ভাইরাল লেখকদের বইয়ের বিক্রি ঘিরে যেসব বিষয় আলোচনায়

ভাইরাল লেখকদের বইয়ের বিক্রি ঘিরে যেসব বিষয় আলোচনায়

ভাইরাল লেখকদের বইয়ের বিক্রি ঘিরে যেসব বিষয় আলোচনায়

বাংলা একাডেমি আয়োজিত এ বছরের বইমেলার শুরু থেকেই কয়েকটি বই সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত। এর মধ্যে খন্দকার মুশতাক আহমেদের লেখা ‘তিশার ভালোবাসা’ এবং ডা. সাবরিনা হুসেনের ‘বন্দিনী’র প্রথম মুদ্রণের সব কপি ইতোমধ্যেই বিক্রি হয়ে গেছে।

কিন্তু, বইয়ের এই কাটতির পেছনে ‘কন্টেন্ট’-এর চেয়ে তাদের নিয়ে 'বিতর্ক'ই মূল ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন অনেকে।বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে আলোচিত বইগুলোর বিপণন-পরিস্থিতির খোঁজ খবর নেয়া হয় ১৩ ফেব্রুয়ারি। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও পহেলা ফাল্গুনের আবহ একটু এগিয়ে এসে শীতের শেষ দিনটিতেও যেন পড়েছিল। মেলায় আগতদের মধ্যে বর্ণিল পোশাক আর ফুলের সাজের আধিক্য।

বিকেল গড়িয়ে যতই সন্ধ্যা দিকে এগোয় ভিড় বাড়তে থাকে ক্রমশ। চার তরুণীকে দেখা গেল মিজান পাবলিশার্সের সামনে কোনো একটা বইয়ের খোঁজ করছেন। না পেয়ে হতাশ হয়ে অন্যান্য বই দেখে ফেরার পথে কথা হয় তাদের সাথে।তারা খুঁজছিলেন ‘তিশার ভালোবাসা’। কিন্তু বইটির প্রথম মুদ্রণের সব কপি বিক্রি হয়ে গেছে একদিন আগেই।নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ রেখে, ক্রেতাদের দু’জন জানালেন ঢাকার আরেক প্রান্তের মিরপুর থেকে এসেছেন তারা।

‘তিশার ভালোবাসা’ বইটি এবং এর লেখক ও তার স্ত্রীর ব্যক্তি জীবন নিয়ে গত কিছুদিন সামাজিক মাধ্যমে যে আলোচনা হয়েছে সেটিই তাদের উৎসুক করে তুলেছিলো বইটির ব্যাপারে।মিজান পাবলিশার্সের স্টলের সামনেই দেখা গেলো আগত আরেক নারী একটু উচ্চস্বরে কাউন্টারের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন, “মুশতাক-তিশা আজ আসবেন না?”ওই স্টলেই দেখা গেল দু’জন অভিনেত্রীও তাদের বইয়ের প্রচারণা চালাচ্ছেন।

প্রকাশক মিজানুর রহমান পাটোয়ারী বিবিসি বাংলাকে জানালেন, একেক মুদ্রণে তিনশ’ বই ছাপান তারা। ওই বইটির সব কপি বিক্রি হয়ে গেছে।“গত বইমেলায়ও খন্দকার মুশতাকের একটি বই বেরিয়েছিলো। সেটিও প্রায় দুই হাজার কপি বিক্রি হয়েছিলো।”“তিনি যেহেতু একটি সুপরিচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন, তার একটা সামাজিক পরিচিতি আছে, সেই পরিচিতির ভিত্তিতেই বই বিক্রি হয়েছে”, যোগ করেন মি. পাটোয়ারী।

লেখক-প্রকাশকদের কী মূল্যায়ন?

এবারের মেলায় মিজান পাবলিশার্স থেকে ১২০টি বই বেরিয়েছে। সবগুলোই ভালো করছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী।তিনি বলেন, “৪৬ বছর ধরে এই ব্যবসা করছি। আমার কাজই বই ছাপা। লেখক বই দিলেই আমি ছাপবো।”প্রকাশকদের এই দৃষ্টিভঙ্গিটাকেই দুর্ভাবনার বলে মনে করেন কথা সাহিত্যিক আনিসুল হক।

বিবিসি বাংলাকে মি. হক বলেন, “কোন বিখ্যাত খেলোয়াড় যেমন ম্যারাডোনা বা পেলের বই অনেক বিক্রি হবে। বারাক ওবামার বই অনেক বিক্রি হবে। তেমনি অন্য ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত যে কেউই বই লিখতে পারেন। এর জন্য দুর্ভাবনা করার কিছু নেই। দুর্ভাবনার বিষয় হলো বইগুলো সুলিখিত এবং সুসম্পাদিত কিনা।”আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা পেঙ্গুইন বা হারপার কলিনস্ এর উদাহরণ টানেন এই লেখক।

