সন্দেশখালিতে মোদি বনাম মমতা লড়াই

সন্দেশখালিতে মোদি বনাম মমতা লড়াই

সংগৃহীত

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সন্দেশখালিতে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস দলের স্থানীয় কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে লাগাতার যৌন নির্যাতন, জমি দখলের মতো অভিযোগগুলো নিয়ে সেখানকার নারীরা ব্যাপক বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন বেশ কয়েক দিন ধরে। এ ইস্যুটি কয়েক মাস পরের লোকসভা নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়ে এখন চলছে হিসাব নিকাশ।

ইস্যুটা জাতীয় রাজনীতির স্তরে বিজেপি আগেই নিয়ে গেছে। তাদের জাতীয় সম্মেলনে সন্দেশখালির ঘটনাবলী নিয়ে পাশ হয়েছে একটি প্রস্তাবও।

আবার সন্দেশখালি যে জেলায় অবস্থিত, সেই উত্তর ২৪ পরগণায় সভা করতে যাবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তার সামনেও নির্যাতিতা নারীদের একাংশকে হাজির করা হতে পারে বলে জানাচ্ছেন বিজেপি নেতৃত্ব।

এরসাথেই জাতীয় স্তরের টিভি চ্যানেল এবং সংবাদ পোর্টালগুলো নিয়মিত সন্দেশখালির খবর পৌঁছিয়ে দিচ্ছে সারা ভারতে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন যে লোকসভা ভোট পর্যন্ত তো বটেই, তারপরও সন্দেশখালির ইস্যু নিয়ে বিজেপি লাগাতার প্রচার চালিয়েই যাবে।

যদিও বিজেপি নেতারা বলছেন, ভোটের কথা মাথায় রেখে তারা সন্দেশখালি নিয়ে আন্দোলনে নামেননি।

বিজেপির বক্তব্য, তারা সারা দেশের মানুষকে দেখাতে চাইছেন যে পশ্চিমবঙ্গে একজন নারী মুখ্যমন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তারই দলের কিছু নেতা লাগাতার নারীদের ওপরে যৌন নির্যাতন-সহ নানা অত্যাচার চালিয়ে গেছেন।

সন্দেশখালির ঘটনায় মূল অভিযুক্ত শাহজাহান শেখ গত দেড় মাস ধরে পলাতক। তার অন্য দুই সঙ্গী অবশ্য গ্রেফতার হয়েছেন।

শেখকে যাতে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করা হয়, রাজ্য সরকারকে সেই অনুরোধ জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস।

বিজেপির রণনীতি
সন্দেশখালিতে নারীরা জোটবদ্ধ হয়ে যেদিন থেকে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন, সেদিন থেকেই বিষয়টি নিয়ে সরব হয়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দল বিজেপি।

তাদের নেতানেত্রীরা এর পর থেকে প্রায় প্রতি দিনই সন্দেশখালির দিকে যেতে চেষ্টা করেন, পুলিশ বাধা দেয়, দুই পক্ষের ধস্তাধস্তি হয়, সেটার ছবি মুহূর্তে দেখানো হয়ে যায় জাতীয় ও স্থানীয় টিভি চ্যানেলগুলিতে।

আবার সম্প্রতি দিল্লিতে বিজেপির যে জাতীয় কনভেনশন হয়ে গেল, সেখানেও আলোচিত হয়েছে সন্দেশখালির প্রসঙ্গ।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ওই কনভেনশনে বলেছিলেন, 'আমাদের দেশের একটি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। কী হচ্ছে সেখানে! নারীদের সঙ্গে কী ধরনের অত্যাচার করা হচ্ছে! তাদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে।'

'পশ্চিমবঙ্গের সন্দেশখালিতে যা হয়েছে এবং আমাদের দলীয় কর্মীরা যে সাহসের সঙ্গে ওই অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়ছেন, তাতে আমি আমাদের কর্মীদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। এই ধরনের ঘটনা সভ্য সমাজের কলঙ্ক। কঠোর নিন্দা হওয়া উচিত', সেখানে বলেন রাজনাথ সিং।

