বৃহত্তর চলনবিলে কাঁচা পাকা ধান কাটতে নারী পুরুষ আত্বীয়স্বজন, শ্রমিক সংকট

বৃহত্তর চলনবিলে কাঁচা পাকা ধান কাটতে নারী পুরুষ আত্বীয়স্বজন, শ্রমিক সংকট

ছবি : প্রতিনিধি

কৃষক যখনই ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাসের মাইকিং শুনেছেন; তখনই চলনবিলে কৃষকরা  উত্তরা লের সর্ববৃহত্তর চলনবিল এলাকায় কাঁচা-পাকা ধান কাটতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন কৃষকরা। হিড়িক পড়েছে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পূর্বাভাসে চরম উদ্বিগ্নতার মধ্যে কৃষকরা ঘরে ধান তোলার জন্য শ্রমিকের অভাবে পুরুষের পাশাপাশি গৃহকর্তা নারী, পুরুষ, আত্বীয়স্বজন নিয়ে ধান কাটছে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। গতবারের আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত ভীতস্ত্রস্ত ঐ এলাকার কৃষক  আগাম ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এর পূর্বাভাসের খবরে তাই কাঁচা পাকা ধান কাটতে বাধ্য হয়েছেন।   

বিশেষ করে চলনবিলকে ঘিরে তিন জেলা পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোরের বিভিন্ন এলাকাসমূহে ধান কাটার ভরা মৌসুমে প্রতিবছরই ধান কাটা শ্রমিক সংকটে পড়ে উত্তরা লের অন্যতম প্রধান শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত চলনবিল এলাকার কৃষক।

পাবনার নিমাইচরা গ্রামের কৃষক আজিবর রহমান বলেন, ‘চার বিঘা জমির মধ্যে দু’ বিঘা জমির ধান এখনও মাঠে। শ্রমিকের অভাবে  ধান কাটতে পারছি না।’ দুশ্চিন্তিতগ্রস্ত আজিবর  আরও বলেন, ‘এ বছর বিঘা প্রতি প্রায় ২৫ থেকে ৩০ মন ধানের ফলন হয়েছে। কিন্তু দুর্যোগের আগে ধান ঘরে না তুলতে পারলে কিছুই সর্বনাশ।’

চলনবিলের পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকাসমূহে ধান কাটার ভরা মৌসুমে প্রতিবছরই ধান কাটা শ্রমিক সংকটে পড়ে উত্তরা লের অন্যতম প্রধান শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত চলনবিল এলাকার কৃষক।

একই গ্রামের  গ্রামের কৃষক কাজেম প্রামাণিক গত বছর দু’বিঘা জমির পাকা ধান কাটার আগেই আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এরপর শুরু হয় আগাম বন্যা। তলিয়ে যায় তার সব ধান। এবার আশায় বুক বেধে এই কৃষক এ বছরও ধানের আবাদ করেছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধানের ফলনও হয়েছে বাম্পার। জমির ৬০ ভাগ ধান ইতোমধ্যে কাটার উপযোগী হয়েছে। কিন্তু তিনি খুবই উদ্বিঘ্ন তার মাঠের ধান নিয়ে। কোথায়ও পাওয়া যাচ্ছে না কৃষি শ্রমিক। সম্ভাব্য দুর্যোগের আশংকায় কাজেম প্রামাণিক তার জমির আধপাকা ধান কেটে ঘরে তুললেও কাঁচা ধান নিয়ে বড়ই দুশ্চিন্তা তার। তার পরও শ্রমিকের অভাবে কাঁচা ধান কাটতে বিড়ম্বনায় পড়েছেন।

তার মতো একই অবস্থা চলনবিলের বেশিরভাগ কৃষকের। দুর্যোগের আশংকায় ক্ষেতের কাঁচা-পাক ধান কেটে ঘরে তুলছেন চলনবিলের তিনটি জেলার আট উপজেলার কৃষক। তবে ইচ্ছা থাকলেও অনেকেই দুর্যোগের আগে ধান কাটার কাজ শুরু করতে পারছেন না পর্যাপ্ত শ্রমিকের অভাবে।

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলনবিলের পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুরা ও ফরিদপুর উপজেলা, নাটোর জেলার গুরুদাসপুর, বরাইগ্রাম ও সিংড়া উপজেলা এবং সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও রায়গঞ্জ উপজেলায় এ বছর ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে।

এসব এলাকার কৃষি বিভাগের মাঠকর্মী ও কর্মকর্তারা জানান, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোর জেলার আটটি উপজেলার এক দশমিক এক লাখ হেক্টর জমিতে এ বছর বোরো আবাদ করা হয়েছে। এর থেকে প্রায় চার দশমিক পাঁচ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও, এ বছর উৎপাদন চার দশমিক ৭৫ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যাবে।তবে ফলনের এই সফলতা পেতে যথাসময়ে ফসল কাটতে হবে।

সরেজমিনে দেখা যায়, সিংড়া ও রায়গঞ্জ উপজেলার বেশিরভাগ ধান কাটা হলেও এখনও অনেক ধান কাটা বাকি রয়েছে।

নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার পিপলা গ্রামের কৃষক ফিরোজ আলী জানান, গত বছর বন্যার পানি নামার পর সরিষা আবাদ করে, তারপর ধানের আবাদ করা হয়। ফলে ধান লাগাতে কিছুটা দেরি হয়। ধান কাটা শুরু করতে আরও প্রায় দু’সপ্তাহ লাগে। তবে, প্রকৃতি কী আচরণ করবে তার ওপর নির্ভর করছে কতটা ধান এ বছর ঘরে তোলা যাবে। আসন্ন দুর্যোগের হাত থেকে কতটা ফসল রক্ষা করতে পারবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন কৃষক।

ফরিদপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ রোকনুজ্জামান বলেন, ‘ফরিদপুর উপজেলার মাত্র ৪৫ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে।’ এখনও ৫৫ ভাগ ধান কাটতে বাকী আছে।

চলনবিলের অন্যতম প্রধান ধান উৎপাদনকারী এলাকা পাবনার চাটমোহর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মোঃ মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ জমির ধান ইতোমধ্যে কাটার উপযোগী হয়েছে। তবে শ্রমিক সংকটের কারণে আনেকেই সময় মতো ধান ঘরে তুলতে পারছেন না। আসন্ন দুর্যোগের কথা বিবেচনা করে ইতোমধ্যে কৃষকদের পাকা ধান কেটে ঘরে তোলার আহ্বান জানিয়ে মাইকিং করা হয়েছে।’ এই মাইকিং এর শব্দ কানে পৌঁছা মাত্র কৃষকের ঘুম চোখ থেকে যেন হারিয়ে গেছে। শ্রমিক সংকটের কারণে চলনবিলের বেশিরভাগ এলাকায় পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ করছেন। আবার অনেকে আত্বীয়স্বজন নিয়েও ধান কাটছেন। যাতে করে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এর আগেই ধান ঘরে তুলতে পারেন।

পাবনা কৃষি সম্প্রসাপরণ অধিদপ্তরের পরিসখ্যান বিভাগের কর্মকর্তা মোঃ ইদ্রিস আলী জানান,‘ যেহেতু কয়েকটি জেলা মিলে চলনবিল এলাকা। তাই নির্দিষ্ট করে জেলায় চলনবিল এলাকা উল্লেখ করে আবাদের লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করা হয় না। তবে ব্যাপকহারে চলনবিলে বিভিন মৌসুমী ফসল অর্থাৎ ধান গম, সারিষা আবাদ হয়ে থাকে।