মিথ্যা মামলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, বিচার ব্যবস্থায় বোঝা

মিথ্যা মামলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, বিচার ব্যবস্থায় বোঝা

জিসান তাসফিক।

জিসান তাসফিক-

মানুষ একবদ্ধ হয়ে সমাজে বসবাস করে। সমাজে নানান মতাদর্শের মানুষ রয়েছে। যার ফলে মাঝে মধ্যে সমাজে বসবাসকারী মানুষজন পরস্পর পরস্পরের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পরে। এই সকল দ্বন্দ্ব অবসানের জন্য সমাজের অধিপতিরা বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। দ্বন্দ্ব অবসানের বিচারালয়কে বলা হয় আদালত। আইনের পরিভাষায় এই সকল দ্বন্দ্ব যখন আদালতে আসে তখন তাকে মামলা বা মোকদ্দমা বলে।


সংবিধানে ৯৪ অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া ১১৪ নং অনুচ্ছেদে অধীনস্থ অর্থাৎ জেলা ও বিশেষ আদালতের কথা উল্লেখ রয়েছে। মামলা বা মোকদ্দমা পরিচালনার জন্য রয়েছে আদালত ব্যবস্থা। আইনে মামলার নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। তবে যখন কোনো ব্যক্তি বা অথবা প্রতিষ্ঠান অপর কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত, প্রতারিত কিংবা এমন কিছু যা আইনত নিষিদ্ধ তখন উক্ত কাজের জন্য আদালতে ক্ষতিপূরণ বা রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী শাস্তির জন্য যে দাবি পেশ করা হয় তাকেই মামলা বলা হয়।
 
মামলা বা মোকদ্দমা দুই ধরনের একটি ফৌজদারী অপরটি দেওয়ানী। যখন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ বা অধিকারের দাবিতে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী মামলা করে সেটা দেওয়ানী মোকদ্দমা আর শাস্তি বা অর্থদণ্ডের দাবিতে মামলা করলে সেটি ফৌজদারী মামলা। সমাজে আমরা যখন কোনো ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হই, তখনই প্রতিকারের আশায় আদালতে মামলা করি এবং প্রচলিত আইন ও ন্যায় ব্যবস্থায় একটি সুষ্ঠ সমাধান আশা করি।

কিন্তু অনেকে হেয় করা উদ্দেশ্য আইনের অপপ্রয়োগ করে মিথ্যে ঘটনা সাজিয়ে মামলা করে। উদাহরণস্বরূপ কোনো ব্যক্তির সাথে অন্য ব্যক্তির একটি বিষয় নিয়ে বাকবিতণ্ডা হলো। কিন্তু তাকে হেয় করা উদ্দেশ্যে প্রথমে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩৬২ ধারার অপহরণের অভিযোগ তুলে ৩৬৩ ধারা অনুযায়ী  সাত বছরের কারাদণ্ড ও শাস্তির দাবি তুলে ফৌজদারী আইনে আদালতে মামলা ঠুকলো। অথচ এমন ঘটনার কোনো বাস্তবতাই ছিল না। এটাও একটি মিথ্যে মামলা। যে ব্যক্তি মামলা করে তাকে বাদী বলে আর যার বিরুদ্ধে মামলা হয় তাকে বিবাদী বলে।

এছাড়াও আইনের অপব্যাখ্যা বা অপব্যবহারের জন্য  মামলা মিথ্যা হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ মোবাইলের মালিকের অবর্তমানে তাকে না জানিয়ে কেউ একজন মোবাইল নিয়ে গেল। মোবাইলের মালিক থানায় গিয়ে মামলা করলেন। কিন্তু এজাহারে উল্লেখ করলেন যে মোবাইলের সাথে দশ ভড়ি স্বর্ণ ও চুরি হয়েছে এবং বাংলাদেশ দণ্ডবিধি অনুযায়ী ৩৭৮ ধারা অভিযোগ তুলে, ৩৭৯ ধারা তিনবছরের শাস্তি এবং অর্থ দন্ডের দাবি করে মামলা করলেন। মোবাইলের মালিক ভেবে রাখলেন যে চুরির জন্য বেশি দোষ চাপিয়ে মামলা করলে শাস্তি বেশি হবে। কিন্তু বাস্তবতা এমনটি নয়। আইন অনুযায়ী চোর চোরই এবং তার শাস্তি একই। বরং মালিকের দেওয়া মিথ্যে তথ্যের জন্য মামলাটি হালকা হয়ে যাবে। এমনকি এটাও দাবি হতে পারে যে  আসলে মামলাটি মিথ্যা ছিল কিনা। সুতরাং মামলা করার সময় সত্য ঘটনা অবলম্বন করতে হবে। এতে করে প্রমাণ করাও সহজ হয়ে যাবে। 

মিথ্যা মামলা করা আইনত অপরাধ এবং আদালতের জন্য বোঝা। বাংলাদেশ দন্ডবিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলার শাস্তি হল দুই বছরের কারাদন্ড, অর্থদন্ড অথবা উভয়দন্ড। কেউ যদি মিথ্যা মামলা করে সাতবছরের অধিক বা যাবৎজীবন কারাদন্ড দাবি করে তাহলে মিথ্যে মামলা করার জন্য সাত বছরে জেল অথবা অর্থদন্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। এদিকে মিথ্যা মামলার জন্য বিবাদী মানহানির অভিযোগ তুলে আদালতে মামলা করত পারবেন। সুতরাং হয়রানিমূলক বা সত্য গোপন করে মামলা করে উল্টো শাস্তি পেতে হবে। কারণ বাদী-বিবাদীর মতামত ও প্রমাণ সাপেক্ষে আদালতে সবকিছু পরিস্কার হয়ে যায়।
  
বর্তমানে দেশের আদালতে প্রায় ৩৭ লক্ষ মামলা ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে কিন্তু পর্যাপ্ত বিচারক নেই। এর মধ্যে মিথ্যা মামলা বিচার ব্যবস্থার জন্য বোঝা। যারা সত্যিকারের প্রতিকারের জন্য আসে তাদের মামলাও জটে পরে যায়। সুতরাং বাংলাদেশের সুনাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য আমরা সত্য ও ন্যায়ের পথে চলে সঠিক তথ্য দিয়ে সঠিক বিচার দাবি করা।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, 
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।