আল্লাহর অবাধ্যতায় যারা ধ্বংশ হয়েছিল

আল্লাহর অবাধ্যতায় যারা ধ্বংশ হয়েছিল

প্রফেসর ড. মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান

প্রফেসর ড. মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান

আল্লাহ যালেম শাসক ও ব্যক্তিদেরকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে থাকেন। কিন্তু তারা সংশোধিত না হ’লে সরাসরি আসমানী বা যমীনী গযব প্রেরণ করেন অথবা অন্য কোন মানুষকে দিয়ে তাকে শাস্তি দেন ও যুলুম প্রতিরোধ করেন। যেমন আল্লাহ উদ্ধত ফেরাঊনের কাছে প্রথমে মূসাকে পাঠান। ২০ বছরের বেশী সময় ধরে তাকে উপদেশ দেওয়ার পরেও এবং নানাবিধ গযব পাঠিয়েও তার ঔদ্ধত্য দমিত না হওয়ায় অবশেষে সাগরডুবির গযব পাঠিয়ে আল্লাহ তাদেরকে সমূলে উৎখাত করেন।

মূসা (আ.) ও ফেরাঊনের কাহিনী পবিত্র কুরআনে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। গযবপ্রাপ্ত জাতি হিসাবে কওমে ফেরাঊন সম্পর্কে মহান আল্লাহ  কুরআনের ২৭টি সূরায় ৭৫টি স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। যাতে ফেরাঊনের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য ও তার যুলুমের নীতি-পদ্ধতি সমূহ মানবজাতির নিকট সুস্পষ্ট হয়ে যায় এবং এযুগের ফেরাঊনদের বিষয়ে উম্মতে মুহাম্মাদী হুঁশিয়ার হয়। মূসা (আ.) ও ফেরাঊন সম্পর্কে কুরআনে আল্লাহ বলেন,

 نَتْلُوا عَلَيْكَ مِن نَّبَإِ مُوسَى وَفِرْعَوْنَ بِالْحَقِّ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ- إِنَّ فِرْعَوْنَ عَلاَ فِي الْأَرْضِ وَجَعَلَ أَهْلَهَا شِيَعاً يَسْتَضْعِفُ طَائِفَةً مِّنْهُمْ يُذَبِّحُ أَبْنَاءَهُمْ وَيَسْتَحْيِي نِسَاءَهُمْ إِنَّهُ كَانَ مِنَ الْمُفْسِدِيْنَ-

‘আমরা আপনার নিকটে মূসা ও ফেরাঊনের বৃত্তান্তসমূহ থেকে সত্য সহকারে বর্ণনা করব বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য। নিশ্চয়ই ফেরাঊন তার দেশে উদ্ধত হয়েছিল এবং তার জনগণকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করেছিল। তাদের মধ্যকার একটি দলকে সে দুর্বল করে দিয়েছিল। সে তাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করত ও কন্যা সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখত। বস্তুতঃ সে ছিল অনর্থ সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত। ( সূরাতুল ক্বাছাছ ৩-৪)। 

ফেরাঊনের আল্লাহর অবাধ্যতা ও বনী ঈস্রাইলের উপর বিভিন্নমূখী অত্যচারের ফলে মহান আল্লাহ তাদেরকে বিভিন্ন আযাবে নিপতিত করেন। কিন্তু একটা গযব শেষ হওয়ার পর যখনই শুভদিন আসতো তখন পিছনের ভয়াবহ দুর্দশার কথা ভুলে যেয়ে আল্লাহর অবাধ্যতা ও বনী ঈস্রাইলদের উপর পুনরায় অত্যাচার শুরু করত। এ ব্যাপারে কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন,

فَإِذَا جَاءتْهُمُ الْحَسَنَةُ قَالُوْا لَنَا هَـذِهِ وَإِنْ تُصِبْهُمْ سَيِّئَةٌ يَطَّيَّرُوْا بِمُوْسَى وَمَن مَّعَهُ أَلاَ إِنَّمَا طَائِرُهُمْ عِندَ اللهِ وَلَـكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لاَ يَعْلَمُوْنَ

