বিদেশি নাগরিক অভিযোগে ভারতের জাতীয় পরিচয়পত্র বন্ধ হচ্ছে অনেকের

বিদেশি নাগরিক অভিযোগে ভারতের জাতীয় পরিচয়পত্র বন্ধ হচ্ছে অনেকের

বিদেশি নাগরিক অভিযোগে ভারতের জাতীয় পরিচয়পত্র বন্ধ হচ্ছে অনেকের

বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা নদীয়া জেলার সুপ্রিয়া মণ্ডল, উত্তর ২৪ পরগণার লিপি কর্মকার বা কলকাতা লাগোয়া নিউ টাউন এলাকার পূর্ণিমা মণ্ডল – সবাই গত এক সপ্তাহের মধ্যে একটা সরকারি চিঠি পেয়েছেন, যা তাদের ভাষায় , ‘মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়েছে’।

অনেক পরিবারে শুরু হয়েছে কান্নাকাটি। তারা প্রশ্ন করছেন, ‘ভারতে থাকার শর্ত পূরণ’ করা যায় নি, এর অর্থ কী দেশ থেকে বার করে দেওয়া হবে তাদের?চিঠিটি এসেছে ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন অথরিটি অফ ইন্ডিয়া, এক কথায় ‘আধার’ কার্ড দেয় যে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্তৃপক্ষ, তাদের কাছ থেকে।

‘আধার’ ভারতের জাতীয় পরিচয় পত্র, কিন্তু তা নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র নয়।তবে আধার কার্ডের সঙ্গে ব্যাংক থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুযোগ সুবিধা যুক্ত আছে। যাদের আধার নিষ্ক্রিয় বা অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছে, তারা প্রশ্ন তুলছেন এখন তাহলে তারা ব্যাংক বা অন্যান্য সরকারি পরিষেবা কী করে পাবেন?

একই বয়ানের চিঠি পেয়েছেন হুগলী, পূর্ব বর্ধমান সহ বিভিন্ন জেলার মানুষ। এদের কেউ কেউ বাংলাদেশ থেকে এসেছেন ঠিকই, তবে তা দীর্ঘদিন আগে। কারও আবার পূর্ব পুরুষরা পূর্ব পাকিস্তান অথবা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, আবার কারও পূর্ব পুরুষরা চিরকালই ভারতেরই নাগরিক।এরকম কয়েকজনের সাথে কথা বলেছে বিবিসি।যারা চিঠি পেয়েছেন, তাদের অনেকেই নিজের নাম প্রকাশ করতে চান নি এই কথা বলে, “এই চিঠি পাওয়ার পরে এমনিতেই ভয়ে আছি, যদি নাম বেরিয়ে যায়, তাহলে যদি বড় কোনও বিপদ হয়!“

কোথাও ২০,৩০,১৫ জনকে চিঠি

গত চার দিন ধরে বিবিসি পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি জেলা থেকে তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করেছে যে কত ‘আধার’ কার্ড নিষ্ক্রিয় করার চিঠি এসেছে।দেখা যাচ্ছে, কোনও এলাকায় ২০ জন, কোথাও জনা ৩০, কোথাও সাত-আটজন আবার কোনও এলাকায় জনা ১৫ ‘আধার’ নিষ্ক্রিয় হওয়ার চিঠি পেয়েছেন।

কলকাতা লাগোয়া নিউ টাউন এলাকার বাসিন্দা জয়ন্ত মণ্ডলের স্ত্রী পূর্ণিমা মণ্ডলের কাছে ওই চিঠি আসে গত বুধবার, ১৪ই ফেব্রুয়ারি।মি. মণ্ডল বলছিলেন, “এই চিঠি পেয়ে তো প্রথমে বুঝতেই পারি নি যে কী ব্যাপার। ডাকঘর থেকে দিয়ে গেল। তারপর এলাকার মান্যিগণ্যিদের দেখালাম। এ তো দেখছি স্ত্রীর ‘আধার’ কার্ড নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার চিঠি!”

তার জানাশোনার মধ্যেই অন্তত সাত-আট জন এই চিঠি পেয়েছেন।কিন্তু বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা জেলা নদীয়ার নাকাশিপাড়া এলাকার বাসিন্দা সুমি বিশ্বাসের জন্ম ভারতেই। ওই জেলারই রাণাঘাটে জন্মিয়েছেন তিনি। তবুও তার কাছেও এসেছে ‘আধার’ নিষ্ক্রিয়করণের চিঠি।

