‘ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য রেখাটা নেহরু কখনোই ভাঙতে চাননি। অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদি ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যকার সীমারেখা প্রায় মুছেই ফেলেছেন। অযোধ্যায় রাম মন্দির একটি শক্তিশালী ধর্মীয় প্রতীক হলেও প্রাথমিকভাবে এর মাধ্যমে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদের একটা রাজনৈতিক বার্তা দেয়া হলো।’

‘আরএসএস ও তার নেতাদের পরিকল্পনায় বাবরি মসজিদ এক নম্বরে ছিল, কিন্তু আরো বেশ কয়েকটি মসজিদও তাদের নজরে রয়েছে। বাবরি মসজিদ নিয়ে তাদের বিজয় তো প্রকাশ্যেই ঘোষণা করা হয়েছে। সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদী ভাবাবেগকে উস্কে দেয়া এবং সংখ্যালঘুদের ভয় দেখানোর এই অব্যাহত প্রচেষ্টা ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের যে গণতান্ত্রিক ভিত্তি, সেটাকেই ধ্বংস করে দেবে,’ বলেন কেশবন।

চলতি মাসেই বারাণসির জ্ঞানবাপী মসজিদে হিন্দু পুরোহিতদের পূজা দেয়ার অনুমতি দিয়েছে আদালত। নিম্ন আদালতের এই সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতে নারাজ এলাহাবাদ হাইকোর্টও।মথুরাতেও মসজিদ আর ঈদ্গাহ নিয়ে একই ধরনের দাবি আছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর।অনেকে মনে করেন, ১৯২৫ সালে আরএসএস প্রতিষ্ঠার পর থেকে তারা হিন্দু সংখ্যাগুরুকেন্দ্রিক যে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে এসেছে কংগ্রেসের উপনিবেশবিরোধী জাতীয়তাবাদের বিপরীতে, তা এখন পূর্ণতা পেতে চলেছে।

মুকুল কেশবন বলেন, ‘হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক ধারাটি ইচ্ছাকৃতভাবে ইতিহাস নতুন করে লেখার চেষ্টা করছে এবং উপনিবেশবিরোধী জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভার ভূমিকা ছিল নগণ্য। বহুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর চিন্তাধারার প্রতি চরম শত্রু মনোভাবাপন্ন এই দুটি সংগঠনই।’

রাম মন্দির নির্মাণ ইতিহাস বদলানোর জন্য নয়
বিজেপির জাতীয় কার্যনির্বাহী সমিতির সদস্য ও লেখক স্বপন দাশগুপ্ত অবশ্য বিশ্বাস করেন না যে রাম মন্দির নির্মাণ আর ভগবান রামচন্দ্রর মূর্তিতে প্রধানমন্ত্রীর ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ করার ফলে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

স্বপন দাশগুপ্ত বিবিসিকে বলেন, ‘দেখুন, সাংবিধানিক পরিচয় আর সাংস্কৃতিক পরিচয়কে আলাদা করা যায় না। দুটি একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত। নেহরুপন্থীরা যে ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবনা গ্রহণ করার চেষ্টা করছিলেন, সেখানে তারা মনে করতেন যে সাংবিধানিক আর সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মধ্যে কোনো সম্পর্কই নেই। তারা মনে করেন ১৯৫০ সালে ভারত গঠিত হয়েছিল, কিন্তু ভারত তো হাজার হাজার বছর ধরে ছিলই।’

তিনি বলেন, “আমি মনে করি অযোধ্যার মাধ্যমেই ‘ভারতীয় পরিচয়’ আবারো ফিরে এল। আমরা ইতিহাস সংশোধন করতে পারি না, কিন্তু আগে তো স্বীকারই করত না যে মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসকে তো স্বীকার করতে হবে। রাম মন্দির নির্মাণ ইতিহাস বদলানোর জন্য নয়, ইতিহাসের ভুলগুলো যাতে স্মরণ করিয়ে দেয়া যায়, সেটাই রাম মন্দিরের গুরুত্ব।”মধ্যযুগীয় ভারতে উপাসনালয়ের ওপরে হামলাকে কি আধুনিক গণতান্ত্রিক ভারতে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখা উচিত?

