কতটা নিরাপদ পশ্চিমবঙ্গ?

কতটা নিরাপদ পশ্চিমবঙ্গ?

কতটা নিরাপদ পশ্চিমবঙ্গ?

ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র রিপোর্টে  সবচেয়ে নিরাপদ মেট্রো শহর কলকাতা। মহানগরে নারীসহ অন্যদের বিরুদ্ধে অপরাধের হার নিম্নমুখী। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এসিড হামলার নিরিখে ভারতের শীর্ষে। সাইবার অপরাধও বাড়ছে।

গত দু'বছরের তুলনায় কলকাতায় অপরাধের সংখ্যা কমেছে। এমনকি নারীঘটিত অপরাধের দিক থেকেও দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরুর থেকে নিরাপদ শহর কলকাতা। কিন্তু রাজধানীর ছবিটা স্বস্তিদায়ক হলেও রাজ্যের ছবিটা আলাদা।

প্রথম লকডাউনের সময় থেকেই এ রাজ্যের মেয়েরা গৃহনির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন। এবার তাতে সিলমোহর দিল এনসিআরবি ২০২০-র রিপোর্ট। বধূ নির্যাতনের ঘটনা যেমন এক বছরে বেড়েছে আড়াই হাজারের বেশি, তেমনি সাইবার অপরাধের শিকারও হয়েছেন মহিলারাই বেশি। গত বছর বাংলায় বধূ নির্যাতনের মামলা দায়ের হয়েছিল ১৯ হাজার ৯৬৬টি। অথচ এক বছর আগে এই সংখ্যাটা ছিল ১৭ হাজার ১৫০। আত্মহত্যায় প্ররোচনা, কটূক্তির ঘটনাও বেড়েছে।

এসিড হামলার চিত্র

এসিড হামলার পরিসংখ্যানে শীর্ষে পশ্চিমবঙ্গ। সাত বছরের মধ্যে এই নিয়ে তিনবার শীর্ষে বাংলা, চারবার দ্বিতীয়! সারা দেশে যেখানে সংখ্যাটা ১৮৩, বাংলা-উত্তরপ্রদেশ মিলিয়ে তা ৮৩। এনসিআরবি-র রিপোর্টে ২০১৪ থেকে গত সাত বছরে এসিড হামলার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম বা দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। অপরাধ তো হচ্ছে, বিচার মিলছে কি? ২০১৫ সালে চার মাসের ব্যবধানে এসিড হামলার শিকার হন দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরের মনীষা পৈলান(২৭) এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরের পারমিতা বেরা(২৪)। ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথাবার্তায় তাঁরা বলেন, দোষীরা শাস্তি পায়নি। এমনকি এসিড আক্রান্তদের

ক্ষতিপূরণ পেতেও অনেক সমস্যা তৈরি হয়েছে বহু ক্ষেত্রে। মনীষা বলেন, "আমার ক্ষতিপূরণের টাকাটা পেতেও আমায় আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। আমার বাবাকে প্রচুর ছোটাছুটি করতে হয়েছে। একটা এসিড আক্রান্ত মেয়ে চিকিৎসার জন্য ছোটাছুটি করবে নাকি আদালতের দ্বারস্থ হবে নাকি ক্ষতিপূরণ চাইতে আদালতে যাবে?”

যাদবপুরের ছাত্রী পারমিতার কথায়, "এসিড খুব সহসজলভ্য। অথচ সুপ্রিম কোর্টের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও খোলাবাজারে এসিড বিক্রি হয়, ৫০০ মিলিলিটারের দাম ৩৩ টাকা মাত্র।" পারমিতা ও মনীষার দুর্ঘটনার সাত বছর পরেও পশ্চিমবঙ্গ এসিড আক্রমণে শীর্ষে। টার্গেট কেন নারীরা? এই দুই তরুণীর ক্ষেত্রে উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রেমের প্রস্তাব আসে, অস্বীকার করায় তারা এসিড আক্রান্ত হন। নারী অধিকার কর্মী অধ্যাপিকা শাশ্বতী ঘোষ বলেন, "মেয়েরা স্বনির্ভর হতে চাইছেন, ফলে তারা পুরুষদের সব আচরণ সমর্থন করছেন না। এতেই পুরুষতন্ত্রের রাগ আরও বেড়ে যাচ্ছে।”

মেয়েরা পিছিয়েই

এ রাজ্যে কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্প জনপ্রিয় হয়েছে। এ সব প্রকল্পের কেন্দ্রে নারীরাই। কিন্তু তাতে নারীর ক্ষমতায়ন হলেও এসিড আক্রান্তদের সমস্যা মেটে না কেন? ‘সাউথ কলকাতা সান্নিধ্য' নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন নারী অধিকার কর্মী স্বাতী চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, "বেশিরভাগ এসিড আক্রান্তই জানেন না যে তারা ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন। দোষীরা শাস্তি পায় না।

পলাতক বলে পুলিশের ফাইলে নাম ওঠে। " এসিডে পোড়া এবং অন্য পোড়ায় প্রভেদ অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের টাকার বৈষম্য আছে। স্বাতী বলেন, "২০১৩ সালের নভেম্বরে এসিড আক্রমণজনিত যে নীতি এসেছে, সেটা এখনও চালু করা গেল না! উল্টে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সময় অপমানকর কথা বলা হয়।" পারমিতা বলেন, "আমরা পরীক্ষা দিয়ে চাকরির চেষ্টা করছি। যাদের দুটো চোখই নষ্ট হয়েছে, তাদের কী হবে?''

নারী দিবস থেকে পুজোপার্বণ, পারমিতা এবং মনীষা প্রতিবারই আমন্ত্রিত হন। ছবি ওঠে, খবর বেরোয়, কিন্তু তাতে পাল্টায় না মহিলাদের অবস্থান। শাশ্বতী বলেন, "আমাদের বিচার ব্যবস্থায় ফাঁক থেকে গিয়েছে। এসিড বা আগুনে পোড়া মেয়েটির শারীরিক অবস্থা নিয়ে পরিবার পরিজন এত ব্যস্ত থাকেন যে আক্রান্তের বয়ান ঠিকভাবে বলা হচ্ছে কিনা, তা খেয়াল করা হয় না। আদালতে তাই মামলা টেকে না।"

বদলাচ্ছে অপরাধের চরিত্র

এসিড হামলা মেয়েদের উপর সহিংসতার এক প্রাচীন পন্থা। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে নয়া পন্থা হিসেবে বাড়ছে সাইবার অপরাধ। এ ব্যাপারে এনসিআরবি-র রিপোর্ট বলছে, কলকাতায় ২০২০ সালে ১৭২টি মামলার মধ্যে ৫৪টি ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত প্রতিশোধ চরিতার্থ করতে সাইবার অপরাধ হয়েছে। কেমন সেই প্রতিশোধ? প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বা ব্যর্থ হয়ে ভুয়ো প্রোফাইল থেকে অশ্লীল ছবি আপলোড করা হচ্ছে। গত বছর কলকাতায় ১৫টি সাইবার অপরাধের পেছনেও কারণ ছিল যৌন হেনস্থা। শাশ্বতী বলেন, "শুধু যৌন হেনস্থা কেন, একটা মেয়ে রাজনৈতিক বা অন্য কোনো বক্তব্য রাখলে তাকে ইমেইলে ধর্ষণের  হুমকি পেতে হয়। কে এ সবের বিচার করছে?”

সূত্র : ডয়েচে ভেলে