আল্লাহর অনুগ্রহের পথে ফিরুন

আল্লাহর অনুগ্রহের পথে ফিরুন

আল্লাহর অনুগ্রহের পথে ফিরুন

পাপাচারে পৃথিবী এখন অনেকটাই ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। মানুষের ব্যক্তি চরিত্র থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক চরিত্র শয়তানের বিস্তৃত জালে আটকা পড়েছে। বেহায়াপনা, জেনা-ব্যভিচার ও ভোগের সাম্র্রাজ্যে চলছে মাতলামি। শয়তান তার চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নে মানুষের সামনে, পেছনে, ডানে ও বাঁয়ে ওঁৎ পেতে থেকে যেন অনেকটা সফল হয়েছে। ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটার পর একটা বিপদ নেমে আসছে পৃথিবীতে। আল্লাহর এই গজব থেকে বাঁচতে হলে খুব দ্রুতই শয়তানের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে হবে। আল্লাহর রহমতের ছায়াতলে ফিরে আসতে হবে। এই ফিরে আসার নামই তাওবা। হতাশার কিছু নেই। অবশ্যই আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর রহমতের ছায়ায় স্থান দেবেন। তিনি বিশাল দয়ার মালিক।

বৈধতার আকর্ষণ সৃষ্টি করে শয়তান মায়াবী জাল পেতে রেখেছে। যেকোনো মুমিন পুরুষ অথবা নারী সতর্কতার পরও যেকোনো সময় শয়তানি জালে পা রাখতে পারে। আল্লাহ অন্যান্য সৃষ্টির মতো যেহেতু মানুষকে তার কঠিন বন্ধনে আবদ্ধ না করে তাকে দান করেছেন স্বাধীন বিবেক। তাই ভালো-মন্দ যেকোনো কিছু করার সুযোগ তার রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘মানব আত্মার শপথ, আর সেই সত্তার শপথ, যিনি তাকে সুগঠিত করেছেন। অতঃপর তার মধ্যে অন্তর্গত করে দিয়েছেন সীমা লঙ্ঘনের (ফুজুরের) প্রবণতা আর সীমার অবস্থানের (তাকওয়ার) প্রবণতা। সফল হলো সে ব্যক্তি, যে তার তাকওয়ার প্রবণতাকে বিকশিত ও উন্নত করেছে। আর ধ্বংস হলো সে, যে তার তাকওয়ার প্রবণতাকে দাবিয়ে দিয়েছে।’ (সূরা শামস : ৭-১০)

ভালো ও মন্দ উভয় প্রবণতাই মানুষের ভেতর অবস্থান করছে। একজন মুমিন-মুসলমান আমৃত্যু অবিরত তাকওয়াকেই বিকশিত করতে থাকবে। এর পরও যে মাঝে মধ্যে পা পিছলে যাবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ শয়তান তখন আরো ভালো করে তার পিছু নিয়ে পদস্খলনও ঘটিয়ে দিতে পারে। তাই বলে করুণার আঁধার মহান আল্লাহ ফিরে আসার সদর দরজা কি বন্ধ করে দিয়েছেন? কখনো নয়। বরং তিনি তাঁর করুণার দরজা বান্দার জন্য সর্বদা খুলে রেখেছেন। ব্যর্থ মনোরথ বান্দা সারা পৃথিবীর কোথাও আশ্রয় না পেয়ে আবার যাতে তাঁর অনুগ্রহের সীমানায় চলে আসে, সে জন্য তিনি তাঁর দরবারের করুণার দরজাটি দিনে-রাতে খুলে রেখেছেন। ফিরে আসার এ যে রাস্তা তার নাম তাওবা।

তাওবা শব্দের অর্থ অনুতপ্ত হওয়া, লজ্জিত হওয়া, ফিরে আসা বা প্রত্যাবর্তন করা। পারিভাষিক অর্থে তাওবা মানে- ভুল পথে ধাবিত ব্যক্তির হঠাৎ সচকিত হয়ে সম্বিত ফিরে পাওয়া। অনুতপ্ত, অনুশোচনা ও নিজের কৃতকর্মে লজ্জিত হয়ে ভবিষ্যতে ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে না এ নিশ্চয়তা প্রদান করে অত্যন্ত খাঁটি দিলে আল্লাহর দিকে ফিরে আসাকে তাওবা বলা হয়। গোনাহ করার পর তাওবার অর্থ হচ্ছে এই যে, যে দাসটি তার প্রভুর নাফরমান ও অবাধ্য হয়ে প্রভুর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সে এখন নিজের কাজে অনুতপ্ত। সে প্রভুর আনুগত্য করার ও তাঁর হুকুম মেনে চলার জন্য ফিরে এসেছে। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার দিকে তাওবা করার মানে হচ্ছে এই যে, দাসের ওপর থেকে প্রভুর যে অনুগ্রহ দৃষ্টি সরে গিয়েছিল তা আবার নতুন করে তার প্রতি নিবদ্ধ হওয়া। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তবে এ কথা জেনে রাখো, আল্লাহর কাছে তাওবা কবুল হওয়ার অধিকার একমাত্র তারাই লাভ করে যারা অজ্ঞতার কারণে কোনো খারাপ কাজ করে বসে এবং তারপর অতিদ্রুত তাওবা করে। এ ধরনের লোকদের প্রতি আল্লাহ আবার তাঁর অনুগ্রহের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন এবং আল্লাহ সমস্ত বিষয়ের খবর রাখেন, তিনি জ্ঞানী ও সর্বজ্ঞ।’ (সূরা নিসা-১৭)