ভারতের প্রখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী আসগর আলী ইঞ্জিনিয়ার বলতেন, ‘সেই সময়ের শাসকরা উপাসনালয় ধ্বংস করতেন যুদ্ধ বা হামলায় বিজয়ের প্রতীক হিসেবে। সেটাকে বর্তমান সময়ে হিন্দু বনাম মুসলিম দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখা উচিত নয়।’

স্বপন দাশগুপ্ত বলেন, ‘হিন্দুত্ববাদ যে একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ধর্ম এর একটি অংশ। আমিও বিশ্বাস করি, রাষ্ট্র ও ধর্মকে এক করা উচিত নয়। অযোধ্যায় রাষ্ট্র যুক্ত হয়েছিল, কিন্তু রাষ্ট্র নিজেকে এতটাও দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না। ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা হুমকির মুখে পড়েছে বলে আমি মনে করি না। যদি ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য হয়, তাহলে সে কথা বলা যায়।’

রাষ্ট্র ও ধর্মের সম্পর্ক
ভারতের সংবিধানের মূল রচয়িতা বি আর আম্বেদকর বলতেন, ধর্মের প্রতিটি দিক বা ধর্মের প্রতিটি রীতিনীতির প্রতি সম্মান দেখানো সম্ভব নয়, অর্থাৎ ধর্মকে সম্মান করা উচিত কিন্তু সমালোচনাও করতে হবে। একইসাথে রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন থাকা উচিত, কিন্তু যখন ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিঘ্নিত করতে শুরু করে আর ধর্ম বৈষম্যের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন রাষ্ট্রেরও হস্তক্ষেপ করা উচিত। দ্বিতীয়ত, ধর্ম থেকে রাষ্ট্র নিজেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে না বরং সকল ধর্ম থেকে নীতিগত দূরত্ব বজায় রাখে।’

‘যেমন, অস্পৃশ্যতা মেনে নেয়া যায় না, তাই ব্যক্তিগত আইনে থাকলেও সেটা অবিকৃতভাবে রাখা যাবে না। রাষ্ট্রকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কখন ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে হবে এবং কখন দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। আমরা অবশ্যই আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে স্বাধীনতা, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্বের পথে কোনো বাধা হিসেবে ধর্মকে আসতে দেব না,’ লিখেছিলেন তিনি।যখনই প্রয়োজন পড়েছে, তখনই ভারত রাষ্ট্রধর্মের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে। পশুবলি বন্ধ করা এবং দলিতদের মন্দিরে প্রবেশের অধিকার তো রাষ্ট্রই দিয়েছিল।

কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষতার সংকট
জওহরলাল নেহরু সবসময়ে যে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন তাকে দুর্বল করে দেয়ার কাজটা শুরু হয়েছিল তার পরিবারের মধ্যে থেকেই। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার সংকট শুরু হয় আশির দশক থেকে।

জনপ্রিয়তা ক্রমশ কমতে থাকায় কংগ্রেস এমন অনেক সিদ্ধান্ত নেয় যা আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকেই শক্তিশালী করে। ইন্দিরা গান্ধী আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়কে সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দিয়েছিলেন।

আবার হিন্দুত্ববাদী দল শিবসেনার সাহায্যও নিয়েছিলেন তিনি। পাঞ্জাবে অকালি দলকে চাপে ফেলার জন্য জার্নাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালেকে উৎসাহিত করার অভিযোগও রয়েছে তারা বিরুদ্ধে। মিসেস গান্ধীই ১৯৮৩ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সহায়তায় নির্মিত ভারত মাতা মন্দিরে পূজা শুরু করেছিলেন।

ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর ১৯৮৪ সালে তার পুত্র রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হন এবং তার নীতিমালা নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন উঠে যায়। শাহ বানো মামলায় মুসলিম ‘মৌলবাদী’দের কাছে আত্মসমর্পণের অভিযোগ ওঠে রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে।শাহ বানো মধ্য প্রদেশের ইন্দোরের একজন মুসলিম নারী ছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট বিবাহবিচ্ছেদের মামলায় তার স্বামীকে খোরপোষ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল, কিন্তু রাজীব গান্ধী সংসদে আইন পরিবর্তন করে আদালতের ওই রায় উল্টিয়ে দিয়েছিলেন।

রাজীব গান্ধীর এই সিদ্ধান্তটাই হিন্দুত্ববাদীদের সামনে একটা সুযোগ করে দেয় একথা বলার যে কংগ্রেস মেকি ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি করে।তখন থেকেই মুসলিম তোষণ শব্দটির প্রচলন ঘটে।এরপর হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা তাদের রাজনীতিকে শক্তিশালী করে তুলতে থাকেন।

ভারতীয়রা কি সাম্প্রদায়িক হয়ে গেছে?
প্রথম সাধারণ নির্বাচনে, ১৯৫২ সালে, জওহরলাল নেহরুর বিজয়কে ধর্মনিরপেক্ষতার জয় হিসেবে দেখা হয়। তখন বলা হতো যে পাকিস্তান একটা ইসলামিক রাষ্ট্র হলেও ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠী কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের পক্ষেই রায় দিয়েছে।যদিও দেশভাগের পর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার স্মৃতি তখনো মানুষের মনে টাটকা ছিল।যখন বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়, তখন রাম মন্দিরের জন্য প্রচারে নামা বিজেপি নেতারাও প্রকাশ্যে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।

সেই সময়ে অটল বিহারী বাজপেয়ী বিজেপির জাতীয় কার্যনির্বাহী সমিতি থেকে পদত্যাগের প্রস্তাব দেন, যদিও সেই পদত্যাগপত্র তার দল গ্রহণ করেনি।সাংবাদিক করণ থাপারকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অটল বিহারী বাজপেয়ী বলেছিলেন, ‘৬ ডিসেম্বর অযোধ্যায় যা হয়েছিল, তা হওয়া উচিত হয়নি।’

কিন্তু এখন সময় বদলেছে এবং বিজেপির নেতা-কর্মীরা বাবরি মসজিদ ধ্বংস নিয়ে কোনো দুঃখ প্রকাশ করেন না।বস্তুত, রাম মন্দির অভিযানে সামনের সারিতে ছিলেন যে বিজেপি নেত্রী উমা ভারতী, তিনি এ নিয়ে গর্ব অনুভব করেন।বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর উত্তর ভারত ও মুম্বাইয়ে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়।

হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিশেষজ্ঞ এবং ‘মোদিজ ইন্ডিয়া’, অর্থাৎ মোদির ভারত নামে বইটির লেখক অধ্যাপক ক্রিস্টোফ জেফরলোকে প্রবীণ সাংবাদিক ও লেখক নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রশ্ন করেছিলেন, ভারতীয়দের সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে তাদের রক্তেই ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। সত্যিই কী তাই?

জবাবে জেফরলো বলেন, ‘এখন পুরো পরিস্থিতিই পাল্টে গেছে। এখন আর আমরা বলতে পারি না যে ভারতীয়রা স্বভাবগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ। অযোধ্যা আন্দোলন যখন শুরু হয় ১৯৮৪ সালে, সেই সময়ে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা খুব কঠিন ছিল। পর পর অনেক দাঙ্গা হয় ১৯৮৯ সাল থেকে আর ওইসব দাঙ্গাগুলো মেরুকরণের ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল। আমি এটা বলতে পারি না যে কোনো মানুষ স্বভাবগতভাবে সাম্প্রদায়িক। ভয় দেখিয়ে মানুষকে সাম্প্রদায়িক বানানো হচ্ছে। শত্রুকে সামনে দাঁড় করানো হয় এবং নিরাপত্তাহীনতার ভাবনা তৈরি করা হয়।’ক্রিস্টোফ জেফরলো বলেন, ‘১৯৯২ সালে এবং তার কিছুদিন আগে থেকে হিন্দুত্ববাদীদের কর্মসূচিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ছিল, দ্বন্দ্বও ছিল, কিন্তু এখন বিজেপির পক্ষে হিন্দুদের একত্রিত করা কঠিন নয়।’