আবার সন্দেশখালি যে জেলায় অবস্থিত, সেই উত্তর ২৪ পরগণায় মার্চের গোড়ায় একটি সভা করতে আসার কথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও।

বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের নেতারা বলছেন, সে দিন প্রধানমন্ত্রীর সভামঞ্চে হাজির করানো হতে পারে সন্দেশখালির নির্যাতিতা নারীদের কয়েকজনকে।

ইস্যুটা এভাবেই ভোট পর্যন্ত জিইয়ের রাখতে চাইবে বিজেপি, এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

কলকাতায় রাজনৈতিক বিশ্লেষক অরুন্ধতী মুখার্জী বলছিলেন, 'ভোট তো এসেই গেল প্রায়। তাই ভোট পর্যন্ত ইস্যুটা তো জীবন্ত থাকবে এমনিতেই।'

'আর যেভাবে বিজেপি তার দলীয় কর্মীদের বলছে যে সন্দেশখালির ইস্যুতেই মনোযোগ দিক তারা, তাতে বোঝা যাচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গে এটা তাদের কাছে একটা বড় ইস্যু হয়ে উঠবে ভোট প্রচারের সময়ে।'

যৌন নির্যাতন এবং ধর্ষণের অভিযোগ ছাড়াও সন্দেশখালির বহু মানুষের চাষ জমি দখল করে সেখানে নোনা পানি ঢুকিয়ে দিয়ে মাছের ভেড়ি করেছে শাহজাহান শেখ আর তার সঙ্গীরা, এই অভিযোগও রয়েছে বেশ কয়েকজন মানুষের।

অরুন্ধতী মুখার্জী বলছিলেন, 'জমির আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গে সব সময়েই ভোটের সময়ে বড় ইস্যু হয়ে দেখা দেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় জমির আন্দোলন শুরু হয় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। এখানেও সেটা দেখা গেছে।'

'নারীরাই দলে দলে বেরিয়ে এসেছেন তাদের ওপরে নির্যাতনের কথা বলতে। এখন সেখানে নানা বিরোধী দল যাচ্ছে, কিন্তু শুরুটা শুধুই নারীদের বিক্ষোভ দিয়েই হয়েছে।'

'শাহজাহান শেখের দাপট কমেছে এটা যখনই বুঝেছেন, তখনই মুখ খুলতে শুরু করেছেন তারা', বলছিলেন তিনি।

সন্দেশখালির প্রভাব ভোটে পড়বে?
কয়েক মাস পরের লোকসভা নির্বাচনে প্রথমবার ভোট দেবেন, রাজ্যে এমন তিনজনের সাথে বিবিসি বাংলা সন্দেশখালি ইস্যু নিয়ে কথা বলেছে।

কলকাতার ওই তিন ছাত্রী বলছিলেন, সন্দেশখালি থেকে লাগাতার অত্যাচার, যৌন নির্যাতনের যে সব ঘটনা নিয়মিত তারা সংবাদমাধ্যমে পড়ছেন বা দেখছেন, সেসব নিশ্চিতভাবেই ভোটের আগে ওদের ভাবাচ্ছে।

বিষয়টা যে তাদের ভোটের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতেই পারে, সেটাও বলছিলেন ওই তিনজন।

এদেরই একজন বলছিলেন, 'মমতা ব্যানার্জির বড় ভোট ব্যাংক মুসলিম আর নারীরা। অথচ সেই নারীদের ওপরেই দীর্ঘদিন ধরে এরকম অত্যাচার চলল, তৃণমূল কংগ্রেস কোনও ব্যবস্থা নিতে পারল না?'