মহান আল্লাহ তায়ালা এ আয়াতে বলেন, ‘আমার এখানে ক্ষমার দরজা একমাত্র সেই সব বান্দার জন্য উন্মুক্ত রয়েছে, যারা ইচ্ছা করে নয় বরং অজ্ঞতার কারণে ভুল করে বসে এবং চোখের ওপর থেকে অজ্ঞতার পর্দা সরে গেলে লজ্জিত হয়ে নিজের ভুলের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হয়। এমন বান্দা তার ভুল বুঝতে পেরে যখনই প্রভু মহান রাব্বুল আলামিনের দিকে ফিরে আসবে তখনই নিজের জন্য তাঁর দরজা উন্মুক্ত দেখতে পাবে।

আল্লাহর এক নাম আত তাওয়াব, অর্থাৎ তাওবা কবুলকারী। এটি আল্লাহ তায়ালার আশা ও উৎসাহদানকারী গুণ। আল কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় এ গুণটি বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে যারা এখনো পর্যন্ত বিদ্রোহ করে চলেছে অথবা যারা বারবার বিপথগামী হয়ে যায় তারা যেন নিরাশ না হয় বরং এ কথা ভেবে নিজেদের আচরণ পুনর্বিবেচনা করে যে, এখনো যদি তারা এ আচরণ থেকে বিরত হয় তাহলে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করতে পারে।

আমাদের দেশে তাওবার ব্যাপারে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। তা হলো- পাপকাজ হচ্ছে, একটু বয়স হলে বা হজ থেকে এসে তাওবা করে এ কাজ ছেড়ে দেবো অথবা একটু বয়স হলে কর্তব্যের কাজটি শুরু করব। অনেক সময় দেখা গেছে, প্রকৃতপক্ষে বয়স হলেও ভালো কাজ করার সুযোগ আর এদের ভাগ্যে জোটে না। মূলত অপরাধ জানার সাথে সাথে তাওবা করতে হবে। বয়স হলে তাওবা করে খারাপ কাজ ছেড়ে দেবেন বা ভালো কাজ শুরু করবেন এ ধরনের ব্যবস্থা ইসলামে নেই। তা ছাড়া হঠাৎ যদি পরকালে চলে যাওয়ার ডাক এসে যায়, তবে তো নিজের পায়ে কুড়াল মারলেন। আমাদের সমাজে অনেক সময় ব্যক্তির মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে তাকে অজু-গোসল দিয়ে একজন হুজুর ডেকে এনে তাওবার ব্যবস্থা করা হয়। এই তাওবার মহড়া কি আল্লাহ কবুল করবেন? কুরআন-হাদিসে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা দেখা যায় না।

যারা আল্লাহকে ভয় না করে সারা জীবন বেপরোয়াভাবে গোনাহ করতে থাকে তারপর ঠিক যখন মৃত্যুর ফেরেশতা সামনে এসে দাঁড়ায় তখন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে থাকে, তাদের জন্য তাওবা নেই, তাদের গোনাহের কোনো ক্ষমা নেই। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার তাওবা কবুল করতে থাকেন যতক্ষণ মৃত্যুর আলামত দেখা না দেয়।’ কারণ যৌবন ও কৈশোরের মূল্যবান সময় বেহুদা সব কাজে ব্যয় করে এখন এ অসার ও মূল্যহীন জীবনটা আল্লাহর কী প্রয়োজনে আসবে। এখন সে এমন এক স্থানে এসে দাঁড়িয়েছে যেখান থেকে আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পায় না। এখন আর তার প্রভাব প্রতিপত্তি, জান-মাল ও সন্তান-সন্ততি তাকে আর বাহাদুরির শক্তি জোগায় না। রঙিন দুনিয়ার শেষ প্রান্তে এসে যখন পরবর্তী জীবনের হাতছানি দেখছে, এখন তার সম্বিত ফিরে এসেছে আর তাই তাওবার হাত আল্লাহর দিকে প্রসারিত করেছে। আল্লাহ এ হাত কবুল করবেন না। তাওবা সময় থাকতে করতে হবে।

কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হলে তার আত্মীয়-স্বজনরা কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করে থাকে। লাশ কবরে রাখার সময় নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়ে থাকে। ‘বিসমিল্লাহি আলা মিল্লাতে রাসূলিল্লাহ’। অর্থাৎ আল্লাহর নামে রাসূল সা:-এর দলে রেখে গেলাম। প্রশ্ন জাগে, ব্যক্তি জীবিতাবস্থায় যদি রাসূলুল্লাহ সা:-এর দলভুক্ত না হন, তাহলে মূল্যহীন গলিত পচা লাশটি রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর দলে নিয়ে কী করবেন? রাসূল সা: তো তাঁর দায়িত্বের বোঝা জীবিত লোকের কাছে রেখে গিয়েছিলেন। কেয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নবী আসবেন না। এ দায়িত্ব আমাদের জীবিতদেরই পালন করতে হবে।সময় থাকতে সবাইকে সঠিক পথে ফিরে আসতে হবে। তাওবা করতে হবে। যে কয়টি বছর জীবন থেকে ঝরে গেছে, তার জন্য অনুতপ্ত ও লজ্জিত হতে হবে। কুরআন ও হাদিসের আলোকে জীবনের সঠিক লক্ষ্য ঠিক করে, তাতে চলার চেষ্টা করতে হবে। মহান আল্লাহ মাফ করে দিতে পারেন।