পশ্চিমবঙ্গে ভোটের আগে 'লাশের রাজনীতি'?

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের আগে 'লাশের রাজনীতি'?

ছবি: সংগৃহীত

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন হবে আগামী বছরের মাঝামাঝি। এই ভোটে যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপির জোর টক্কর হবে, সেটা নিয়ে দ্বিমত নেই রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে নেতাদের মধ্যেও।

কিন্তু যেটা অনেককেই আশ্চর্য করছে, তা হল ভোটের প্রায় সাত আট মাস আগে থেকে মাঝে মাঝেই রাজনৈতিক খুনের ঘটনা।

গত প্রায় তিন মাসে অন্তত ১৩ জন খুন হয়েছেন, যাদের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস আর বিজেপি- দুই দলের কর্মীরাই আছেন। এছাড়াও দুপক্ষের সংঘর্ষও ঘটছে নানা জায়গায়। দুটি দল দোষ দিচ্ছে অপরপক্ষকে।

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের আগে-পরে রাজনৈতিক খুনের ট্র্যাডিশন অনেক দশক ধরেই চলে আসছে।

কিন্তু বিশ্লেষকরা মনে করছেন ভোটের সময়ে রাজনৈতিক হিংসার যে ট্র্যাডিশন সেই ষাটের দশক থেকে চলছে, এবার তা আরও বেশি করে ছড়ানোর আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হত্যার প্রসঙ্গ গত দুদিন ধরে আবারো উঠে এসেছে কলকাতা লাগোয়া উত্তর ২৪ পরগণার শিল্পাঞ্চল টিটাগড়ে, রবিবার রাতে মণীষ শুক্লা নামে এক স্থানীয় প্রভাবশালী বিজেপি নেতা খুন হওয়ার পর থেকে।

তাকে খুব কাছ থেকে ১৪টি গুলি করা হয়।

পুলিশ দুজনকে গ্রেফতার করেছে আর তাদের প্রাথমিক সন্দেহ যে এটা রাজনৈতিক হত্যা নয়। পুরনো রেষারেষির জন্যই এই খুন।

তবে বিজেপি অভিযোগ করছে যে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারাই রয়েছেন এই খুনের পিছনে। তৃণমূল কংগ্রেস এই অভিযোগ অস্বীকার করছে।

কেন এই রাজনৈতিক খুনোখুনি?

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও প্রবীণ সাংবাদিক শিখা মুখার্জী বলছিলেন, নির্বাচনের সময়ে হানাহানি, রাজনৈতিক সংঘর্ষ - এসব সেই ষাটের দশক থেকেই তিনি দেখছেন।

"রাজনৈতিক হিংসা-প্রতিহিংসার একটা ধারা আছে পশ্চিমবঙ্গে সেই ষাটের দশক থেকেই। এখানে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়। আগেও যেটা হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যে দল ক্ষমতায় আসবে বলে দাবি রাখছে আর যে দল ক্ষমতায় আছে, তাদের মধ্যেই সংঘাতটা বেশি হয়।

''এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, যারা ক্ষমতায় আসবে বলে দাবি করছে, তাদের বক্তব্য যে তাদেরই বেশি লোক মারা যাচ্ছে - এরকম একটা ন্যারেটিভ কিন্তু তৈরি হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই," বলছিলেন শিখা মুখার্জী।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলি যে তথ্য সঙ্কলন করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে জুন মাস থেকে এখনও পর্যন্ত বিজেপির সাত জন, তৃণমূল কংগ্রেসের পাঁচজন এবং এসইউসিআই দলের একজন খুন হয়েছেন।

শুধু যে খুন হচ্ছে তা নয়, বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে নানা জায়গাতেই সংঘর্ষও বাধছে।

মঙ্গলবারই দক্ষিণ ২৪ পরগণার ডায়মন্ড হারবারে এক মিছিলে যোগ দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন বিজেপির নেতা শমীক ভট্টাচার্য।

বিজেপির রাজ্য শাখার অন্যতম সম্পাদক ও মহিলা নেত্রী সঙ্ঘমিত্রা চৌধুরী বলছিলেন বড় নেতাদের ওপরে যদি আক্রমণ হয়, শিল্পাঞ্চলে এক কাউন্সিলার খুন হয়ে যান, তাহলে সাধারণ কর্মী সমর্থকদের নিরাপত্তা কোথায়?

"বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় থেকে আমাদের কর্মী সমর্থক অন্তত ১১২ জন খুন হলেন। এদের মধ্যে হেমতাবাদের এক বিধায়ক আছে, আবার সেদিন ব্যারাকপুরে এক পুরসভার সাবেক কাউন্সিলার খুন হলেন। মঙ্গলবার ডায়মন্ড হারবারে র‍্যালি করতে গিয়ে আক্রান্ত হলেন শমীক ভট্টাচার্যের মতো সিনিয়ার নেতা। এদের ওপরে যদি আক্রমণ হয়, তাহলে সাধারণ নেতা কর্মীদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কোথায়? কোন জঙ্গলের রাজত্বে বাস করছি আমরা?" বলছেন বিজেপির সঙ্ঘমিত্রা চৌধুরী।

বিজেপির নেতারা এইসব খুন আর সংঘর্ষের ঘটনাকে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার প্রমাণ হিসাবে তুলে ধরছেন।

এমনকী রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান, রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ও নিয়মিত আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রবল সমালোচনা করেছেন।

রাজনৈতিক হত্যার হিসাবে শীর্ষে পশ্চিমবঙ্গ
তৃণমূল কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা ও সংসদ সদস্য সৌগত রায় বলছিলেন সংঘর্ষ বা খুনের ঘটনা ঘটছে ঠিকই, সেটা যে কাম্য নয়, তাও ঠিক, কিন্তু ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন।

রায় বলছিলেন, "এটা ঠিকই বেশ কয়েকটা হত্যা হয়েছে। কিন্তু এগুলোর মধ্যে কোনও একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আপনি দেখতে পাবেন না। একটা খুনও কাম্য নয়। যেগুলো হচ্ছে, সেগুলোও হওয়া উচিত নয়। আমরা তো আমাদের দলের লোকেদের কাছে বার্তা দিয়েছি এসবের মধ্যে যাতে তারা না থাকে।''

রাজ্যের খুনের ঘটনা ঘটছে তা স্বীকার করলেও মি. রায় বলছেন এগুলোর জন্য রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছে সেটা মানতে তিনি রাজি নন।

"সমস্যাটা হচ্ছে বিজেপি মনে করছে তারা রাজ্যের ক্ষমতায় এসেই গেছে। তাই তারা নানা ধরনের উত্তেজক কথাবার্তা বলছে। আমার ধারণা এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যাবে," মন্তব্য রায়ের।

তিনি রাজনৈতিক কর্মীদের খুন হওয়ার ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বললেও বিশ্লেষকরা মনে করছেন রাজনৈতিক দলগুলিতে পেশী-শক্তির উপস্থিতি আছে বলেই এধরনের হত্যার ঘটনা ঘটে।

"ভোটের এত আগে থেকে এ জিনিস শুরু হলে সেটা নিসন্দেহে খুব চিন্তার বিষয়। ভোট দেবে মানুষ - এটা তার গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু সেখানে পেশী-শক্তির প্রয়োগ মানেই হচ্ছে যে, গায়ের জোরে হয় কোনও একটা পক্ষে ভোট দিতে বাধ্য করা, অথবা ভোটদান থেকে বিরত রাখা।

''আমাদের এখানে যখনই কোনও নির্বাচন আসে, সেই সময়ে রক্ত ঝরার ইতিহাসটা অনেক পুরনো। আর এই সময়েই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এইসব খুনের ঘটনা নিয়ে চাপানউতোর শুরু হয়, লাশের রাজনীতি শুরু হয়,"

বলছিলেন কলকাতার সিনিয়ার সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বজিত ভট্টাচার্য।

ভারতের জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরো বলছে রাজ্যগুলিতে যত রাজনৈতিক হত্যা হয়, সেই তালিকায় এক নম্বরে আছে পশ্চিমবঙ্গ।

২০১৮ সালের সর্বশেষ যে তথ্য পাওয়া গিয়েছিল, তাতে সারা দেশের ৬১টি রাজনৈতিক হত্যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই ঘটেছিল ১২টি খুন। আর এবছর ইতিমধ্যেই সংখ্যাটা ১৩-এ পৌঁছেছে।

বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ভোট যত এগিয়ে আসবে, এই রাজনৈতিক হানাহানি সম্ভবত আরো বাড়বে।

সূত্র : বিবিসি