মিসেস বিশ্বাস বলছিলেন, “হঠাৎ করেই এই চিঠি পেলাম এক সপ্তাহ আগে। আমার তো মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়েছে। এখন কী হবে?“আধারের সঙ্গে ব্যাঙ্ক থেকে শুরু করে সব সরকারি পরিষেবা যুক্ত হয়ে আছে। ‘আধার’ বাতিল মানে তো ব্যাংকের কাজ বা রেশনের চাল কিছুই নিতে পারব না। গরীব মানুষ আমরা, খেটে খাই, জমি জায়গা নেই। রেশনের চালই খাই, সেটাও যদি বন্ধ হয়ে যায়, খাব কী?”বলছিলেন মিসেস বিশ্বাস।

বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা, নদীয়া জেলারই কৃষ্ণগঞ্জ এলাকার তৃণমূল কংগ্রেস নেতা সুশীল বিশ্বাস বলছিলেন যে তার এলাকায় গত এক সপ্তাহে জনা ১৫ মানুষ এই চিঠি পেয়েছেন।নলিন বিশ্বাস, সুপ্রিয়া মণ্ডল, নয়নতারা মণ্ডলের হাতে যে চিঠি এসেছে, তা তিনি বিবিসিকে পাঠিয়েছেন।

মি. বিশ্বাস বিবিসিকে বলছিলেন, “আমাদের এলাকাটির নাম বাবলাবন। গত এক সপ্তাহে এই একটা অঞ্চলেই ১৫ জন আমার কাছে এসেছেন এই চিঠি নিয়ে। ইন্টারনেটে দেখা যাচ্ছে যে ইতিমধ্যেই তাদের ‘আধার’ কার্ড নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়েছে। কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেছে এলাকায়।''“এদের কেউ কেউ বাংলাদেশ থেকে এসেছেন ঠিকই, তবে সেটা বছর কুড়ি আগে। এখন তো এরা ভারতের নাগরিক, তাহলে ভারতে বসবাসের শর্ত পূরণ না করতে পারার’ কথা বলা হচ্ছে কেন,” বলছিলেন মি. বিশ্বাস।উত্তর ২৪ পরগণা জেলার অশোকনগর কল্যানগড় এলাকার বাসিন্দা লিপি কর্মকারের নামেও একই বয়ানের চিঠি এসেছে।

সেখানে যে ফোন নম্বরটি ‘আধার’ কর্তৃপক্ষ দিয়েছে, সেই ফোনে কল করে দেখা গেল যে সেটি তার পুত্রের ফোন নম্বর।তিনি নিজের নাম বলতে চাইলেন না, তবে বললেন, তার বাবা শ্যামল কর্মকার দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ, শয্যাশায়ী।‘আধার’ নিষ্ক্রিয়করণের চিঠি পেয়ে তারাও অবাক।বেশি কথা বলতে চাইলেন না লিপি কর্মকারের পুত্র, নিজের নামটাও বললেন না।তবে এটা বললেন, “এরকম একটা সরকারি চিঠি পেয়ে ভয়ানক দুশ্চিন্তায় পড়েছি আমরা।''

 ‘বিদেশিসংক্রান্ত আইনে চিঠি

যতজনের কাছে থেকে ‘আধার’ অকার্যকর করার বা নিষ্ক্রিয় করার চিঠি দেখতে পেয়েছে বিবিসি, সবগুলিতেই লেখা আছে যে ‘আধার নথিভুক্তি ও হালনাগাদ’ সংক্রান্ত যে বিধি ২০১৬ সালে চালু করেছিল আধার কর্তৃপক্ষ, তার ২৮ (এ) ধারা অনুযায়ী পরিচয়পত্রগুলি নিষ্ক্রিয় করা হচ্ছে।

ইউআইডিএআই, বা ‘আধার’ কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে ওই বিধির যে প্রতিলিপি আপলোড করা আছে, সেখানে ২৮ (এ) ধারার প্রথমেই লেখা আছে যে ইতিমধ্যেই ‘আধার’ নম্বর আছে অথবা যিনি নথিভুক্ত করাতে চাইছেন, এমন বিদেশি নাগরিকদের ‘আধার’ নম্বর নিষ্ক্রিয় করা হতে পারে দুটি কারণে।প্রথমটি, ভারতে থাকার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে, দ্বিতীয়ত পাসপোর্ট আইন অনুযায়ী ভারতে প্রবেশের অথবা বসবাসের শর্ত পূরণ না করতে পারলে ‘আধার’ নিষ্ক্রিয় করা হতে পারে।

ভারতের প্রবেশ আর বসবাসের মেয়াদের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৯২০ সালের পাসপোর্ট আইনে যে সব বিধি এবং নির্দেশিকা নানা সময়ে জারি করেছে, সেগুলোই এক্ষেত্রে মান্য হবে, এমনটাও লেখা আছে ‘আধার’ কর্তৃপক্ষের তরফে ২০১৬ সালে বিধিতে।পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু আন্দোলনের অন্যতম নেতা সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাস এমন ৫০-৬০ জনের সঙ্গে কথা বলেছেন, যাদের কাছে ‘আধার’ নিষ্ক্রিয় হওয়ার চিঠি এসেছে।

