দুধ: ইসলাম ও বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এক অপূর্ব নেয়ামত

দুধ: ইসলাম ও বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এক অপূর্ব নেয়ামত

ছবি: সংগৃহীত

মানবসভ্যতার আদিকাল থেকে দুধ জীবন রক্ষাকারী খাদ্য ও পানীয় হিসেবে পরিচিত। ইসলাম ও আধুনিক বিজ্ঞান উভয় দৃষ্টিতেই দুধের গুরুত্ব অপরিসীম। যাতে নিহিত রয়েছে পুষ্টি, সুস্থতা ও বরকত। ইসলামে এর বিশেষ স্থান এবং বিজ্ঞানে এর উপকারিতা সব মিলে দুধকে করে তুলেছে এক অনন্য সুপারফুড।

কোরআনে দুধের বর্ণনা

পবিত্র কোরআনে দুধকে সরাসরি আল্লাহর এক মহান নেয়ামত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমাদের জন্য চতুষ্পদ জন্তুগুলোতে রয়েছে শিক্ষা। আমরা তোমাদের পান করাই তাদের পেটের ভিতর থেকে, মল ও রক্তের মাঝখান থেকে বের হওয়া বিশুদ্ধ দুধ, যা পানকারীদের জন্য সুস্বাদু।’ (সুরা নাহল: ৬৬)

এই আয়াত দুধের পবিত্রতা, প্রাকৃতিক উৎপত্তি ও মানুষের জন্য উপকারিতা তিনটিই তুলে ধরে। আল্লাহর কুদরতের এই নিদর্শনটি বিজ্ঞানের ডাইজেস্টিভ সিস্টেমের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ।

দুধ পবিত্র ও বরকতময় খাদ্য

ইসলাম দুধকে শুধু পুষ্টির উৎস নয়, বরং আল্লাহর নেয়ামত ও রিজিকের প্রতীক হিসেবে দেখেছে। রাসুলুল্লাহ (স.) দুধ পান করতেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করতেন। হাদিসে এসেছে, ‘নবী করিম (স.) যখন দুধ পান করতেন, তখন বলতেন اللهم بارك لنا فيه وزدنا منه অর্থাৎ, ‘হে আল্লাহ! এতে বরকত দিন এবং আমাদের এর পরিমাণ বৃদ্ধি করুন।’ (সুনানে তিরমিজি: ৩৪৫৫)

দুধ পান করার কিছু গুরুত্বপূর্ণ আদব

  • বসে পান করা উত্তম
  • বিসমিল্লাহ বলে শুরু করা এবং শেষে আলহামদুলিল্লাহ বলা
  • ডান হাতে পান করা ও তিনবারে পান করা

মাতৃদুগ্ধ: শিশুর প্রথম নেয়ামত

কোরআনে মাতৃদুগ্ধকে শিশুর প্রথম ও অপরিহার্য খাদ্য হিসেবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মায়েরা তাদের সন্তানদের পূর্ণ দুই বছর দুধ পান করাবে, যদি কেউ দুধ খাওয়ানোর সময় পূর্ণ করতে চায়।’ (সুরা বাকারা: ২৩৩)

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ

জন্মের পর মানুষ মায়ের দুধের ওপরই নির্ভর করে। শালদুধ (কোলোস্ট্রাম) মায়ের দেহ থেকে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শাবকের দেহে স্থানান্তরিত করে এবং রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়। এতে আমিষ, ল্যাকটোজসহ অন্যান্য অনেক পুষ্টি উপাদান আছে, যা শিশুর দৈহিক গঠন, বিকাশ ও মেধা বৃদ্ধিতে সহায়ক।

ইসলামি বিধানে দুধ সম্পর্কিত ফিকহি নির্দেশনা

১. দুধ বিক্রয় বৈধ: গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদির দুধ হালালভাবে সংগ্রহ করা হলে তা বিক্রি করা বৈধ।  
২. হারাম প্রাণীর দুধ হারাম: যে প্রাণী নিজেই হারাম যেমন শুকর, তার দুধও হারাম।  
৩. দুধ পানকারী প্রাণীর গোশত: কোনো প্রাণীর বাচ্চা যদি শুধুমাত্র হালাল প্রাণীর দুধ পান করে বড় হয়, তবে তার গোশত হালাল।

বিজ্ঞানের আলোকে দুধের উপকারিতা

দুধ পৃথিবীর সব খাদ্যের সেরা খাদ্য, সর্বোচ্চ পুষ্টিমানের জন্যই দুধের এই শ্রেষ্ঠত্ব। আধুনিক গবেষণা অনুযায়ী-

  • ল্যাকটোজ: দৈহিক গঠন, বিকাশ ও মেধা বৃদ্ধিতে সহায়ক
  • ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন D: হাড় মজবুত রাখে ও অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধ করে
  • প্রোটিন: শরীর গঠন, টিস্যু পুনর্গঠন ও পেশি শক্ত রাখে
  • পটাসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম: হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়

বিজ্ঞানীরা দুধকে Natural Balanced Food বা Super Food আখ্যা দিয়েছেন। যা ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে এক অনন্য সামঞ্জস্য তৈরি করে।

দুধ: জান্নাতের পানীয়

কোরআনে জান্নাতের বর্ণনায়ও দুধের উল্লেখ আছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘মুত্তাকিদের যে জান্নাতের ওয়াদা দেওয়া হয়েছে তার উপমা হলো; তাতে আছে নির্মল পানির ঝরনা, আর আছে দুধের নদী যার স্বাদ অপরিবর্তনীয়, আছে পানকারীদের জন্য সুস্বাদু শরাবের নদী আর পরিশোধিত মধুর নদী।’ (সুরা মুহাম্মদ: ১৫)

অর্থাৎ, দুধ শুধু দুনিয়ার নেয়ামত নয়; বরং আখেরাতেও জান্নাতি সুখের প্রতীক।

স্বপ্নে দুধ দেখা ও এর ব্যাখ্যা

আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল (স.)-কে বলতে শুনেছি, ‘একবার আমি নিদ্রাবস্থায় ছিলাম। তখন (স্বপ্নে) আমার কাছে এক পেয়ালা দুধ নিয়ে আসা হলো। আমি তা পান করলাম। এমনকি আমার মনে হতে লাগল যে সে পরিতৃপ্তি আমার নখ দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। অতঃপর অবশিষ্টাংশ আমি ওমর (রা.)-কে দিলাম।’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন এর ব্যাখ্যা কী, তখন নবীজি (স.) বললেন, ‘তা হলো ইলম (জ্ঞান)।’ (সহিহ বুখারি: ৮২)

শেষ কথা, দুধ ইসলাম, বিজ্ঞান ও মানবজীবনের এক বিস্ময়কর সংযোগ। এটি এমন এক নেয়ামত, যা শরীরের পুষ্টি, আত্মার প্রশান্তি ও আল্লাহর কৃতজ্ঞতা—সব একসঙ্গে বহন করে। যে ব্যক্তি এই নেয়ামতকে চিনে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং পরিমিতভাবে গ্রহণ করে, তার জীবনে আল্লাহ বরকত দান করেন।

আল্লাহর এই মহান নেয়ামত দুনিয়ায় স্বাস্থ্যের বরকত আর আখেরাতে জান্নাতের সুখের প্রতীক।