মোদি কোন নতুন কালচক্রের কথা বলছেন?
এ বছরের ২২ জানুয়ারি রাম মন্দিরে ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠার’ পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেখানে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে ভাষণ দেয়ার সময় বলেন, ‘২২ জানুয়ারি ২০২৪ শুধুমাত্র ক্যালেন্ডারে লেখা একটা তারিখ নয়, এটি একটি নতুন কালচক্রের সূচনা। আমাদের রামলালা আর তাঁবুতে নয়, একটি সুন্দর একটি মন্দিরে অবস্থান করবেন।’প্রধানমন্ত্রীর মুখে-চোখে স্পষ্টতই বিজয়ের ভাব ফুটে উঠছিল।

কিন্তু নরেন্দ্র মোদি কোন নতুন কালচক্রের কথা বলছেন? তিনি কি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে শুরু হওয়ার সময়ের কথা বলছিলেন, নাকি কোনো নতুন কালচক্রের কথা বললেন?

প্রধানমন্ত্রী মোদি ও বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ওপরে লেখা গ্রন্থের রচয়িতা নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘নতুন কালচক্র সম্পর্কে আমার জানা নেই, তবে বর্তমান কালচক্রে অনেক কিছুই দেখা যাচ্ছে। অযোধ্যার ধাঁচেই জ্ঞানবাপীর মামলা শুরু হলো, মথুরাতেও একই চেষ্টা করা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট যখন অযোধ্যা মামলার রায় দিয়েছিল, তখন তারাও বলেছিল যে এ ধরনের মামলাগুলো আর বিবেচনা করা হবে না। তবে তা হচ্ছে বলে তো দেখা যাচ্ছে না। সেই ২০১৪ সাল থেকে ভারতের সংখ্যালঘুদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। যেভাবে অনেক আইন এসেছে, তাতে সংখ্যালঘুদের প্রান্তিক পর্যায়ে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া আর নতুন কোন কালচক্রের কথা বলা হচ্ছে জানি না।’নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী মোদি ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে বিচ্ছেদ রেখাটি প্রায় মুছেই ফেলেছেন। এমনকি ভারতীয় রাষ্ট্র ও ধর্মকেও এক করে দিয়েছেন। গত তিন বছরে মোদি এমন চারটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন যেখানে ধর্ম, রাজনীতি আর ভারতীয় রাষ্ট্র মিলেমিশে গেছে।’

“এই চারটি অনুষ্ঠানেই প্রধানমন্ত্রী মোদিই প্রধান ‘উপাসক’ থেকেছেন। তিনি প্রথমে ২০২০ সালের ৫ আগস্ট অযোধ্যায় রাম মন্দিরের ভূমি পূজা করেন। এরপর ২০২০ সালের ডিসেম্বরে নতুন সংসদ ভবনের ভূমি পূজা করা হয়। তারপরে, গত বছরের মে মাসে নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন করা হয়, যে অনুষ্ঠানটি পুরোপুরিভাবেই হিন্দু প্রতীক এবং আচার মেনে সম্পন্ন করা হয়।”“হিন্দু রীতিনীতি অনুযায়ী একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সংসদের উদ্বোধন করাটাই আপত্তির কারণ। যেন হিন্দুত্ব ভারতের রাষ্ট্রধর্ম। আর চতুর্থ অনুষ্ঠানটি হলো রাম মন্দিরের উদ্বোধন। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ধর্মীয় রাষ্ট্র’ হয়ে উঠতে পারে।”

মুসলমানদের ভারতীয়ত্ব নিয়ে সন্দেহ
কংগ্রেস নেতা ও রাজীব গান্ধীর বন্ধু মণিশঙ্কর আইয়ার ‘কনফেশনস অফ আ সেকুলার ফান্ডামেন্টালিস্ট’ নামে একটি বই লিখেছেন।