 ‘যখন তাদের শুভদিন ফিরে আসত, তখন তারা বলত যে, এটাই আমাদের জন্য উপযুক্ত। পক্ষান্তরে অকল্যাণ উপস্থিত হ’লে তারা মূসা ও তার সাথীদের ‘অলক্ষুণে’ বলে অভিহিত করত। জেনে রাখ যে, তাদের অলক্ষুণে চরিত্র আল্লাহর ইলমে রয়েছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশ তা জানে না (সূরা আল-আ‘রাফ -১৩১)। তাদের সুবিধাবাদী চরিত্র ফুটে ওঠে নিম্নোক্ত বর্ণনায়। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَلَمَّا وَقَعَ عَلَيْهِمُ الرِّجْزُ قَالُواْ يَا مُوسَى ادْعُ لَنَا رَبَّكَ بِمَا عَهِدَ عِندَكَ لَئِنْ كَشَفْتَ عَنَّا الرِّجْزَ لَنُؤْمِنَنَّ لَكَ وَلَنُرْسِلَنَّ مَعَكَ بَنِي إِسْرَائِيلَ- فَلَمَّا كَشَفْنَا عَنْهُمُ الرِّجْزَ إِلَى أَجَلٍ هُم بَالِغُوهُ إِذَا هُمْ يَنكُثُونَ

‘আর যখন তাদের উপর কোন আযাব পতিত হ’ত, তখন তারা বলত, হে মূসা! তুমি আমাদের জন্য তোমার প্রভুর নিকট দো‘আ কর, যা (কবুলের) ওয়াদা তিনি তোমাকে দিয়েছেন। যদি তুমি আমাদের উপর থেকে এ আযাব দূর করে দাও, তাহ’লে অবশ্যই আমরা তোমার উপর ঈমান আনব এবং তোমার সাথে বনু ইস্রাঈলদের অবশ্যই পাঠিয়ে দেব’। ‘অতঃপর যখন আমরা তাদের উপর থেকে আযাব উঠিয়ে নিতাম নির্দিষ্ট একটা সময়ে, যে পর্যন্ত তাদের পৌঁছানো উদ্দেশ্য হ’ত, তখন তারা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করত’ (সূরা আল-আ‘রাফ -১৩৪-৩৫)। এই কাউমে ফেরাঊনের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে যেসব আযাব এসেছিল তার বর্নণায়  মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন,

فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمُ الطُّوْفَانَ وَالْجَرَادَ وَالْقُمَّلَ وَالضَّفَادِعَ وَالدَّمَ آيَاتٍ مُّفَصَّلاَتٍ فَاسْتَكْبَرُوْا وَكَانُوْا قَوْماً مُّجْرِمِيْ

‘অতঃপর আমরা তাদের উপরে পাঠিয়ে দিলাম তূফান, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ, রক্ত প্রভৃতি বহুবিধ নিদর্শন একের পরে এক। তারপরেও তারা অহংকার করতে থাকল। বস্ত্তঃ তারা ছিল পাপী সম্প্রদায়’ (সূরা আল-আ‘রাফ -১৩৩)। অত্র আয়াতে দুর্ভিক্ষের পরে পরপর পাঁচটি গযব নাযিলের কথা বলা হয়েছে। তারপর আসে প্লেগ মহামারী ও অন্যান্য ছোট-বড় আযাব’ (সূরাতুল আ‘রাফ-১৩৪)। এরপরে সর্বশেষ গযব হ’ল সাগরডুবি’ (ইউনুস -৯০)। যার মাধ্যমে এই গর্বিত অহংকারীদের একেবারে নিঃশেষ করে দেওয়া হয়। প্রত্যেকটি আযাবই নির্ধারিত সময় পর্যন্ত থেকে রহিত হয়ে যায় এবং কিছু দিন বিরতির পর অন্যান্য আযাবগুলি আসে।

কাউমে ফেরাঊনের উপর যেসব আযাব এসেছিল তা নিম্মে উপস্থাপন করা হলো।

(১) দুর্ভিক্ষ 

(২) তূফান 

(৩) পঙ্গপাল 

(৪) উকুন 

(৫) ব্যাঙ 

(৬) রক্ত 

(৭) প্লেগ 

(৮) সাগরডুবি। 

৮টি নিদর্শন নিম্নে বর্ণিত হ’ল-

১ম: দুর্ভিক্ষ

ফেরাঊনের সীমালংঘন ও বনী ঈস্রাঈলদের উপর অত্যাচারের কারণে মূসা (আঃ) তাদের ব্যপারে আল্লাহর নিকট দু‘আ করেন, তাঁর দু‘আ আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার পর ফেরাঊনী সম্প্রদায়ের উপরে প্রথম দুর্ভিক্ষের গযব নেমে আসে।  আল্লাহ বলেন,