মি. বিশ্বাস বিবিসিকে বলছিলেন, “এদের একটা বড় অংশ বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষ। আমি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারব না, কিন্তু যতটুকু আমাদের সংগঠনের মাধ্যমে খবর পেয়েছি, এদের একটা বড় অংশ বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে দুই দেশে যাতায়াত করতেন।

“হয়তো কারও ছেলে মেয়ে ভারতে থাকে, বাবা মা বাংলাদেশে। সবকিছু গুটিয়ে নিয়ে এরা হয়তো ভারতে পাকাপাকিভাবে চলে আসেন নি। ভবিষ্যতের কথা ভেবে হয়তো তারা ভারতে ‘আধার’ কার্ডটা করে রেখেছেন। তবে ১০-১৫ বছর ধরে হয়তো ভারতেই থেকে গেছেন। কিন্তু তিনি ‘আধার’ কার্ড করার পরেও যেহেতু বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে আসা যাওয়া করেছেন, ভিসার মেয়াদ বাড়ান নি, তাই তাদের ব্যাপারটা বিদেশি ধারায় গণ্য করা হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে ,” বলছিলেন মি. বিশ্বাস।

 ‘ভয় দেখানো হচ্ছে

সম্প্রতি একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও বিজেপি নেতা মন্তব্য করেছেন যে অতি দ্রুত সারা দেশে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন চালু করা হবে।

‘আধার’ নিষ্ক্রিয় করার যে চিঠি পাঠানো হচ্ছে, তার সঙ্গে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা সিএএ চালুর সম্পর্ক না থাকলেও বিদেশী চিহ্নিত করার জন্য যেভাবে আসামে এনআরসি চালু করা হয়েছিল, এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে তার যোগ রয়েছে বলে অভিযোগ উঠছে।

পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি এবং সিএএ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক, বর্তমানে তৃণমূল কংগ্রেস দলের রাজ্যসভার সংসদ সদস্য সামিরুল ইসলাম বলছিলেন, “এটা একটা চক্রান্ত হচ্ছে। ভোটের আগে ভয় দেখানোর একটা চক্রান্ত। ভয় দেখানো হচ্ছে যে এনআরসি, সিএএ চালু করে দেওয়া হচ্ছে। বিশেষত এটা করা হচ্ছে মতুয়া সম্প্রদায়, তপশীলি জাতিভুক্ত মানুষদের।

“যারা ভোট দিচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে, তাদের কীভাবে ‘আধার’ কার্ড নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া যেতে পারে?কীভাবে বলা যেতে পারে যে তারা ভারতে থাকার শর্ত পূরণ করতে পারেন নি?'' প্রশ্ন মি. ইসলামের।পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে চিঠি পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে।তিনি জানতে চেয়েছেন যে কেন হঠাৎ করে বহু মানুষের ‘আধার’ কার্ড নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হচ্ছে?

মিজ ব্যানার্জী লিখেছেন, “আশ্চর্যজনকভাবে আধার কার্ড নিষ্ক্রিয় করার আগে কোনওভাবে সতর্ক করা হয় নি, কার্ড ধারকদের নিজেদের বক্তব্য পেশ করার কোনও সুযোগ দেওয়া হয় নি, যেটা আধার বিধির ২৯(১) ধারা এবং স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।

“আমি আপনার কাছে জানতে চাই যে হঠাৎ করে কোনও কারণ না দেখিয়ে এভাবে আধার কার্ড নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার কারণ কী? যোগ্য ব্যক্তিদের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার জন্য, না কি লোকসভা ভোটের ঠিক আগে মানুষের মনে একটা ভীতি সঞ্চার করার জন্য এটা করা হচ্ছে?” লিখেছেন মমতা ব্যানার্জী।তিনি এটাও ঘোষণা করেছেন, যাদের ‘আধার’ কার্ড নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাদের অভিযোগ জানানোর জন্য একটি পোর্টাল চালু করবে মঙ্গলবার থেকে।

পূর্ব ভারতে আধার কর্তৃপক্ষের মূল দপ্তর ঝাড়খণ্ডের রাঁচিতে। সেখানে এবং দিল্লির সদর দপ্তরে একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে বিবিসি। কিন্তু কোনওভাবেই ইউআইডিএআইয়ের বক্তব্য পাওয়া যায় নি।এমনকি, ‘আধার’ নিষ্ক্রিয় করার কথা জানিয়ে চিঠিগুলিতে যে ‘হেল্পলাইন’ নম্বর দেওয়া হয়েছে, সেখানেও কল করা যাচ্ছে না।

সূত্র : বিবিসি