টেকনাফ সীমান্তের অন্য পাশে মিয়ানমারে যুদ্ধের যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে

টেকনাফ সীমান্তের অন্য পাশে মিয়ানমারে যুদ্ধের যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে

টেকনাফ সীমান্তের অন্য পাশে মিয়ানমারে যুদ্ধের যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে

কিছুদিন ধরে বাংলোদেশের নাইক্ষংছড়ি, ঘুমধুম বা তমব্রু সীমান্তের অন্যপাশে মিয়ানমারের ভেতরে যে বিদ্রোহীদের সাথে সামরিক জান্তার যে যুদ্ধ চলছিল, তা এখন টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের সীমান্তের অন্যপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে।

টেকনাফ ও নাফ নদীর অন্য পাশে মংডু শহরের আশেপাশের এলাকা থেকে গত দুই দিন ধরে ভারী গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।প্রায় দুই সপ্তাহ আগে যখন সংঘাত শুরু হয়, তখন প্রথম কয়েকদিন সারাদিন ধরেই গুলি আর বোমার আওয়াজ পাওয়া গেছে ঘুমধুম সীমান্তের বাংলাদেশ সংলগ্ন গ্রামগুলো থেকে।সেসব এলাকা মূলত বাংলাদেশের বান্দরবান, কক্সবাজার এবং ভারতের মেঘালয় রাজ্য ঘেষা এলাকা।

এখন গত কয়েকদিন ধরে গুলি আর বোমার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে নাফ নদীর কাছাকাছি অবস্থিত সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে। শুরুর দিকের মত টানা শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না, আওয়াজ আসছে থেমে থেমে।ফলে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য সেন্টমার্টিন্স দ্বীপে পর্যটকদের চলাচল কমে গেছে।মংডু ও অন্যপাশে মিয়ানমার অংশে যুদ্ধ নিয়ে সর্বশেষ কী তথ্য জানা যাচ্ছে?

যুদ্ধের সবশেষ পরিস্থিতি কী?

এ মাসের শুরুর দিকে বাংলাদেশের কক্সবাজার ও বান্দরবান সীমানার সাথে লাগোয়া বেশ কয়েকটি সীমান্ত রক্ষীদের চৌকি দখলে নিয়েছিল আরাকান আর্মি সহ সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপগুলো। ঐ ঘটনার পরই বাংলাদেশে পালিয়ে আসে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সদস্যরা।গত কিছুদিন ধরে দখল হয়ে যাওয়া সেসব চৌকি ও অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিভিন্ন বাহিনী একযোগে রাখাইনের বিভিন্ন স্থানে আরাকান আর্মির অবস্থান লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে বলে খবর প্রকাশ করেছে মিয়ানমারের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম।

থাইল্যান্ড ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইরাবতী তাদের খবরে জানিয়েছে যে রাখাইনের রামরি শহরে বিমান, স্থল ও নৌ আক্রমণ জোরদার করেছে সামরিক জান্তা। রাখাইন রাজ্যের উত্তরাংশের রাথেডওং শহরে বিমান ও স্থল হামলার তীব্রতাও বেড়েছে।আরাকান আর্মির বরাত দিয়ে ঐ খবরে বলা হয়েছে রাথেডওং ও মংডু অঞ্চলে গত কয়েকদিন সামরিক বাহিনীর সাথে আরাকান আর্মির তীব্র যুদ্ধ হয়েছে।

রাথেডওং অঞ্চলের বেশ কয়েকটি গ্রামে শুক্রবার সকালে জান্তা বাহিনীর বিমান হামলায় আগুন লেগে যায় বলে জানাচ্ছে রাখাইন অঞ্চলের খবর প্রকাশ করা ঢাকা ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নারিনজারা নিউজ। তবে গ্রামের বাসিন্দারা আগে থেকেই পালিয়ে যাওয়ায় ঐ হামলায় হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।

এর আগের দিন আরাকান আর্মি রাখাইনের দক্ষিণ মংডুতে একটি চেকপোস্ট দখলের উদ্দেশ্যে সেখানে হামলা চালায়। জবাবে মিয়ানমারের বিমানবাহিনী জেট ফাইটার দিয়ে বোমা হামলা চালায় সেসব অঞ্চলে। দক্ষিণ মংডু অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দাদের বরাত দিয়ে এই খবর প্রকাশ করেছে নারিনজারা নিউজ।অন্যদিকে আরাকান আর্মিও রাখাইন অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় সামরিক জান্তার পোস্টে হামলা চালিয়ে সেগুলোর দখল নেয়া অব্যাহত রেখেছে বলে খবর প্রকাশ করেছে মিয়ানমার ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা বার্মিজ নিউজ ইন্টারন্যাশনাল, বিএনআই।

তাদের খবরে তারা জানাচ্ছে বৃহস্পতিবার রাখাইনের উত্তরাঞ্চলের মিয়েবন শহরের পুরোপুরি দখল নেয় আরাকান আর্মি। ঐ শহরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অধীনে থাকা সবগুলো ঘাঁটি, পুলিশ স্টেশন ও অন্যান্য সেনা চৌকির সবগুলো এখন আরাকান আর্মির দখলে।তবে ঐ শহরে থাকা মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর সদস্য, পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা, কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরা ১২ই ফেব্রুয়ারি ভোররাতে পালিয়ে যায় বলে বলা হচ্ছে বিএনআই’এর খবরে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাখাইনের আরও কয়েকটি শহর থেকে অবস্থান সরিয়ে নিচ্ছে বলেও খবর প্রকাশ করছে সংবাদ মাধ্যমগুলো। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি স্থানীয় পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদেরও সেসব জায়গা থেকে সরিয়ে নেয়া অব্যাহত রয়েছে বলে জানাচ্ছে সংবাদমাধ্যমগুলো।