وَلَقَدْ أَخَذْنَا آلَ فِرْعَوْنَ بِالسِّنِيْنَ وَنَقْصٍ مِّنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُوْنَ  

‘তারপর আমরা পাকড়াও করলাম ফেরাঊনের অনুসারীদেরকে দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে এবং ফল-ফসলের ক্ষয়-ক্ষতির মাধ্যমে, যাতে তারা উপদেশ হাছিল করে’ (সূরা আল-আ‘রাফ -১৩০)।

নিরীহ বনী ইস্রাঈলগণের উপরে দুর্ধর্ষ ফেরাঊনী যুলুম প্রতিরোধে এটা ছিল মযলূমদের সমর্থনে আল্লাহ প্রেরিত প্রথম হুঁশিয়ারী সংকেত। এর ফলে তাদের ক্ষেতের ফসল ও বাগ-বাগিচার উৎপাদন চরমভাবে পেয়েছিল। খাদ্যাভাবে তাদের মধ্যে হাহাকার পড়ে যায়। ফলে কোন উপায়ান্তর না দেখে কাওমে ফেরাঊনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ মূসা (আঃ)-এর কাছে এসে কাকুতি-মিনতি করতে থাকে। দয়ার্দ্রচিত্ত মূসা (আঃ) অবশেষে দো‘আ করলেন। ফলে দুর্ভিক্ষ রহিত হয়ে গেল এবং তাদের বাগ-বাগিচা ও মাঠ-ময়দান পুনরায় ফল-ফসলে ভরে উঠলো। কিন্তু ফেরাঊনী সম্প্রদায় এতে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় না করে বরং মূসাকেই দায়ী করে তাঁকে ‘অলক্ষুণে-অপয়া’ বলে গালি দেয় এবং উদ্ধতভাবে বলে ওঠে যে, 

وَقَالُوْا مَهْمَا تَأْتِنَا بِهِ مِنْ آيَةٍ لِّتَسْحَرَنَا بِهَا فَمَا نَحْنُ لَكَ بِمُؤْمِنِيْنَ 

আমাদের উপরে জাদু করার জন্য তুমি যে নিদর্শনই নিয়ে আস না কেন, আমরা তোমার উপরে কোন মতেই ঈমান আনব না’ (সূরা আল-আ‘রাফ -১৩২)। 

২য়: প্লাবন-জলোচ্ছ্বাস ও তূফান

দুর্ভিক্ষের পরে মূসা (আঃ)- এর দু‘আর বরকতে পুনরায় ভরা মাঠ ও ভরা ফসল পেয়ে ফেরাঊনী সম্প্রদায় পিছনের সব কথা ভুলে যায় এবং মূসা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে অপবাদ রটাতে থাকে। তারা সাধারণ লোকদের ঈমান গ্রহণে বাধা দিতে থাকে। তারা তাদের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে পুনরায় ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে থাকে। ফলে তাদের উপরে গযব আকারে প্লাবন ও জলোচ্ছ্বাস নেমে আসে। 

যা তাদের মাঠ-ঘাট, বাগান-ফসল, ঘর-বাড়ি সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এতে ভীত হয়ে তারা আবার মূসা (আঃ)-এর কাছে এসে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। আবার তারা ঈমান আনার প্রতিজ্ঞা করে ও আল্লাহর নিকটে দো‘আ করার জন্য মূসা (আঃ)-কে পীড়াপীড়ি করতে থাকে। ফলে মূসা (আঃ) দো‘আ করেন ও আল্লাহর রহমতে তূফান চলে যায়। পুনরায় তারা জমি-জমা আবাদ করে ও অচিরেই তা সবুজ-শ্যামল হয়ে ওঠে। 

