তালাক নোটিশের পরের ৯০ দিন দম্পতিদের মিটমাটের সুযোগ থাকে কতটা?

তালাক নোটিশের পরের ৯০ দিন দম্পতিদের মিটমাটের সুযোগ থাকে কতটা?

তালাক নোটিশের পরের ৯০ দিন দম্পতিদের মিটমাটের সুযোগ থাকে কতটা?

বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে নগর-গ্রাম নির্বিশেষে ডিভোর্স বা বিবাহবিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আইন অনুযায়ী মীমাংসার জন্য ৯০ দিন সময় দেয়া হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই সময়ে স্বামী-স্ত্রী যারা সম্পর্কের ইতি টানতে চান, তাদের উভয় পক্ষকে এক সঙ্গে নিয়ে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের সুযোগ দেয়া।

কিন্তু বাংলাদেশে এই আলাপ আলোচনার কাজটি এখনো মূলত পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং কাছের মানুষেরা করে থাকেন।পৃথিবীর অনেক দেশে এ ক্ষেত্রে মনোবিদ বা ম্যারেজ কাউন্সেলরের পেশাদার সাহায্য নিতে পারেন কোন দম্পতি।কিন্তু বাংলাদেশে পেশাদার কারো কাছ থেকে সাহায্য কমই পান বিবদমান পক্ষ দুইটি।

বিবাহবিচ্ছেদ এবং ৯০ দিন সময়

বাংলাদেশে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী তালাক দিতে চাইলে একজন ব্যক্তিকে তিন দফায় আইনি পত্র বা ডিভোর্স লেটার পাঠাতে হয়।প্রতি ৩০ দিনের ব্যবধানে একেকটি চিঠি পাঠাতে হয়। ৯০ দিনের মধ্যে কোন সমঝোতা না হলে তালাক কার্যকর হয়।

সব কটি দফায় প্রথম স্বামী বা স্ত্রী যাকে সেটি পাঠানো হবে, তার ঠিকানার সাথে স্বামী বা স্ত্রী যে এলাকায় বসবাস করেন সেখানকার স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান বা সিটি কর্পোরেশন মেয়র বা কাউন্সিলরকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশের কপি পাঠাতে হয়।এসময় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান বা সিটি কর্পোরেশন মেয়র বা কাউন্সিলর দুই পক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসতে পারেন।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা সালেহা বিনতে সিরাজ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, এ ধরনের আলোচনায় বসা গেলে অনেক সময়ই দুই পক্ষের জন্য ভালো হয়।তিনি বলেন, "অনেক ক্ষেত্রে বিবাদ মিটিয়ে পুনরায় সংসারে ফিরিয়ে নেয়া যায় স্বামী-স্ত্রীকে। কারণ এ ধরনের আলোচনায় আমাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে রিকনসিলিয়েশন বা পুনর্মিলন ঘটিয়ে দেয়ার। সংখ্যায় কম হলেও সেটা করা যায় অনেক সময়।"

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে ২০২০ সালে সাড়ে ১২ হাজারের বেশি ডিভোর্স হয়েছে। এর অর্ধেকের মত হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে।সালেহা বিনতে সিরাজ জানিয়েছেন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ২০২০ সালে তালাকের জন্য আবেদনকারী ৩৮৪টি দম্পতি আলোচনার মাধ্যমে বিবাদ মিটিয়ে নতুন করে সংসার শুরু করেছেন।তবে তিনি জানিয়েছেন, অনেক সময়ই আলোচনায় বসানো যায় না দুই পক্ষকে।

অনেকে ডিভোর্স লেটারে ইচ্ছা করে ভুল ঠিকানা দেয়, তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার অনেকের প্রচণ্ড অনীহা থাকে আপোষ করার ব্যাপারে।তবে এখনো সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব মনোবিদ বা ম্যারেজ কাউন্সেলর নেই।

