লঞ্চে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কী বলছে মালিক ও কর্তৃপক্ষ?

লঞ্চে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কী বলছে মালিক ও কর্তৃপক্ষ?

লঞ্চে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কী বলছে মালিক ও কর্তৃপক্ষ?

বরগুনার বাসিন্দা আফসানা মিমি ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।ঢাকায় যাতায়াতের জন্য বরাবরই তিনি নৌপথ বা লঞ্চ ব্যবহার করেন।''বাসে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয়। কিন্তু লঞ্চে হাঁটাচলা করা যায়, বাথরুম আছে। রাতে উঠে ঘুম দিলে সকালেই ঢাকা।''কিন্তু অভিযান-১০ লঞ্চে আগুন লেগে বহু হতাহতের ঘটনার পর তিনি লঞ্চে যাতায়াতে ভয় পেতে শুরু করেছেন।

''আগে ভালো করে খেয়াল করি নাই, কিন্তু এখন চিন্তা করে দেখতে পাচ্ছি, আমরা যেসব লঞ্চে চড়ি, তা তো পুরোপুরি নিরাপদ না। কেবিনে লাইফ জ্যাকেট থাকে না। বারান্দায় যে লাইফ বয়া ঝুলানো থাকে, সেগুলো সবার জন্য যথেষ্ট না। আগুন নেভানোর যন্ত্রও থাকে না,'' বলছিলেন আফসানা মিমি।

লঞ্চে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে অনেক প্রশ্ন

২৩শে ডিসেম্বর রাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদী দিয়ে যাওয়ার সময় অভিযান-১০ লঞ্চে আগুন লাগার পর অন্তত ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আশঙ্কাজনক আরও কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

ওই লঞ্চে থাকা যাত্রীরা অভিযোগ করেছেন, আগুন লাগার পরে তারা পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট বা বয়া পাননি। অনেককে সাঁতার না জানার পরেও পানিতে লাফিয়ে পড়তে হয়েছে। এমনকি আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত সরঞ্জাম বা কর্মীদের প্রশিক্ষণও ছিল না।ওই ঘটনায় মালিক-কর্মকর্তা কর্মচারীদের গাফিলতির অভিযোগ এনে বরগুনায় একটি মামলা হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, ''আমার প্রাথমিকভাবে যেটা বলতে পারি, এই লঞ্চের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা তেমন কার্যকর ছিল না এবং যারা দায়িত্বে ছিল, তারা এটা ম্যানেজ করতে পারেনি।''বরিশাল বিআইডব্লিউটিএর পরিদর্শন দল লঞ্চটি পরিদর্শন করে জানিয়েছে, লঞ্চটিতে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও পর্যাপ্ত ছিল না।তিনি বলেছেন, ''ঢাকা বরিশাল সব লঞ্চেই বিলাসবহুল ব্যবস্থা থাকে, কিন্তু ইঞ্জিনরুমে নিরাপত্তার জন্য কিছুই থাকে না।''

অভিযান-১০ দুর্ঘটনার পর নিরাপত্তাহীনতার এসব ইস্যু সামনে এসেছে। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলে লঞ্চে চলাচলকারী যাত্রীরা জানিয়েছেন, ভোলা, মুলাদী, চরফ্যাশন, হাতিয়া, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর ইত্যাদি রুটের লঞ্চেও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম দেখতে পাওয়া যায় না।

ভোলার একজন বাসিন্দা নাহিদ তন্ময় বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ''লঞ্চগুলোয় পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট কখনোই দেখতে পাইনি। বয়াগুলো এমনভাবে আটকানো থাকে যে, দরকারের সময় আপনি খুলতেই পারবেন না। ফায়ার ডিসটিংগুইশার কখনো কখনো সামনের দিকে দেখা যায়, কিন্তু আগুন লাগলে আপনি সেখানে যেতেই পারবেন না।''

তিনি জানান, অনেক সময় কেবিনগুলো ভেতরের দিকে থাকে। তার সামনেও রাতে লোকজন ঘুমিয়ে থাকে। ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে সহজেই বের হওয়া যায় না। অনেক সময় কেবিনগুলোর গেটও বন্ধ করে দেয়া হয়।তবে এসব অভিযোগ মানতে রাজি নন বাংলাদেশ লঞ্চ মালিক সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বদিউজ্জামান বাদল।