৩য়: পঙ্গপাল

তারা আবার অহংকারী হয়ে ওঠে এবং বলতে থাকে, আসলে আমাদের জমির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্যেই প্লাবন এসেছিল, আর সেকারণেই আমাদের ফসল এবার সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে ও বাম্পার ফলন হয়েছে। আসলে আমাদের কর্ম দক্ষতার ফল হিসাবে এটাই উপযুক্ত। এভাবে তারা অহংকারে মত্ত হয়ে আবার শুরু করল বনী ইস্রাঈলদের উপরে অত্যাচার। ফলে নেমে এল তৃতীয় গযব।

একদিন হঠাৎ পঙ্গপালের ঝাঁক এসে ফেরাঊনীদের সব ফসল খেয়ে ছাফ করে গেল। তারা তাদের ফল-ফলাদি খেয়ে সাবাড় করে ফেলল। এমনকি কাঠের দরজা-জানালা, আসবাব-পত্র পর্যন্ত খেয়ে শেষ করল। অথচ পাশাপাশি বনু ইস্রাঈলদের ঘরবাড়ি, শস্যভূমি ও বাগ-বাগিচা সবই সুরক্ষিত থাকে।

এবারও ফেরাঊনী সম্প্রদায় ছুটে এসে মূসা (আঃ)-এর কাছে কাতর কণ্ঠে নিবেদন করতে থাকে, যাতে গযব চলে যায়। তারা এবার শক্ত ওয়াদা করল যে, তারা ঈমান আনবে ও বনী ইস্রাঈলদের মুক্তি দেবে। মূসা (আঃ)আবারও দু‘আ করলেন, আযাব চলে গেল। পরে ফেরাঊনীরা দেখল যে, পঙ্গপালে খেয়ে গেলেও এখনও যা অবশিষ্ট আছে, তা দিয়ে বেশ কিছুদিন চলে যাবে। ফলে তারা আবার শয়তানী ধোঁকায় পড়ে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করল ও পূর্বের ন্যায় ঔদ্ধত্য প্রদর্শন শুরু করল। ফলে নেমে এল পরবর্তী গযব ‘উকুন’।

৪র্থ: উকুন

‘উকুন’ সাধারণতঃ মানুষের মাথার চুলে জন্মে থাকে এবং সেখানেই বসবাস করে। কিন্তু এটি ফেরাঊনীদের দেহের সর্বত্র সর্বদা কামড়ে অতিষ্ঠ করে তুললো। ফেরাঊনীদের সকল প্রকার কাঠের খুঁটি, দরজা-জানালা, খাট-পালংক ও আসবাব-পত্রে এবং খাদ্য-শস্যে লেগেছিল। 

এভাবে উকুনের অত্যাচারে নাস্তানাবুদ হয়ে এক সময় তারা কাঁদতে কাঁদতে মূসা (আঃ)-এর দরবারে এসে লুটিয়ে পড়ে ক্ষমা চাইতে লাগলো এবং ওয়াদার পরে ওয়াদা করে বলতে লাগলো যে, এবারে আযাব চলে গেলে তারা অবশ্যই ঈমান আনবে, তাতে বিন্দুমাত্র অন্যথা হবে না। মূসা (আঃ) তাদের জন্য দু‘আ করলেন এবং আযাব চলে গেল। কিন্তু তারা কিছু দিনের মধ্যেই ওয়াদা ভঙ্গ করল এবং পূর্বের ন্যায় অবাধ্য আচরণ শুরু করল। আল্লাহর পক্ষ থেকে বারবার অবকাশ দেওয়াকে তারা তাদের ভালত্বের পক্ষে দলীল হিসাবে মনে করতে লাগল এবং হেদায়াত দূরে থাক, তাদের অহংকার ক্রমে বাড়তে লাগল। তাদের নেতারা স্বাভাবিক বুদ্ধি-বিবেচনা হারিয়ে ফেলেছিল। তারা তাদের লোকদের বুঝাতে লাগলো যে, এসবই মূসার জাদুর খেল। আসলে আল্লাহ বলে কিছুই নেই। ফলে নেমে এল এবার ‘ব্যাঙ’-এর গযব।