আলোচনায় অনীহা

তালাক কার্যকর হবার আগে ৯০ দিন সময় দেয়া হয় যাতে কোন দম্পতির বিরোধ মীমাংসায় তৃতীয় আরেকটি পক্ষ, যিনি কোন একটি পক্ষের প্রতি বিশেষ অনুগত নন, নিরপেক্ষভাবে উভয়ের সমস্যা শুনে সমাধানের একটি উপায় বের করতে পারেন।কিন্তু অনেকেই বাইরের মানুষের সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত বিষয় আলাপ করতে চান না।ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী একজন নারী বিবিসিকে বলছিলেন, ২০১৭ সালে তিনি তার স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্কে ইতি টেনেছেন।

তার তৎকালীন স্বামীকে প্রথম দফা ডিভোর্সের চিঠি পাঠানোর পর, স্থানীয় কাউন্সেলরের অফিস থেকে তাকে এবং তার স্বামীকে চিঠি দিয়ে আলোচনার জন্য ডাকা হয়েছিল।কিন্তু তার স্বামী সেখানে যাননি।

বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেবার আগে যখন প্রায় নিয়মিত তাদের মধ্যে মনোমালিন্য হচ্ছিল, তখনো তিনি কাউন্সেলরের কাছে যেতে চেয়েছেন একাধিকবার।কিন্তু তখনো তার স্বামী রাজি হননি, তিনি এ বিষয়ে কারো সাথে আলাপ করতেই রাজি ছিলেন না।

পেশাদার ম্যারেজ কাউন্সেলর

বাংলাদেশে এক দশক আগেও পেশাদার ম্যারেজ কাউন্সেলর পদটির সঙ্গে পরিচয় ছিল না সাধারণ মানুষের।গত এক দশকে শহর এলাকায় বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর মত বড় বিভাগীয় শহরে বেশ কিছু পেশাদার ম্যারেজ কাউন্সেলিং প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

কিন্তু এখনো এই সেবা গ্রহীতার সংখ্যা কম এবং তারা নাগরিক মানুষ।ঢাকায় কাউন্সেলিং সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান 'ক্রিয়া'র ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট হাজেরা খাতুন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, শুরুতে একেবারেই হাতে গোনা মানুষ আসতেন এই সেবা নিতে।

সেসময় অনেকে নাম পরিচয় গোপন রাখতে চাইতেন।তবে ২০১৬ সালের পর থেকে ম্যারেজ কাউন্সেলিং বা ফ্যামিলি কাউন্সেলিং সেবা নিতে আসা মানুষের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে।মিজ খাতুন বলছেন, তারা ডিভোর্সের আগে, ডিভোর্সের সময় এবং ডিভোর্স পরবর্তী---এই তিন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন কাউন্সেলিং সেবা দেন।

"প্রথমে সমস্যা শুনি, এরপর যিনি সেবা নিতে এসেছেন তার সাথে অপর পক্ষের সঙ্গেও যোগাযোগ করি। উভয় পক্ষ সম্মত হলে একসঙ্গে নিয়ে বসে আলোচনা করি।আমরা কোন সিদ্ধান্ত দেই না, বরং তারা যে পরিস্থিতিতে আছেন এবং যে সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন, তার সম্ভাব্য ফলাফল ও প্রভাব সম্পর্কে উভয়ের কাছে একটি পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরি।"

এরপর যে যার সুবিধা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়।হাজেরা খাতুন জানিয়েছেন, সেবা নিতে এখনো পর্যন্ত নারীরাই বেশি আসছেন।এছাড়া প্রথম আলোচনার পর অনেক পুরুষই আর দ্বিতীয়বার ফেরত আসতে চান না।

তিনি বলেন, "কাউন্সেলরের কাছে যাওয়া নিয়ে সমাজে এক ধরনের স্টিগমা আছে, সেটা এখনো অনেকে কাটিয়ে উঠতে পারেননি।"তবে মনে রাখতে হবে সাহায্য চাওয়ার মধ্যে কোন লজ্জা নেই---বলছেন মিজ খাতুন।

সূত্র : বিবিসি