আবার কলকাতায় মাঝবয়সী এক নারী বলছিলেন, 'এই ছবিগুলো যে শুধু নারী ভোটারদের প্রভাবিত করবে তা নয়, সবারই ভোট সিদ্ধান্তে এর প্রভাব পড়বে।'

বিষয়টা যেহেতু রাজনৈতিক, তাই শহরাঞ্চলের বাসিন্দা এই চারজনের কেউই নিজেদের নাম ব্যবহার করতে দিতে চাননি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভাশিস মৈত্রও বলছিলেন যে তারও মনে হচ্ছে যে সন্দেশখালির ঘটনা লোকসভা নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে এবং সেটা তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধেই কাজ করবে।

তার কথায়, 'সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমবঙ্গে যেসব বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা সামনে এসেছে, হেভিওয়েট নেতারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, সে সবের থেকেও বড় হয়ে উঠে এসেছে সন্দেশখালির নারীদের ওপরে অত্যাচারের ঘটনা।'

'ক্ষমতাসীন দলের কিছু স্থানীয় নেতার লাগাতার নির্যাতন-অত্যাচারের ঘটনা এখন গণ পরিসরে আলোচিত হচ্ছে নিয়মিত। সারা দেশে এটা নিয়ে আলোচনা চলছে। তাই মাস কয়েক পরের ভোটে এর প্রভাব পড়বে বলেই আমার মনে হয়, কিন্তু কী পরিমাণে প্রভাব পড়বে, সেটা এখনই বলা কঠিন,' বলছিলেন মৈত্র।

রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসও বিলক্ষণ বুঝেছে যে বিরোধী দলগুলো সন্দেশখালির ঘটনাকে ভোটে বড় ইস্যু হিসেবে তুলে আনবে।

তাই সন্দেশখালির বিক্ষোভ শুরু হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই প্রথমে সেখানে পুলিশ প্রশাসনকে দিয়ে, তারপরে দলের নেতাদের পাঠিয়ে ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা হচ্ছে।

উত্তর ২৪ পরগণার দুই হেভিওয়েট মন্ত্রী সুজিত বসু ও পার্থ ভৌমিক মাঝে মাঝেই যাচ্ছেন সন্দেশখালিতে। সেখানে মানুষকে আশ্বস্ত করার যেমন চেষ্টা করছেন তারা, আবার প্রশাসনিক নানা নির্দেশও দিচ্ছেন।

যেমন, যে জায়গা দিয়ে চাষের জমিতে নদীর নোনা জল ঢুকিয়ে দেয়া হতো বলে গ্রামের মানুষরা অভিযোগ করেছিলেন, সেচমন্ত্রী পার্থ ভৌমিক তার দপ্তরের কর্মকর্তাদের সেই নদী-মুখটি বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

আবার সরকারী কর্মীরা জমি দখলের অভিযোগ শুনতে গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন। পুলিশের মহানির্দেশক গিয়ে গ্রামের মানুষজনের অভিযোগ শুনছেন।

অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম মুখপাত্র অরূপ চক্রবর্তী পাল্টা বিজেপির দিকে আঙ্গুল তুলে বলছেন, 'বিজেপি শাসিত রাজ্য উত্তরপ্রদেশের হাথরাস বা উন্নাওতে বা মণিপুরে যখন নারীদের গণধর্ষণ করা হয়, তখন তো কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলটি কিছু বলে না!'

'আবার তাদের দলের সংসদ সদস্য ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের পদকজয়ী কুস্তিগিররা রাস্তায় বসে দিনের পর দিন ধর্না দেন, তখন বিজেপি নেতারা কোথায় থাকেন?', প্রশ্ন চক্রবর্তীর।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অরুন্ধতী মুখার্জীর সন্দেহ, 'ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা তো করবেই তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু তাতে লাভ কী খুব একটা হচ্ছে?'

'রোজই তো দেখা যাচ্ছে স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেস নেতাদের বাড়ি ভাঙচুর হচ্ছে, তারা মার খাচ্ছেন, নতুন নতুন এলাকায় বিক্ষোভ শুরু হচ্ছে', মন্তব্য তার।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা