বিশ্ব পুঁজিবাদ তৃতীয বিশ্বের ভাষা পছন্দ করে না- গোলটেবিল বৈঠকে বক্তরা

বিশ্ব পুঁজিবাদ তৃতীয বিশ্বের ভাষা পছন্দ করে না- গোলটেবিল বৈঠকে বক্তরা

ছবি: প্রতিনিধি

নিজস্ব প্রতিবেদক: ফ্রান্স, গ্রিস কিংবা জার্মান নিজেদের ভাষায় উচ্চশিক্ষা দিচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া, চিন কিংবা উত্তর কোরিয়াও নিজেদের ভাষা শক্তিশালী করেছে বিভিন্ন দফতরে। কারণ তারা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ও কৌশলী। বাংলাদেশেএখনও সেই জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। কারণ বাংলা এদশে জীবিকার ভাষা হতে পারে নি। কেউ ইংরেজিতে ভালো- তার মানেই তার চাকরিটি অনিবার্য। অথচ বাংলা ভালো লিখতে কিংবা বলতে পারলেও তার চাকরি হচ্ছে না। ‘আমার ভাষা আমার শক্তি’ শীর্ষক গোল টেবিল বৈঠকে এসব বলেছেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার বিশিষ্টজনেরা।

অনুষ্ঠানের আয়োজক সম্প্রীতি বাংলাদেশ। সংগঠনটির আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় সঞ্চালনার ফাঁকে ফাঁকে উপস্থিতিকে ধরিয়ে দেন ভাষা বাংলার হালফিল অবস্থা । তার রেশ ধরে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষাভাষীর লিখিয়ে ও বক্তাদের করণীয় উঠে আসে শনিবারের সেমিনারে।

রাজধানী ঢাকার সিরডাপ মিলনায়নের অনুষ্ঠিত ‘আমার ভাষা আমার শক্তি’ শিরোনামের এ সেমিনারে প্রাধান্য পায় দুই বাংলায় বাংলা ভাষার জেরবার অবস্থা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা বিশিষ্ট কবি ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। যাঁর বর্ণনায় প্রাধান্য পায়- ভাষা বাংলাকে উচ্চকিত করতে সরকারের তাবৎ পরিকল্পনা। তাঁর অভিমত, অবিলম্বে ভাষা নীতি প্রয়োজন। ভাষার মৃত্যু মানেই সভ্যতার মৃত্যু। সুতরাং হাজার বছরের বাঙালি ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষায় ভাষা নীতি খুব জরুরী হয়ে পড়েছে।

তাঁর অভিমত, এখনও কিছু লোক ইংরেজিতে দাওয়াত কার্ড করে। তারা আসলে অন্যদের থেকে নিজেদের আলাদা করেতে চায়। মূলত: এটি তাদের মানসিক রুগ্নতার লক্ষণ। বিভিন্ন সাইনবোর্ডে ইংরেজি লেখার আধিক্য এখনও রয়েছে। আর বাংলা অক্ষরগুলো খুবই ছোট আকারে লেখা থাকে। এটি অবশ্যই দুঃখজনক। কলকাতায় এই অবস্থা আরো ভয়াবহ। এই সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে দ্রুত সকল বই বাংলায় অনুবাদের পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে একটি নীতিমালা তৈরি করতে হবে যেন বাংলার ব্যবহার বৃদ্ধি পায়।

অনুষ্ঠানে মুখ্য আলোচক ছিলেন অধ্যাপক ড. পবিত্র সরকার। যিনি ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত , সাহিত্যিক, নাট্যসমালোচক ও পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। টানা সাত বছর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর থাকাকালীর তিনি বহির্বিশ্বে কিভাবে বাংলাকে দেখেছেন তা আলোচনায় আনেন। তাঁর অভিমত, এক সময় বলা হতো বাংলায় ধর্মগ্রন্থ পড়লে নরকে যাবে। এখনও একটি শ্রেণি বিশেষ ভাষাকে এমন অবস্থানে পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর। তবে ব্যবসায়িক বিশ্বায়নে বাংলাকে তুলে ধরলে শঙ্কা অনেকাটাই দূর হবে।

মঙ্গলকাব্য থেকে শুরু করে অনেক গ্রন্থে যেমন কৌশলে বাংলাকে উপস্থাপন করা হয়েছে তেমনি মাতৃভাকে এখনও তুলে ধরার পক্ষে অবস্থান ডক্টর পবিত্র সরকারের।

অধ্যাপক সরকার আরও বলেন, ইংরেজির শক্ত অবস্থান বিবেচনা করেই বাংলার প্রাধান্য রক্ষা সম্ভব। কারণ সবাই জানে ও বোঝে, ইংরেজি শিখলে চাকরি হয়। এমনকি আরবি জানলেও কর্ম হয়! এই বাস্তবতার নিরিখেই বাংলাকে শক্তিশালী করতে হবে বিশ্বের সঙ্গে তাল রেখে। নিজের ভাষার পাশাপাশি অন্য ভাষাও শিখতে হবে।

এতো সব বৈসাদৃশ্যের পরও বাংলাকে পৃথিবী এখন চিনেছে বলে দাবি করেন শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার। তাঁর অভিমত, শক্তিশালী ভাষা নিচের ভাষাকে ক্রমশ গৌণ করে দেয়। বাংলা সে অবস্থায় এখনও যায় নি।

অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষার ব্যাপারে আরও সজাগ হওয়ার আহ্বান জানান রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ডক্টর বিশ্বজিৎ ঘোষ। তাঁর মতে, বিশ্ব পুঁজিবাদ তৃতীয় বিশ্বের ভাষাকে মেনে নিতে চায় না। আমাদের সুবিধা যে, নিজের টাকায় আমরা পদ্মাসেতু করছি। এ কারণে দেশের মান বেড়েছে বিদেশে। অর্থনীতি শক্তিশালী হলে ভাষার মান এমনিতেই বেড়ে যায়।

বাংলা ব্যবহারে অনীহার নানান ইস্যু ও কারণ তুলে ধরে প্রত্থিতযশা এই শিক্ষাবিদ বলেন, ইস্ট ইনডিয়া কোম্পানি বাংলা শিখেছিল। এমনকি তারা বাংলায় অনুবাদও করেছিল। তার মানে ইংরেজরা বাংলাকে গুরুত্ব দিয়েছিল অনেক বছর আগেই। অথচ এখন তার উল্টোটা ঘটছে।

ইতিহাসের বহুমাত্রিক বিন্যাস উপস্থাপন করে তিনি বলেন, ১৮৩৫ সালে কলকাতা মেডিকেল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানে ডাক্তারিবিদ্যা শেখানো হতো বাংলায়। এমনকি ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পর বহুদিন উচ্চশিক্ষার মাধ্যম ছিল শুধুই বাংলা। অথচ বাংলাদেশের আদালতে বাংলায় রায় লেখা হচ্ছে শুধু ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে।

পিএসসির ভূমিকা ও বিসিএসের নানান প্রসঙ্গ তুলে ধরে ডক্টর ঘোষ আরও বলেন, মেয়েটি ইংরেজিতে ভালো হলেই কেবল তাকে ভাইভা বোর্ডে গণ্য করা হয়। কিন্তু বাংলা পারল কী পারল না, তা ঠাহর করতে পারছে না কেউ।

সম্প্রীতি বাংলাদশের সদস্য সচিব বাংলাদেশের খ্যাতনামা লিভার বিশেষজ্ঞ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল ছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন বিশিষ্ট কথাকার অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকী, সাবেক সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, শিক্ষাবিদ রেভারেন্ড মার্টিন অধিকারী, থিয়েটারকর্মী অধ্যাপক ফাহমিদা হক, সম্প্রীতি বাংলাদেশের নেত্রী জয়শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়, ডিরেক্টর গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক ও সম্প্রীতি বাংলাদেশের সংগঠক সাইফ আহমেদ,  মেজর (অব.) আফিজুর রহমান, মহিলা পরিষদের নেত্রী ফরিদা ইয়াসমিন, একুশে টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক ড. অখিল পোদ্দারসহ অন্যরা।

প্রফেসর ড. রতন সিদ্দিকী বলেন, ভাষার লড়াই খুব প্রাচীন। যুগে যুগে যারাই এসেছে তারা আমাদের ভাষা দখল করতে চেয়েছে। কেউ এসেছেন কর্তৃত্ব করতে। এরপরও ভাষা বিলুপ্ত হয়নি। লোক মেরেছে কিন্তু ভাষাকে মারতে পারে নি। এই ভাষার শক্তির কাছে কিছুই টিকে থাকে নি। দু’একটি শব্দ হয়তো তারা পাল্টে দিয়েছে।

ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল বলেন, শুধু পাকিস্তান শাসনামলে নয়, বাংলা ভাষা শত শত কাল থেকে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এটি হিন্দু না মুসলমানদের ভাষা তা নিয়েও ছিল বিতর্ক। মূলত বাংলাই ছিল সাধারণ মানুষের ভাষা। যা এখনো সাধারন মানুষের মাঝে বেঁচে আছে। 

অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় নাট্যজন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ভাষা যোগাযোগের মাধ্যম, অন্যদিকে শুদ্ধসংস্কৃতিরও বাহক। গুগল বলছে, পৃথিবীর বৃহত্তম পঞ্চম ভাষা বাংলা। আমার জানামতে এটি ভুল। জাতিগত দিক থেকে বাংলা হল পৃথিবীর ৩য় বৃহত্তম ভাষা। যোগাযোগের বাহক হিসেবে এটি ৭ম বা ৮ম হতে পারে। আর এই বৃহত্তম ভাষার মানুষের প্রথম রাষ্ট্র গড়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।

এ ব্যাপারে তিনি জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় ভাষণের ব্যাপারটিও উল্লেখ করে বলেন, বাংলার গুরুত্ব অবশ্যই পৃথিবীতে আছে। নইলে শেখ মুজিব এতোবড় সাহস দেখালেন কী করে? বাংলা ভাষার ওপর সবসময় আঘাত এসেছে। তা আবার উতরাতেও পেরেছে এই বাঙালি। মাটির জন্য যুদ্ধ করা বাঙালি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সভ্যতা রক্ষা করে চলেছে। সুতরাং মাটিসংলগ্ন সভ্যতা অটুট রাখতে বাংলা রক্ষা অনিবারর্য হয়ে পড়েছে।