বিভ্রান্তিকর তথ্য সরবরাহ: শাস্তি পেতে যাচ্ছেন কুবি শিক্ষক

বিভ্রান্তিকর তথ্য সরবরাহ: শাস্তি পেতে যাচ্ছেন কুবি শিক্ষক

মাহবুবুল হক ভূঁইয়া-

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক প্রথম বর্ষের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল নিয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও সহকারী প্রক্টর মাহবুবুল হক ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য সরবারহ করার বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কমিটি। এ ঘটনায় ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আচরণ ও শৃঙ্খলাবিধি-২০১৮ অনুসরণ করে বিভাগীয় ব্যবস্থার নির্দেশ দিয়েছে বিশ্ববদ্যিালয়ের সিন্ডিকেট। রোববার (২৭ জুন) সন্ধ্যা সাতটায় অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০তম সিন্ডিকেটে এ সিন্ধান্ত নেয়া হয়। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৯ নভেম্বর বিভিন্ন গণমাধ্যমে ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ‘কুবিতে পরীক্ষা না দিয়ে মেধা তালিকায় ১২ তম’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হয়। এর প্রেক্ষিতে ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির শঙ্কা সৃষ্টি হলে ৩০ নভেম্বর ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত করে ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে ৩ ডিসেম্বর সেই তদন্ত কমিটি সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, জালিয়াতি নয় বরং অন্য এক শিক্ষার্থী ভুল রোল নাম্বার ভরাট করায় এবং এ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকায় অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর ও.এম.আর মেশিনে ফলাফল চলে আসে। এতে এ পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও মেধাতালিকায় ১২ তম হয়। সেই সময়ে অভিযোগ উঠে সংশ্লিষ্ট ইউনিটের ভর্তি কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন এক সদস্য বিভ্রান্তি ছড়াতে ইচ্ছাকৃতভাবে এ তথ্য সরবারহ করে। এরপর ৫ ডিসেম্বর উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গণমাধ্যমে মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে শিক্ষক সমিতি মানববন্ধন করে। 

এরপর ১২ ডিসেম্বর ঘটনা তদন্তে সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ট্রেজারার অধ্যাপক ড. মোঃ আসাদুজ্জামানকে আহ্বায়ক, সহকারী রেজিস্ট্রার আমিরুল হক চৌধুরকে সদস্য সচিব এবং ম্যানেজম্যান্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আহসান উল্যাহ ও লোক প্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জান্নাতুল ফেরদৌসকে সদস্য করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি তদন্ত শেষে গত বছরের ফেব্রুয়ারির দিকে প্রতিবেদন জমা দিলেও এক বছরের বেশি সময় পর গতকাল সিন্ডিকেটে বিষয়টি উঠানো হয়। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, ‘ব্যক্তিস্বার্থের কারণে কাউকে ফাঁসানোর জন্য উদ্দ্যেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে যদি বিভ্রান্তিমূলক তথ্য সরবরাহ করা হয় সেটার জন্য অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিৎ। বি ইউনিটের বিষয়টি সম্পূর্ণ উদ্দ্যেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা হয়েছে।’ 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাহবুবুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বা সিন্ডিকেট থেকে কিছুই জানানো হয়নি। তাই এটা নিয়ে আমি মন্তব্য করতে পারবো না।’ 

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের বলেন, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের বি ইউনিটের ভর্তির পরীক্ষা নিয়ে গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য সরবারহের ঘটনায় তদন্ত কমিটি প্রবেশপত্র বাছাই কমিটির সদস্য ও গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহবুবুল হক ভূঁইয়ার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে। বিষয়টি প্রবেশপত্র বাছাই কমিটি থেকেই লিক করা হয়েছে। যা আইন পরিপন্থী ও আচরণবিধি লঙ্ঘন। পরীক্ষার কাজ চলাকালীন সময়ে কেউ বাইরে ফোন করতে পারেন না। তদন্ত প্রতিবেদনে ওই শিক্ষককে দোষী সাবস্ত্য করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আচরণ ও শৃঙ্খলাবিধি-২০১৮ অনুসারে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও বর্তমান ট্রেজারার অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামান বলেন, গোয়েন্দা সংস্থাসহ সকলের সহযোগিতায় উচ্চতর তদন্ত হয়েছে। কমিটির সকলে এ বিষয়ে একমত এবং এটি প্রমাণিত যে মাহবুবুল হক ভূঁইয়া তিনি ওই তথ্য সরবরাহ করেছেন এবং তিনিই এর জন্য দায়ী। 

এবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরী জানান, বি ইউনিটের ঘটনাটি আচরণ ও শৃঙ্খলাবিধি-২০১৮ অনুসরণ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কাজ করবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এখানে কিছু করার নেই। বিধি অনুযায়ী যে ব্যবস্থা আসবে তাই হবে। 

প্রসঙ্গত, ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষের ‘বি’ ইউনিটের ২০৬০৫০ রোলধারী সাজ্জাতুল ইসলাম ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করলেও প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গিয়েছিল, তিনি ১২তম হয়েছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি মো. সাজ্জাতুল ইসলামের রেজাল্ট পর্যালোচনা করে। 

তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে, ১২তম হওয়া সাজ্জাতুল ইসলামের রোল ছিল ২০৬০৫০। কেন্দ্র ছিল কোটবাড়ির টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রশাসনিক ভবনের নিচতলার ৫নং কক্ষ। কিন্তু ওই কক্ষে পরীক্ষার্থীর উপস্থিতির স্বাক্ষর তালিকায় তার স্বাক্ষর ছিল না। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নের সময় এই রোল নম্বরের উত্তরপত্র পাওয়া যায় এবং ওএমআর মেশিনের মাধ্যমে এ উত্তরপত্র মূল্যায়িত হয় এবং ফল তৈরি হয়। ফল তৈরি হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ইউনিটের প্রবেশপত্র যাচাই-বাছাই কমিটি মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর প্রবেশপত্রের কপি যাচাই-বাছাই করে। এ সময় সাজ্জাতুল ইসলামের প্রবেশপত্রও পাওয়া যায়নি। ফলাফলের পর তিনি মৌখিক সাক্ষাৎকারেও অংশগ্রহণ করতে আসেননি। 

তখন অভিযোগ উঠে সংশ্লিষ্ট ইউনিটের ভর্তি কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন সদস্য বিভ্রান্তি ছড়াতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে এ তথ্য সরবারহ করে। পরবর্তীতে ঘটনা তদন্তে সিন্ডিকেটের নির্দেশক্রমে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়। এ কমিটি তদন্ত শেষে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিবেদন জমা দেয়। দীর্ঘ সময় পর গতকাল এই প্রতিবেদন সিন্ডিকেটে উপস্থাপন করা হয়।