বিজেপি ও আরএসএসের হাজার বছরের দাসত্ব তত্ত্বের কথা বলতে গিয়ে আইয়ার লিখেছেন, ‘মজার ব্যাপার হলো, আরএসএস যে এক হাজার বছরের সেই অহিন্দু শাসনের কথা বলে, তার মধ্যে কিন্তু সম্রাট অশোকের বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের সময় থেকে শুরু করে শেষ মহান বৌদ্ধ সম্রাট হর্ষবর্ধন পর্যন্ত সময়কালকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। অহিন্দু শাসন বলতে তারা শুধু খ্রিস্টান আর মুসলমান শাসনকালকে চিহ্নিত করে।’‘মুসলমানদের নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে নতুন কিছু নয়। হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী বিনায়ক দামোদর সাভারকর বরাবরই মুসলিমদের বহিরাগত মনে করতেন।’

‘হিন্দুত্ব : হু ইজ আ হিন্দু’ বইয়ে সাভারকর লিখেছিলেন, ‘যাদের জোর করে ইসলাম বা খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল, তাদেরও পিতৃভূমি এটাই, তারাও এই সংস্কৃতির একটা বড় অংশ, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের হিন্দু বলে গণ্য করা যায় না। এটা তাদের পবিত্র ভূমি নয়। তাদের পবিত্র ভূমি সুদূর আরবে অবস্থিত। তাদের বিশ্বাস, তাদের ধর্মগুরু, চিন্তাধারা এই ভূমিতে জন্ম নেয়নি। সেদিক থেকে দেখতে গেলে তাদের নাম আর দৃষ্টিভঙ্গির উৎস বিদেশে। তাই তাদের ভালোবাসা ভাগাভাগি হয়ে যায়।’স্বপন দাশগুপ্ত বলেন, সাভারকরের এই বক্তব্যের সাথে তিনি একমত নন।

‘সাভারকর হিন্দুত্বকে একটা বিধিতে বাঁধার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু আমার কাছে হিন্দুত্ব হলো একটি অনুভূতি। জাতীয়তাবাদ ও ধর্মকে এক করার ব্যাপারে আমি একমত নই,’ বলেন তিনি।মণিশঙ্কর আইয়ার একবার বিজেপির সাবেক নেতা অরুণ শৌরিকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘মুসলিম হওয়ার কারণে কি ভারতীয় হয়ে ওঠা কঠিন হয়ে যায়?’

এর উত্তরে অরুণ শৌরি বলেন, ‘ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করে বহু সংস্কৃতি ও বহু ধর্মের সমাজে বাস করা অসম্ভব, কারণ ইসলামের মূলনীতি অনুসরণ করে তা করা যায় না।’মণিশঙ্কর আইয়ার অরুণ শৌরিকে পাল্টা প্রশ্ন করেন- ‘তার মানে আপনি বলতে চাইছেন যে আপনি যদি একজন ভালো ভারতীয় হিসেবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন তবে আপনি খারাপ মুসলিম?’

জবাবে অরুণ শৌরি বলেন, ‘আমার মনে হয় আপনি একটু কড়া ভাষায় কথাটি বলছেন, তবে অবশ্যই তাকে কোরআন-হাদিসের মূল নীতিমালা থেকে কিছুটা সরে আসতে হবে।’গত দশ বছরে বদলে গেছে অনেক কিছুই। সংবিধানে জম্মু-কাশ্মিরের যে বিশেষ মর্যাদা ছিল, মোদির সরকার তা বাতিল করে দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে অপরাধমূলক কাজ হিসেবে বর্ণনা করেও সেখানে রাম মন্দির নির্মাণের অনুমতি দেয়। বিজেপিশাসিত রাজ্য উত্তরাখণ্ডে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হতে চলেছে।

মুকুল কেশবনের কাছে এসব কর্মকাণ্ড আসলে হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বকে স্বাভাবিকভাবে দেখানোর একটা প্রচেষ্টা। তিনি বলেন, ‘হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি হচ্ছে হিন্দু আধিপত্যের রাজনীতি। তাদের একমাত্র আদর্শিক এজেন্ডা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করা।’

সূত্র : বিবিসি