তিনি বলছেন, ''সব লঞ্চে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম থাকে। না হলে তো পোর্ট থেকে লঞ্চই ছাড়তে দেবে না। কাগজপত্রে যতগুলো থাকা উচিত, আমাদের সব লঞ্চে ততগুলোই লাইফ-জ্যাকেট, বয়া, অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম থাকে।''

কর্মীদের আগুন নেভানোর কোন প্রশিক্ষণ নেই

অভিযান-১০ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সেখানকার কর্মীদের আগুন নেভাতে অদক্ষতা এবং প্রশিক্ষণের অভাবের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে।সদরঘাট থেকে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে ২২১টি লঞ্চ চলাচলের অনুমতি রয়েছে। তার মধ্যে প্রতিদিন গড়ে ৮৫টি লঞ্চ ঢাকা থেকে ছাড়ে। একই সংখ্যক লঞ্চ বিভিন্ন রুট থেকে ঢাকার দিকে আসে।

দমকলের কর্মকর্তারা বলেছেন, এই লঞ্চে কয়েকটি অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র থাকলেও সেগুলোর কোন ব্যবহার হয়নি। এমনকি সদরঘাট থেকে চলাচলকারী লঞ্চগুলোয় কখনো অগ্নিনির্বাপণ মহড়াও হয় না।ফায়ার সার্ভিসের ঢাকার সদরঘাট স্টেশনের কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবু সায়েম বলেছেন, '' লঞ্চের কর্মীদের অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে কোন ধারণা নেই।''

যাত্রীরা অভিযোগ করেছেন, বড় বড় দুর্ঘটনায় নিরাপত্তার অভাব নিয়ে আলোচনা হয়, কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতির তেমন পরিবর্তন আসেনি।লঞ্চের মালিকরাও স্বীকার করছেন, কর্মীদের প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। তবে এজন্য তারা সরকারকে উদ্যোগ নেয়ার আহবান জানাচ্ছেন।

বদিউজ্জামান বাদল বলছেন, ''এটা আমি স্বীকার করি, কর্মীদের প্রশিক্ষণের অভাব আছে। সরকারকে আহবান জানাই, তারা যেন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে একটা সার্টিফিকেট দেয়ার ব্যবস্থা চালু করে।''মালিক হিসাবে আপনারা কেন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছেন না, জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ''আমরা কীভাবে প্রশিক্ষণ দিবো? আমরা তো আর সার্টিফিকেট দিতে পারবো না। সরকারকেই সেই ব্যবস্থা করতে হবে।''

কী বলছে কর্তৃপক্ষ?

ঝালকাঠিতে অগ্নিকাণ্ডে বহু হতাহত হওয়ার পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, লঞ্চটিতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের যে সংস্থা নৌ-চলাচল তদারকি করে থাকে, সেই সংস্থাটি বলছে, লঞ্চে যা যা থাকা উচিত, সবগুলোই ঠিক ছিল বলে তারা দেখতে পেয়েছেন।লঞ্চ ছাড়ার আগে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) যে চেক লিস্ট করেছিল, তাতে উল্লেখ ছিল, লঞ্চে কোন ক্রুটি নেই।

বিআইডব্লিউটিএ সদস্য (পরিকল্পনা ও পরিচালন) মোঃ দেলোয়ার হোসেন বলেছেন, ''আমাদের জানা মতে, অভিযানের লঞ্চটাতে পুরোপুরি সব সরঞ্জাম ছিল। কারণ চেকিং করে সবকিছু ঠিক থাকলে ভয়েজ ডিক্লারেশন দেয়া হয়।''''তবে এটা যা হয়েছে, তা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। তবে যাত্রীদের নিরাপত্তা সরঞ্জামের তেমন অভাব ছিল না। এটা ঠিক, প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। আমরা এই বিষয়ে জোরালোভাবে চিন্তা করছি যাতে সব কর্মীদের প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা যায়।''

সূত্র : বিবিসি