ভারতের নাগরিকত্বের প্রশ্নে উদ্বাস্তু মতুয়ারা যেভাবে তিন ভাগ হওয়ার পথে

ভারতের নাগরিকত্বের প্রশ্নে উদ্বাস্তু মতুয়ারা যেভাবে তিন ভাগ হওয়ার পথে

ভারতের নাগরিকত্বের প্রশ্নে উদ্বাস্তু মতুয়ারা যেভাবে তিন ভাগ হওয়ার পথে

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘ভোট-ব্যাঙ্ক’ যাদের নিয়ন্ত্রণে বলে মনে করা হয়, সেই হিন্দু ‘নমঃশূদ্র’ বা ‘মতুয়া’ সম্প্রদায় এবং উদ্বাস্তু সমাজের একাংশ বলছেন দেশের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা সিএএ নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস আর বিজেপি – দুটি রাজনৈতিক দলই মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছে।

উদ্বাস্তু এবং মতুয়ারা পশ্চিমবঙ্গের অন্তত ৩০টি বিধানসভা আসনে নির্ণায়ক শক্তি এবং দুটি লোকসভা কেন্দ্রেও তাদেরই ভোটে জয় পরাজয় নির্ধারিত হয়।তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যেই মূলত এতদিন মতুয়া ও উদ্বাস্তুদের রাজনৈতিক সমর্থন সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন তা তিন ভাগ হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই মতুয়ারা তাদের ধর্মগুরুর সঙ্গেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে আসেন। এরা মূলত: নমঃশূদ্র গোষ্ঠী এবং এঁদের মূল তীর্থক্ষেত্র বাংলাদেশের ওড়াকান্দিতে।মতুয়া ও উদ্বাস্তু আন্দোলনের অন্যতম নেতা সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাস বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “নাগরিকত্ব ইস্যু নিয়ে ২০০৪ সাল থেকে মতুয়াদের ঠাকুরবাড়ি থেকে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, বা সংশোধিত নাগরিকত্ব বিল আসার পরে যে লড়াই চলেছে, সে ব্যাপারে বাম নেতৃত্ব এবং কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলছিল।"

"অনেকগুলো বৈঠক করে আমরা তাদের সঠিক ভাবে বিষয়টা বোঝাতে পেরেছি। তারই ফলশ্রুতি এই ইস্যুতে আমরা যৌথ ভাবে এগোব।“বিজেপি বলছে, উদ্বাস্তুদের যে অংশটি বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের হাত ধরতে চলেছে, তারা মূলত: পাকিস্তানের প্রথম হিন্দু মন্ত্রী ও দলিত নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের ভাবধারায় বিশ্বাসী।

“যোগেন মণ্ডলের আদর্শ অনুযায়ী চলেন মতুয়াদের এই অংশটি। এঁরা পাকিস্তান থেকে তো মুসলমানদের কারণেই বিতাড়িত হয়েছিলেন, কিন্তু ভারতে এসে তারা সেই প্রসঙ্গে মুখ খোলেন না।""আবার বামপন্থীরাও দলিত-মুসলিম ঐক্যের কথা বলে। এই ধারাটাকে বলব ভারত বিরোধী ধারা”, বলছিলেন রাজ্য বিজেপির উদ্বাস্তু শাখার প্রাক্তন প্রধান ও দলটির রাজ্য কার্যকরী সমিতির সদস্য মোহিত রায়।

বাংলাদেশের ওড়াকান্দিতে যাত্রা শুরু মতুয়াদের

মতুয়ারা আসলে হিন্দু ধর্মাবলম্বী নমঃশূদ্র গোষ্ঠীর মানুষ।গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে হরিচাঁদ ঠাকুর এবং গুরুচাঁদ ঠাকুর এই সম্প্রদায়ের সূচনা করেন। ভারতের স্বাধীনতার পরে তারা নিজেদের বড় সংখ্যক শিষ্যদের নিয়ে ভারতে চলে আসেন এবং উত্তর ২৪ পরগণার ঠাকুরনগরে নিজেদের ধর্মীয় কেন্দ্র গড়ে তোলেন।