৫ম: ব্যাঙ

বারবার বিদ্রোহ করা সত্ত্বেও দয়ালু আল্লাহ তাদের সাবধান করার জন্য ও আল্লাহর পথে ফিরিয়ে আনার জন্য পুনরায় গযব পাঠালেন। এবার এল ব্যাঙ। ব্যাঙে ব্যাঙে ভরে গেল তাদের ঘর-বাড়ি, হাড়ি-পাতিল, জামা-কাপড়, বিছানা-পত্তর সবকিছু। বসতে ব্যাঙ, খেতে ব্যাঙ, চলতে ব্যাঙ, গায়ে-মাথায় সর্বত্র ব্যাঙের লাফালাফি। 

কোন জায়গায় বসা মাত্র শত শত ব্যাঙের নীচে তলিয়ে যেতে হ’ত। এর অত্যাচারে পাগলপরা হয়ে উঠল পুরা ফেরাঊনী জনপদ। অবশেষে কান্নাকাটি করে ও কাকুতি-মিনতি করে তারা এসে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলো মূসা (আঃ)-এর কাছে। এবার পাকাপাকি ওয়াদা করল যে, আযাব চলে যাবার সাথে সাথে তারা ঈমান আনবেই। কিন্তু তারা পুনরায় ওয়াদা ভঙ্গ করে। ফলে পুনরায় গযব অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল। এবারে এল ‘রক্ত’।

৬ষ্ঠ: রক্ত

তাদের অহংকার ও ঔদ্ধত্য চরমে উঠলে হঠাৎ একদিন দেখা গেল ‘রক্ত’। খাদ্য ও পানপাত্রে রক্ত, কূপ ও পুকুরে রক্ত, তরি-তরকারিতে রক্ত, কলসি-বালতিতে রক্ত। একই সাথে খেতে বসে বনু ইস্রাঈলের থালা-বাটি স্বাভাবিক। কিন্তু ফেরাঊনী ক্বিবতীর থালা-বাটি রক্তে ভরা। 

পানি মুখে নেওয়া মাত্র গ্লাসভর্তি রক্ত। অহংকারী নেতারা বাধ্য হয়ে বনী ইস্রাঈলী মযলূমদের বাড়ীতে এসে খাদ্য ও পানি ভিক্ষা চাইত। কিন্তু যেমনি তাদের হাতে তা পৌঁছত, অমনি সেগুলো রক্তে পরিবর্তিত হয়ে যেত। ফলে তাদের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। না খেয়ে তাদের মধ্যে হাহাকার পড়ে গেল। অবশেষে পূর্বের ন্যায় আবার এসে কান্নাকাটি। মূসা (আঃ) দয়া পরবশে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করলেন। ফলে আযাব চলে গেল। কিন্তু ঐ নেতাগুলো পূর্বের মতই তাদের গোমরাহীতে অনড় রইল এবং ঈমান আনলো না। এদের এই হঠকারিতা ও কপট আচরণের কথা আল্লাহ বর্ণনা করেন এভাবে, 

فَاسْتَكْبَرُوْا وَكَانُوْا قَوْمًا مُّجْرِمِيْنَ

 অতঃপর তারা আত্মম্ভরিতা দেখাতে লাগলো। বস্তুতঃ এরা ছিল পাপাসক্ত জাতি (সূরা আল-আ‘রাফ -১৩৩)। ফলে নেমে এল এবার প্লেগ মহামারী।

৭মঃ প্লেগ

রক্তের আযাব উঠিয়ে নেবার পরও যখন ওরা ঈমান আনলো না, তখন আল্লাহ ওদের উপরে প্লেগ মহামারী প্রেরণ করেন (আ‘রাফ -১৩৪)। অনেকে এটাকে ‘বসন্ত’ রোগ বলেছেন। যাতে অল্প দিনেই তাদের সত্তর হাযার লোক মারা যায়। অথচ বনী ইস্রাঈলরা ভালো থাকে। আল্লাহর গযবের সাথে সাথে এগুলো ছিল মূসা (আঃ)-এর মু‘জেযা এবং নবুঅতের নিদর্শন। কিন্তু জাহিল ও আত্মগর্বী নেতারা একে ‘জাদু’ বলে তাচ্ছিল্য করত।

