কবে আর কীভাবে টাকা ফেরত পাবেন ই-কমার্সের ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা?

কবে আর কীভাবে টাকা ফেরত পাবেন ই-কমার্সের ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা?

কবে আর কীভাবে টাকা ফেরত পাবেন ই-কমার্সের ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা?

বাংলাদেশের ই-কমার্স পেমেন্ট গেটওয়েগুলোতে আটকে থাকা অর্থ ছাড় করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক চিঠি পাঠালেও হালনাগাদ তথ্যের অভাবে সেই প্রক্রিয়া আটকে গেছে। তথ্য জানতে পুলিশ সদরে দপ্তরে চিঠি পাঠাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।ফলে কবে নাগাদ গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেয়া শুরু হবে, তা এখনো জানাতে পারছেন না কর্মকর্তারা।

আর ইভ্যালির কাছে আটকে থাকা টাকা কবে, কীভাবে ফেরত হবে, তার এখনো কোন পরিকল্পনা হয়নি। হাইকোর্ট নির্ধারিত পরিচালনা পর্যদ এখন ইভ্যালির দায়দেনা ও আর্থিক চিত্র বোঝার চেষ্টা করছে।বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, ইভ্যালি পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

কত টাকা আটকে আছে?

বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ই-কমার্স খাতের কারিগরি কমিটি মঙ্গলবার যে সভা করেছে, সেখানে জানানো হয়েছে যে, বর্তমান পেমেন্ট গেটওয়েগুলোয় গ্রাহকদের প্রায় ২১৪ কোটি টাকা আটকে আছে।

ইভ্যালি কাণ্ডের পর এই বছরের পহেলা জুলাই থেকে সব লেনদেন পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে করার নিয়ম বেঁধে দেয় সরকার। এর ফলে যারা কোন পণ্য কিনেছেন, সেই টাকা পেমেন্ট গেটওয়েতে গিয়ে জমা হয়েছে। পণ্য সরবরাহ করার পর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান মূল্য পাবে।

তবে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস নাগাদ ইভ্যালিসহ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। সেসব প্রতিষ্ঠানের অর্থ এই পেমেন্ট গেটওয়েতে জমা রয়েছে।এর বাইরে ৩০শে জুন পর্যন্ত ইভ্যালিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে পণ্যের জন্য অগ্রিম জমা দেয়া গ্রাহকদের ৩৮৭ কোটি টাকা আটকে রয়েছে।

বিবিসি বাংলার সঙ্গে গত জুলাই মাসে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী বলেছিলেন, তারা মানুষের কাছ থেকে যে পরিমাণ টাকা নিয়েছে এবং তাদের সাপ্লায়ারদের কাছ থেকে যে পরিমাণ টাকা নিয়েছে, তার মোট অঙ্ক প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু প্রাথমিক তদন্তে তাদের কাছে সেই টাকার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।"

কীভাবে টাকা ফেরত পাবেন ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা?

ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে পেমেন্ট গেটওয়েগুলোয় আটকে থাকা ২১৪ কোটি টাকা গ্রাহকদের হিসাবে ফেরত দিতে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য চিঠি পাঠিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

সেই চিঠিতে বলা হয়, যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোন মামলা চলমান নেই, সেসব প্রতিষ্ঠানের নামে এসক্রো সার্ভিসে ভোক্তাদের আটকে থাকা অর্থ ফেরত দেয়া হবে।এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পেমেন্ট গেটওয়েগুলোকে অর্থ ছাড়ের নির্দেশ দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়।

ই-কমার্স খাতের কারিগরি কমিটির সমন্বয়ক এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ''৩০শে জুনের পরে ই-কমার্স পেমেন্ট গেটওয়েতে যে টাকাগুলো আটকে ছিল, সেগুলো ফেরত দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংও নিয়েছি। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকে একটা চিঠিও পাঠিয়েছিলাম। বাংলাদেশ ব্যাংকও তাদের পেমেন্ট গেটওয়েকে ফেরত দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে।''

তিনি জানান, এই বিষয় নিয়ে মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে ই-কমার্স প্রতারণা মামলাগুলোর তদন্তকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধিরা ছিলেন।

''সিআইডি, এসবি, ডিবি, অন্যান্য সংস্থাও মামলাগুলোর তদন্ত করছে। এসব কারণে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কোন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কী মামলা রয়েছে, সেটা জানতে পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি পাঠানো হবে। এরপর যেসব প্রতিষ্ঠান নিয়ে মামলা নেই, সেসব প্রতিষ্ঠানের আটকে থাকা টাকা গ্রাহকদের কাছে ফেরত পাঠানো হবে,'' বলছেন মি. সফিকুজ্জামান।বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে আটকে থাকা টাকা ফেরতের জন্য গ্রাহকদের অপেক্ষা করতে হবে মামলার রায় হওয়া পর্যন্ত।

পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে থাকা অর্থের সিংহভাগই ইভ্যালি ও ধামাকার মতো প্রতিষ্ঠানের পণ্য কিনতে অর্ডারের টাকা, যেসব প্রতিষ্ঠান নিয়ে মামলা ও তদন্ত চলছে।ত্রিশে জুনের আগে ইভ্যালিসহ বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে পণ্য ক্রয়ের জন্য অর্থ পরিশোধ করেও পণ্য বা অর্থ গ্রাহকরা পাননি। টাকার অংকে তার পরিমাণ ৩৮৭ কোটি টাকা। এই টাকা কোথায় কীভাবে রয়েছে, তার বিস্তারিত এখনো জানা নেই কর্মকর্তাদের।

মি. সফিকুজ্জামান বলছেন, ''বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমরা চেষ্টা করবো, আদালতের মাধ্যমে রায় এনে এসব টাকা যাতে দ্রুত গ্রাহকদের ফেরত দেয়া যায়। তবে, সেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে (কেস টু কেস) হয়তো আলাদা আলাদা ব্যবস্থা নিতে হবে।''পুরো প্রক্রিয়ার জন্য আরও কিছুটা সময় দরকার হবে বলে তিনি আভাস দেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক কী বলছে?

নগদ, বিকাশ, ফস্টার কর্পোরেশন, সাউথইস্ট ব্যাংক, সূর্যমুখী লিমিডেট, সফটওয়্যার শপ লিমিটেড-ইত্যাদি পেমেন্ট গেটওয়ের কাছে পহেলা জুলাই থেকে ই-কমার্স পণ্য কেনার ২১৪ কোটি টাকা আটকে আছে।বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা নেই, শুধু তাদেরগুলো যেহেতু ফেরত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে তারা সেই তালিকা চেয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মেজবাউল হক বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ''তারা আমাদের যে নির্দেশনা দিয়েছে, আমরা সেটা পেমেন্ট গেটওয়েগুলোকে বলেছি। কিন্তু কাদের বিরুদ্ধে মামলা নেই, সেই তথ্য তো আমাদের দিতে হবে। আমরা সেটা তাদের কাছে জানতে চেয়েছি। তারা সেই তথ্য জানালে আমরা ফেরত দেয়ার প্রক্রিয়া শুরুর নির্দেশ দেবো।''তিনি জানান, পরিষ্কার নির্দেশনা পেলে এই টাকা ফেরত দেয়া খুব বেশি সময়ের কাজ নয়।

ইভ্যালি নিয়ে কী হচ্ছে?

ই-কমার্স খাতে যে টাকা আটকে রয়েছে, তার সিংহভাগই ইভ্যালি নামের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের কারণে হয়েছে, যদিও এই টাকার অংশটি পরিষ্কারভাবে জানাতে পারেননি কর্মকর্তারা।ইভ্যালির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠানটির নতুন ব্যবস্থাপনা পর্ষদ গঠন করে দিয়েছে।

হাইকোর্ট নির্ধারিত ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব কবির বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, তারা এখনো প্রতিষ্ঠানটির অর্থ, সম্পদ, গ্রাহক লেনদেনের নিরীক্ষার কার্যক্রম চালাচ্ছেন।

মাহবুব কবির বলছেন, ''আমাদের তো ব্যবসা করতে বলা হয়নি। আমাদের মূল যে কাজ অডিট করা, হিসাবনিকাশ পর্যালোচনা করে পুরো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক চিত্রটা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি। সেই আর্থিক চিত্র নিয়ে আসার পর বুঝতে পারা যাবে যে, ব্যবসা হিসাবে এটাকে আবার চালু করা যাবে নাকি যাবে না। এখানে সবকিছু অগোছালো হয়ে আছে। তার মধ্যে আমরা এই কাজগুলো করার চেষ্টা করছি।''কর্মকর্তারা এখন ইভ্যালির কাগজপত্র এবং মালামালের পরীক্ষা নিরীক্ষার কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।

একদিকে অর্ডারের অনেক পণ্য গোডাউনে পড়ে রয়েছে। আবার অনেক গ্রাহকের পণ্য ইতোমধ্যে সরবরাহ করা হয়ে গেছে, কিন্তু সিস্টেম ডাউন থাকার কারণে সেসব তথ্য আপডেট হয়নি।

সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির বলছেন, ''যে টাকাগুলো আছে, সেটা ফেরতের একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে। টাকাগুলো তো আর পড়ে থাকবে না। কিন্তু কীভাবে সেটা ফেরত দেয়া হবে, মালামালের কী হবে, সেজন্য তথ্য যাচাই করতে হবে। কিন্তু মামলার রায়ে অডিট কার্যক্রমের আগে টাকা বা মালামালে হাত দিতে বলা হয়নি।''

''আমরা আগে অডিট করে নেই। তারপরে আদালতে যাব যে, আমাদের এতো টাকা, এতো মালামাল আছে। আমরা কী করবো? সেই সময় আমরা অনুমতি চাইবো। এর আগে আমাদের কিছু বলারও নেই, আমরা কিছু করতেও পারবো না কারও জন্য,'' বলছেন মি. কবির।পুরো বিষয় শেষ হতে কতো সময় লাগবে, তা সম্পর্কেও পরিষ্কার কোন ধারণ দিতে পারছেন না কর্মকর্তারা।

সূত্র : বিবিসি