মতুয়া সম্প্রদায় এবং তাদের ধর্মগুরুরা স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয়। এক সময়ের সঙ্ঘাধিপতি প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর ছিলেন কংগ্রেস দলের সংসদ সদস্য। তার ছেলে, পুত্রবধূ এবং নাতিরাও সক্রিয় রাজনীতিতে রয়েছেন।একটা সময়ে এই মতুয়ারা প্রায় সবাই ভোট দিতেন বামফ্রন্টকে। ২০১১ সাল থেকে তারা ভোট দিতে শুরু করলেন তৃণমূল কংগ্রেসকে।আর ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে মতুয়া মহাসংঘে চিড় ধরল – একটা অংশ তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে রইল, আর অন্য অংশটির প্রধান শান্তুনু ঠাকুর বিজেপির টিকিটে জিতে সংসদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হলেন।

নাগরিকত্ব নিয়ে বিজেপি আমলেই সমস্যার শুরু ?

উদ্বাস্তু ও মতুয়াদের অন্যতম নেতা সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাস বলছিলেন তাদের নাগরিকত্ব নিয়ে সমস্যাটা শুরুই হয়েছিল ২০০৩ সালে বিজেপি সরকারের সময়কার একটি আইনের কারণে।“ওই আইনে ভারতে আসা হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ – যারা বৈধ নথি ছাড়া অথবা বৈধ নথি নিয়ে এসেও সময়সীমার পরে থেকে গেছেন ভারতে, তারা সবাই অনুপ্রবেশকারী। তাই অনুপ্রবেশকারীদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না।""অর্থাৎ বিজেপি হিন্দু-শিখ-বৌদ্ধদেরই তো অনুপ্রবেশকারী বলে ঘোষণা করল”, বলছিলেন মি. বিশ্বাস।তিনি বলছিলেন, ওই আইনের বিরুদ্ধে মতুয়া এবং উদ্বাস্তু সম্প্রদায়ের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেটা ছিল বিজেপিরই বিরুদ্ধে।

“বিজেপি তো সমস্যাটার সমাধান করেনি, অথচ মতুয়াদের সেই ঠাকুরবাড়িরই একটা অংশ বিজেপির সঙ্গে চলে গেলেন, এমপি হলেন, মন্ত্রী হলেন। তাই বিজেপির সঙ্গে এই ইস্যুতে একসঙ্গে তো আন্দোলন করা যায় না”, বলছিলেন মি. বিশ্বাস।অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেস এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বারেবারেই বলছেন যে মতুয়াদের ভোটার কার্ড আছে, তারা ভোট দেন, তাই আর কোনও নথি তাদের দিতে হবে না নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে।

সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাসের কথায়, “মমতা ব্যানার্জী এবং তৃণমূল কংগ্রেস এখন বলছে ঠিকই যে মতুয়াদের ভোটার কার্ড আছে, রেশন কার্ড আছে, তাই তারা নাগরিক।""অথচ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে তার মন্ত্রিসভা ২০১৬ সালে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে ভোটার কার্ড এবং রেশন কার্ড থাকলে এবং তিনি যদি পশ্চিমবঙ্গে পাঁচ বছর অন্তত বসবাস করেন, তাহলেই নাগরিক হওয়ার জন্য আবেদন করা যাবে।"

“আবেদন করা যাবে – এই কথাটার অর্থ তারা এখনও নাগরিক নন। তাই তাদের আবেদন করার নিয়ম বেঁধে দিচ্ছে সরকার। কিন্তু বাস্তবটা হল সরকারি চাকরির আগে বা পাসপোর্ট করাতে গেলে এই পশ্চিমবঙ্গেরই পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময়ে ভোটার কার্ড, রেশন কার্ডকে নাগরিকত্বের প্রামাণ্য নথি হিসাবে গ্রহণ করে না।""আমরা বহু বার বিষয়টি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তারা জানেন সত্যটা কী। তাই তাদের সঙ্গেও নাগরিকত্বের ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জায়গা নেই,” বলছিলেন সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাস।

কী বলছে তৃণমূল কংগ্রেস?