প্লেগের মহামারীর ফলে ব্যাপক প্রাণহানিতে ভীত হয়ে তারা আবার এসে মূসা (আঃ)-এর নিকটে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইতে লাগল। মূসা (আঃ) আবারও তাদের জন্য দু‘আ করলেন। ফলে আযাব চলে গেল। কিন্তু তারা পূর্বের ন্যায় আবারো ওয়াদা ভঙ্গ করল। ফলে তাদের চূড়ান্ত ধ্বংস অবধারিত হয়ে গেল। আল্লাহ বলেন, 

إِنَّ الَّذِيْنَ حَقَّتْ عَلَيْهِمْ كَلِمَتُ رَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُوْنَ-وَلَوْ جَاءتْهُمْ كُلُّ آيَةٍ حَتَّى يَرَوُا الْعَذَابَ الأَلِيْمَ-

 ‘নিশ্চয়ই যাদের উপরে তোমার প্রভুর আদেশ নির্ধারিত হয়ে গেছে, তারা কখনো বিশ্বাস আনয়ন করে না, যদিও সব রকমের নিদর্শনাবলী তাদের নিকটে পৌছে যায়, এমনকি তারা মর্মান্তিক আযাব প্রত্যক্ষ করে’ (সূরাহ ইউনুস -৯৬-৯৭)।

৮ম: সাগর ডুবি

ক্রমাগত পরীক্ষা ও অবকাশ দানের পরও যখন ফেরাঊন ও তার কাওম ঈমানের পথ গ্রহন করেনি বরং উল্টা তাদের অহংকার বাড়তে বাড়তে তুঙ্গে ওঠে, তখন তাদের চূড়ান্ত ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। আল্লাহ পাক বলেন,

وَلَقَدْ أَوْحَيْنَا إِلَى مُوسَى أَنْ أَسْرِ بِعِبَادِي فَاضْرِبْ لَهُمْ طَرِيقاً فِي الْبَحْرِ يَبَساً لاَّ تَخَافُ دَرَكاً وَّلاَ تَخْشَى

 ‘আমরা মূসার প্রতি এই মর্মে অহী করলাম যে, আমার বান্দাদের নিয়ে রাত্রিযোগে বের হয়ে যাও এবং তাদের জন্য সমুদ্রে শুষ্কপথ নির্ধারণ কর। পিছন থেকে এসে তোমাদের ধরে ফেলার আশংকা কর না এবং (পানিতে ডুবে যাওয়ার) ভয় কর না (সূরা ত্বোয়াহা-৭৭)।

মহান আল্লাহর আদেশ পেয়ে মূসা (আঃ) রাত্রির সূচনা লগ্নে বনী ইস্রাঈলদের নিয়ে  সমুদ্রের দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। ফেরাঊন খবর জানতে পেরে তার সেনাবাহিনীকে বনী ইস্রাঈলদের পশ্চাদ্ধাবনের নির্দেশ দিল। আল্লাহ বলেন,

فَأَتْبَعُوهُم مُّشْرِقِينَ- فَلَمَّا تَرَاءى الْجَمْعَانِ قَالَ أَصْحَابُ مُوسَى إِنَّا لَمُدْرَكُونَ- قَالَ كَلاَّ إِنَّ مَعِيَ رَبِّي سَيَهْدِينِ- فَأَوْحَيْنَا إِلَى مُوسَى أَنِ اضْرِبْ بِعَصَاكَ الْبَحْرَ فَانفَلَقَ فَكَانَ كُلُّ فِرْقٍ كَالطَّوْدِ الْعَظِيمِ- وَأَزْلَفْنَا ثَمَّ الْآخَرِينَ- وَأَنجَيْنَا مُوسَى وَمَن مَّعَهُ أَجْمَعِينَ- ثُمَّ أَغْرَقْنَا الْآخَرِينَ