শুক্রবার রাতে রাখাইনের টাঙ্গুপ জেলার মাএই শহর থেকে সামরিক জান্তার সেনাবাহিনী নিজেদের অবস্থান প্রত্যাহার করেছে বলে স্থানীয়দের বরাত দিয়ে খবর প্রকাশ করেছে নারিনজারা নিউজ।রাতে নিজেদের ঘাঁটি ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় তাদের ওপর আরাকান আর্মি হামলা করে এবং সেসময় হওয়া যুদ্ধে আশেপাশের কয়েকটি গ্রামে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে নারিনজারা নিউজ জানাচ্ছে। ঐ সময় আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের কিছু বাসিন্দা আহত হয়েছেন বলেও স্থানীয়দের বরাত দিয়ে জানানো হচ্ছে খবরে।

আরাকান আর্মির দাবির ভিত্তিতে বিএনআই জানাচ্ছে যে এরই মধ্যে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পালেতওয়া সহ পকতও, কিয়াকতও, মিয়েবন সহ দশটিরও বেশি শহরের পূর্ণ বা আংশিক দখল আরাকান আর্মি নিয়েছে। সেসব অঞ্চলের সেনা ঘাঁটি, পুলিশ স্টেশন ও সেনাবাহিনীর সরঞ্জাম আরাকান আর্মির দখলে রয়েছে বলে খবরে বলা হচ্ছে।নারিনজারা নিউজের খবরে বলা হচ্ছে সাতই ফেব্রুয়ারির পর থেকে এখন পর্যন্ত মিয়ানমার নৌবাহিনীর অন্তত নয়টি নৌযান দখল করেছে আরাকান আর্মি।

অন্যদিকে বাংলাদেশের সীমান্তের নিকটবর্তী মংডু, রাথেডওং আর রামরি শহরের দখল নেয়ার জন্য আরাকান আর্মি সেসব এলাকায় সামরিক জান্তা সমর্থিত বাহিনীর ওপর হামলা জোরদার করেছে বলে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের বরাত দিয়ে খবর প্রকাশ করেছে ইরাবতী।তবে মিয়ানমারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে একাধিক বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, বিদ্রোহীদের হাতে সামরিক বাহিনীর পর্যুদস্ত হওয়ার যেসব খবর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে, তা সঠিক নয়।

এরকম পরিস্থিতিতে যুদ্ধ চলতে থাকা অঞ্চলগুলোতে মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে বলে বলছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে গত ১৩ই নভেম্বর আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর মধ্যে নতুন করে সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে রাখাইন অঞ্চলে অন্তত এক লাখ মানুষ বাস্তু চ্যুত হয়েছে।

মিয়ানমারে যে জান্তা সরকার বড় ধরনের সংকটে পড়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় কয়েকদিন আগে তরুণদের সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়ার নির্দেশে। খন থেকে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী সকল পুরুষকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে অন্তত দুই বছর কাজ করতে হবে।সংঘাত পূর্ণ এলাকাগুলো ছেড়ে যে স্থানীয় বাসিন্দারা পালাচ্ছেন, এদের অনেকেই বাংলাদেশের সীমান্তের কাছে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে বলে উঠে এসেছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে।

হংকং ভিত্তিক ওয়েবসাইট বিএনএন নিউজ ব্রেকিং জানাচ্ছে বাংলাদেশের সীমান্তের কাছে নাফ নদীতে ছোট ছোট নৌকায় কয়েকদিন ধরে ভাসমান অবস্থায় রয়েছে এক হাজারেরও বেশি মানুষ।বিদ্রোহীদের সাথে জান্তা বাহিনীর যুদ্ধ চলাকালীন সময় গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে নাফ নদীতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে বলা হচ্ছে বিএনএন নিউজ ব্রেকিংয়ের খবরে।

গত বছরের নভেম্বরের ১৩ তারিখে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বাহিনীর মধ্যে নতুন করে সহিংস যুদ্ধ শুরু হয়। মূলত রাখাইনের উত্তরাংশে এবং পার্শ্ববর্তী চিন রাজ্যের পালেতওয়া শহরে জান্তা বাহিনীর ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালানো শুরু করে আরাকান আর্মি।এর আগে প্রায় এক বছর রাখাইন রাজ্যে সাময়িক যুদ্ধবিরতি কার্যকর ছিল।আরাকান আর্মি দাবি করছে, ১৩ই নভেম্বরের পর থেকে এখন পর্যন্ত তারা জান্তা বাহিনীর ১৭০টিরও বেশি চৌকি ও ঘাঁটি দখল করেছে। পাশাপাশি চিন রাজ্যের পালেতওয়া ছাড়া রাখাইন রাজ্যের অন্তত ছয়টি পুরোপুরি দখল করেছে বলে দাবি করছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি।

সূত্র : বিবিসি