মি. বিশ্বাসের তোলা বিষয়গুলি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম মুখপাত্র অরূপ চক্রবর্তী বলছিলেন, “মতুয়াদের ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাসপোর্ট সবই আছে। তারা ভোট দেন, তারাই তো কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরকেও নির্বাচিত করেছেন।""তাই মতুয়ারা তো ইতিমধ্যেই নাগরিক। তারা যদি নাগরিক না হন তাহলে তো দেশের প্রধানমন্ত্রীও অবৈধ, কারণ তাদের ভোটেই তো তিনি জিতেছেন।“

মি. চক্রবর্তী আরও বলেন, “আমরা বারবার বলছি এরাজ্যে কোনও এনআরসি বা সিএএ চালু হবে না। তাই মতুয়াদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করার জন্য নতুন করে কোনও নথি চাওয়া হবে না।""বিজেপির রাজনীতিটা ঠিক উল্টো। যাদের ভোটে তারা জিতেছে, প্রথমেই তাদের অনাগরিক বানিয়ে দিয়েছে। নাগরিকত্ব চলে যাবে, এই ভয় দেখিয়ে তাদের ভোট ধরে রাখার চেষ্টা করছে বিজেপি। এর মাঝে ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমেছে বামফ্রন্ট আর কংগ্রেস।“অরূপ চক্রবর্তী মনে করিয়ে দিচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় বামফ্রন্ট আর কংগ্রেস দুই দলেরই আসন সংখ্যা শূন্য।

বাম-তৃণমূল-বিজেপি, আবারও বাম?

একটা সময়ে মতুয়াদের প্রায় সব ভোটই পেত বামফ্রন্ট। সেই সময়ে সিপিআইএম সরাসরি না হলেও বামফ্রন্টের শরিক দল ফরওয়ার্ড ব্লকে একাধিক মতুয়া নেতা-মন্ত্রী ছিলেন, তাদের মাধ্যমেই মতুয়াদের প্রধান ‘বড়মা’ বীণাপাণি দেবীর সঙ্গে বামফ্রন্টের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকত।

কিন্তু বাম আমলের শেষ দিক থেকে তৃণমূল কংগ্রেস সেই জায়গাটা দখল করে নেয়। দলের তরফে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন রেশন দুর্নীতিতে কিছুদিন আগে গ্রেফতার হওয়া মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক।রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বজিত ভট্টাচার্যের কথায়, “সেই সময়ে মতুয়া সম্প্রদায় তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে ঝুঁকেছিল কারণ তাদের মধ্যে নাগরিকত্বের নথি হাতে পাওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা রয়েছে দীর্ঘদিনের, মমতা ব্যানার্জী সেই আশ্বাস তাদের দিয়েছিলেন।"

"মতুয়ারা তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোটও দিয়েছেন ঢেলে। কিন্তু কেন্দ্রে তখন কংগ্রেস সরকার থাকা সত্ত্বেও তৃণমূল কংগ্রেস মতুয়াদের নাগরিকত্বের বিষয়টা সমাধান করতে পারেনি।"“এরপরে বিজেপি যখন সেই আশ্বাস দিল, তারাও প্রচুর ভোট পেল মতুয়াপ্রধান অঞ্চলগুলি থেকে। কিন্তু বারে বারে আশ্বাস দেওয়া হলেও সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এখনও চালু করতে পারেনি বিজেপি,”বলছিলেন মি. ভট্টাচার্য।

তিনি বলছিলেন, যে সব মানুষ পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে চলে এসেছেন, তাদের হয়তো পায়ের তলায় জমি এখন শক্ত হয়েছে, তারা এখানে কাজকর্ম করেন, কিন্তু হাতে অনেকেরই কোনও বৈধ নথি নেই।উদ্বাস্তু নেতাদের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় দুই কোটি মানুষের এখনও নাগরিকত্ব নেই।যদিও এটাও তারা স্বীকার করেন যে আইন সম্মত উপায়ে নাগরিকত্বের নথি না থাকলেও এদের সকলেই কোনও না কোনও ভাবে ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, আধার কার্ডের মতো নথি ‘জোগাড়’ করে নিয়েছেন।

তাই তারা সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী নতুন করে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন আর করবেন না বলেই মনে করছেন উদ্বাস্তু এবং মতুয়া সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের একাংশ।সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাস বলছিলেন, “এই সত্যটা যত তাড়াতাড়ি মতুয়া এবং উদ্বাস্তুরা উপলব্ধি করতে পারবেন, ততই মঙ্গল। বিষয়টা এতদিনে বাম আর কংগ্রেস নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছেন, তাই এক সঙ্গে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।“

সূত্র : বিবিসি