 ‘সূর্যোদয়ের সময় তারা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল’ অতঃপর যখন উভয় দল পরস্পরকে দেখল, তখন মূসার সঙ্গীরা (ভীত হয়ে) বলল, إِنَّا لَمُدْرَكُونَ ‘আমরা তো এবার নিশ্চিত ধরা পড়ে গেলাম। ‘তখন মূসা বললেন, কখনই নয়, আমার সাথে আছেন আমার পালনকর্তা। তিনি আমাকে সত্বর পথ প্রদর্শন করবেন। অতঃপর আমরা মূসাকে আদেশ করলাম, তোমার লাঠি দ্বারা সমুদ্রকে আঘাত কর। ফলে তা বিদীর্ণ হয়ে গেল এবং প্রত্যেক ভাগ বিশাল পাহাড় সদৃশ হয়ে গেল। ‘ইতিমধ্যে আমরা সেখানে অপরদলকে (অর্থাৎ ফেরাঊন ও তার সেনাবাহিনীকে) পৌঁছে দিলাম। এবং মূসা ও তার সঙ্গীদের সবাইকে বাঁচিয়ে দিলাম। ‘অতঃপর অপর দলটিকে ডুবিয়ে দিলাম (সূরা আশ-শো‘আরা ৬০-৬৬)।

মূসা ও বনী ইস্রাঈলকে সাগর পাড়ি দিয়ে ওপারে চলে যেতে দেখে ফেরাঊন সরোষে ঘোড়া দাবড়িয়ে সর্বাগ্রে শুষ্ক সাগর বক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পিছনে তার বিশাল বাহিনীর সবাই সাগরের মধ্যে নেমে এলো। যখন তারা সাগরের মধ্যস্থলে পৌঁছে গেল, তখন আল্লাহর হুকুমে দু’দিক থেকে বিপুল পানি রাশি ধেয়ে এসে তাদেরকে নিমেষে গ্রাস করে ফেলল। আল্লাহ বলেন, 

فَأَتْبَعَهُمْ فِرْعَوْنُ بِجُنُودِهِ فَغَشِيَهُم مِّنَ الْيَمِّ مَا غَشِيَهُمْ-

অতঃপর ফেরাঊন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল। কিন্তু সমুদ্র তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে ফেলল’ (সূরা ত্বোয়াহা -৭৮)।

অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

وَجَاوَزْنَا بِبَنِي إِسْرَائِيلَ الْبَحْرَ فَأَتْبَعَهُمْ فِرْعَوْنُ وَجُنُودُهُ بَغْياً وَعَدْواً حَتَّى إِذَا أَدْرَكَهُ الْغَرَقُ قَالَ آمَنتُ أَنَّهُ لآ إِلَهَ إِلاَّ الَّذِي آمَنَتْ بِهِ بَنُو إِسْرَائِيلَ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ-

 ‘আর বনু ইস্রাঈলকে আমরা সাগর পার করে দিলাম। তারপর তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল ফেরাঊন ও তার সেনাবাহিনী বাড়াবাড়ি ও শত্রুতা বশতঃ। অতঃপর যখন সে (ফেরাঊন) ডুবতে লাগল, তখন বলে উঠল, আমি ঈমান আনছি এ বিষয়ে যে, সেই সত্তা ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, যার উপরে ঈমান এনেছে বনু ইস্রাঈলগণ এবং আমি আত্মসমর্পণকারীদের একজন (সূরা ইউনুস -৯০)। আল্লাহ আরো বললেন,

آلآنَ وَقَدْ عَصَيْتَ قَبْلُ وَكُنتَ مِنَ الْمُفْسِدِينَ- فَالْيَوْمَ نُنَجِّيكَ بِبَدَنِكَ لِتَكُونَ لِمَنْ خَلْفَكَ آيَةً وَإِنَّ كَثِيراً مِّنَ النَّاسِ عَنْ آيَاتِنَا لَغَافِلُونَ-

 آلآن ‘এখন একথা বলছ? অথচ তুমি ইতোপূর্বে না-ফরমানী করেছিলে এবং ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে’। ‘অতএব আজ আমরা তোমার দেহকে (বিনষ্ট হওয়া থেকে) বাঁচিয়ে দিচ্ছি। যাতে তোমার পশ্চাদ্বর্তীদের জন্য তুমি নিদর্শন হ’তে পার। বস্ততঃ বহু লোক এমন রয়েছে যারা আমাদের নিদর্শনাবলীর বিষয়ে বেখবর (সূরা ইউনুস-৯১-৯২)।

 

উপরেরর আলোচনা থেকে আল্লাহ আমাদেরকে শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

লেখকঃ

প্রফেসর, আল-হাদীস বিভাগ,

ইসলামী বিশ্ববিদ্যায়, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, বাংলাদেশ।