“এসব প্রকাশনা সংস্থা যখন একটা বই সিলেক্ট করে তখন সেই বইগুলোকে অনেকগুলো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কারো জীবনকাহিনী বা আত্মজীবনী হলে প্রথমত একজন ভালো লেখককে নিযুক্ত করে। চার পাঁচবার সম্পাদনা করে। ফ্যাক্ট চেক করে, ভাষা চেক করে।”আনিসুল হক বলেন, “বাংলাদেশে আমরা অসম্পাদিত বই বের করি। এটা আমাদের যে সার্বিক নৈরাজ্য তার প্রতিফলন। প্রকাশনা জগতও নৈরাজ্যে ভরা।”“একজন প্রকাশকের অনেকজন সম্পাদক থাকবেন। একটা সিলেকশন কমিটি থাকবে। প্রুফ দেখার মানুষ থাকবে”, যোগ করেন আনিসুল হক।

কিন্তু বাংলাদেশের প্রকাশকরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠছেন না, এটা দুশ্চিন্তার বলে অভিমত তার।সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোকে আলোচনায় এনে মি. হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, সাবরিনা জেলে গেছেন, তিনি তার অভিজ্ঞতা লিখতেই পারেন। মুশতাক-তিশা, তারা যদি তাদের অসমবয়সী প্রেম কাহিনী লিখতে চান, সেটা তারা লিখতেই পারেন।“কিন্তু এটা ভালো লেখককে দিয়ে লেখাতে হবে, ভালো সম্পাদককে দিয়ে সম্পাদনা করাতে হবে।”

অন্য বইয়ের সঙ্গে বিপণনের হারে যে পার্থক্য

করোনা মহামারির সময়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে আলোচিত নাম সাবরিনা চৌধুরী। করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণের পরীক্ষায় ভুয়া সনদ বিক্রি, প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে স্বামী আরিফুল হক চৌধুরীর সঙ্গে দণ্ডিত হয়েছিলেন তিনি।

উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়ে কারামুক্ত হন গত বছরের মাঝামাঝি। এবারের বইমেলায় তার একটি বই প্রকাশ পেয়েছে। বইটির নাম ‘বন্দিনী’।লেখক হিসেবে তার নাম অবশ্য ব্যবহার করা হয়েছে ডা. সাবরিনা হুসেন মিষ্টি। বন্দি জীবনের নানা ঘটনা উল্লেখ করেছেন তিনি এই বইয়ে। এটি তার প্রথম বই।

বইটি মেলায় এনেছে আহমদ পাবলিশিং হাউজ। এই প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান থেকে এবারের মেলায় এ পর্যন্ত ১০টি বই বেরিয়েছে।সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে ‘বন্দিনী’। ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হাজারের বেশি কপি বিক্রি হয়েছে বলে জানালেন বিক্রয় প্রতিনিধি শাহ্ আলম। বলেন সব শ্রেণির, সব বয়সের মানুষই কিনছেন এই বই।

বইটি মেলায় দুই তারিখে এলেও গত পাঁচ-ছয় দিনে বেশি বিক্রি হয়েছে বলে জানান তিনি।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঘেঁটে দেখা যায় কাছাকাছি সময়ে মিজ সাবরিনার একটি ভিডিও ব্যাপক প্রচারণা পেয়েছে। যেখানে তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে নিজের বন্দি জীবনের অভিজ্ঞতা ও নারীদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে বন্দিত্বের কথা উল্লেখ করছেন এবং তার বইটি পড়ার অনুরোধ জানাচ্ছেন পাঠকদের।

বিক্রয় প্রতিনিধি মি. আলম 'বন্দিনী'র ব্যাপক বিক্রির কথা উল্লেখ করে বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ওনাকে সবাই চেনে। উনি যেহেতু আলোচিত। ফলে তার বইয়ের ব্যাপারে আগ্রহও বেশি।”“একটার বিক্রি চলতেছে, বাকিগুলো অতটা চলতেছে না। আলোচিত লোক, ভাইরাল তো হবেই”, যোগ করেন তিনি।এই স্টলে বিক্রির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে যে বই তার বিক্রীত কপির সংখ্যা ২০০’র কাছাকাছি।

এই প্রবণতা শুধু বইমেলা কেন্দ্রিক?

বাংলাদেশের প্রকাশনা খাতের প্রতিষ্ঠিত নামগুলোর একটি মাওলা ব্রাদার্স। এর স্বত্বাধিকারী ও প্রকাশক আহমেদ মাহমুদুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় বিবিসি বাংলার।সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ভাইরাল’ হওয়া ঘটনার প্ররিপ্রেক্ষিতে বই বিক্রির হারের ঊর্ধ্বমুখিতাকে ‘বিক্ষিপ্ত’ ঘটনা হিসেবে দেখতে চান তিনি।

“নিয়মিত প্রকাশনার ওপর এগুলোর কোনো রকম প্রভাব থাকবে না। এগুলো বইমেলা কেন্দ্রিক, এই একমাসই বইগুলোর তেমন বিক্রি থাকবে।”“মেলায় নতুনভাবে পাঠক যারা আসে, যেখানে জটলা দেখে সেখান থেকে বই সংগ্রহ করে”, মন্তব্য মি. আহমেদের।তিনি আরও যোগ করেন, “আলাদা একটা ফোকাস থাকে মেলাকে কেন্দ্র করে। সব মিডিয়া মেলাকে সারা মাস প্রচারের আলোয় রাখে। এসবে উৎসাহিত হয়ে অনেকে বই লেখেন।”

কেবল আলোচিত বইয়ের প্রতি পাঠকদের একটা অংশের সাময়িক ঝোঁককে মেলারই একটা অনুষঙ্গ হিসেবেই মনে করেন মাওলা ব্রাদার্সের প্রকাশক।সাহিত্যিক আকিমুন নাহার অবশ্য এই ঝোঁকের পেছনে বড় দায় দেখছেন গণমাধ্যমের।বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “আগেও এমন বই ভূরি ভূরি বেরিয়েছে। কিন্তু, সময়ে এসেছে সময় হারিয়ে গেছে।”

“কিন্তু এখন মানুষ লাফাচ্ছে, মিডিয়াগুলোকে সেটা দেখাতে হচ্ছে। ফোকাস দেয়ার জন্য সকলে উঠে পড়ে লেগে গেছি। এর কারণ, আমাদের অন্তঃসারশূন্যতা।”ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে যুগে যুগে বই লেখা হয়েছে মন্তব্য করে আকিমুন নাহার আরও বলেন, “জনমনোযোগ আকর্ষণের ব্যাকুলতা সকলেরই আছে।”“প্রকাশকের কাছে এটা তো পণ্য। তারও তো ব্যবসাটা করতে হবে। ফলে তিনি তার মতো করেই বই বের করবেন”, যোগ করেন মিজ নাহার।

অন্যান্য প্রকাশনা সংস্থার স্টলে গিয়েও পাঠকরা এই আলোচিত বইগুলোর খোঁজ করেন।মাওলা ব্রাদার্সের বিক্রয় প্রতিনিধি শাহীন আহমেদ বলেন, “অনলাইনে যেগুলো দেখে সেগুলোর খোঁজ করে বেশিরভাগ মানুষ।”“ঘুরতে আসছে হয়তো একটা বই কিনে নিলো, জানেই না যে এই বইয়ের টপিক কী। কেউ সুন্দর নাম দেখে নেয়, কেউ কন্টেন্ট পড়ে ভালো লাগছে সেজন্য নেয়, কেউ হয়তো বেশি বিক্রি হচ্ছে শুনে নেয়।”

বিক্রিবাট্টা সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন, অবসর প্রকাশনীর বিক্রয় প্রতিনিধি এ এইচ এম কামরুজ্জামান।“যারা অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট কিংবা ইউটিউবার, অনলাইনে যাদের পরিচিতি আছে তাদের বই বিক্রি হয় বেশি”, বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।“তবে তিন ‘বন্দোপাধ্যায়’ যাদের ছাড়া বাংলা সাহিত্য কল্পনা করা যায় না, তারাশঙ্কর, মানিক, বিভূতিভূষণ এখনো বিক্রির সংখ্যায় ওপরের দিকে”, যোগ করেন মি. কামরুজ্জামান।

'যা সাহিত্য সেটাই কেবল টিকে থাকবে'

মেলায় ব্যাপক হঠাৎই ব্যাপক পরিচিত পাওয়া এই লেখকদের সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা খুব একটা দেখা যায় না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।'এক মেলায় হুলুস্থূল ফেলে দিয়ে পরের মেলায় পাত্তা নেই', এমন লেখকদের ভেতরে লেখক সত্ত্বা কতটা আছে তা নিয়েও প্রশ্ন রাখেন কেউ কেউ।গণমাধ্যমকর্মী ফারহানা ন্যান্সি এক যুগের বেশি সময় ধরে বইমেলা কাভার করছেন।বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “কারো কারো ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা দেখা গেছে দুয়েক বছর। কিন্তু খুব যে টিকে থাকে তা কিন্তু না।”

“কোনো অভিনেত্রীর অভিনয় হয়তো ভালো লাগে। বইয়ের কন্টেন্ট যাই হোক, অভিনয়ের প্রতি ভালো লাগা থেকেই তার বই নেয়”, যোগ করেন তিনি।বইমেলায় লেখক-পাঠকের মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া জোরদার হয়। পাঠকরা তাদের মতামত জানান। কোনো পর্যবেক্ষণ থাকলে তা তুলে ধরেন। লেখকরাও আলোচনা করেন সেগুলো নিয়ে।

“কিন্তু, এটা ভাইরাল লেখকদের সাথে সাধারণত হয় না। কারণ ওই বইটা হয়তো পাঠক পড়েও দেখে না”, বলছিলেন মিজ ন্যান্সি।তবে সাহিত্যের ক্ষেত্রে এ ধরনের চর্চা নিয়ে উৎকণ্ঠিত হওয়ার কিছু নেই বলেই মনে করে সাহিত্যিকদের অনেকে।লেখক আনিসুল হক যেমন এই বিষয়টিকে অভিহিত করলেন 'এক মেলার সুপারহিট' বলে।বলেন, “কেবল ভালো সাহিত্যই টিকে থাকে। কাজেই যা সাহিত্য সেটাই কেবল টিকে থাকবে।”

সূত্র : বিবিসি