নির্বাচনে আস্থা ফেরাতে কমিশনের সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ ?

নির্বাচনে আস্থা ফেরাতে কমিশনের সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ ?

নির্বাচনে আস্থা ফেরাতে কমিশনের সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ ?

বাংলাদেশে সদ্য গঠিত নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা রবিবার শপথ নিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি গঠিত এই কমিটির তত্ত্বাবধানে ২০২৩ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

দেশটিতে নির্বাচনী ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের ওপর বড় ধরনের অনাস্থার মধ্যেই নতুন এই কমিশন গঠিত হলো।এই নির্বাচন কমিশন গঠনে যে সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছিল, সেখানেও বিরোধী বিএনপিসহ একাধিক দল অংশগ্রহণ করেনি। নতুন কমিশন গঠনের জন্য কোনো নামও তারা সার্চ কমিটির কাছে জমা দেননি।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রবিবার বলেছেন, নির্বাচন কমিশন নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। তাদের একমাত্র দাবি, তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন গঠন করে যেন নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।এমন পরিস্থিতি এই নির্বাচন কমিশনের সামনে রাজনৈতিক দল, জনগণ এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের আস্থা অর্জন করতে পারাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।

আস্থা অর্জন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ

রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ শনিবার নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা ঘোষণা করেন।এতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হয়েছেন সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল। বাকি চারজন কমিশনার হচ্ছেন- সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ বেগম রাশিদা সুলতানা ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবীব খান।

নুরুল হুদার নেতৃত্বে সর্বশেষ নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে যে নির্বাচনগুলো হয়েছে, সেগুলোর সুষ্ঠুতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় ইউনিয়ন পর্যায়ের নির্বাচনেও ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে।

সাবেক একজন নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত বিগ্রেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ''তাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, এই যে বাংলাদেশি নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে বলে কথা উঠেছে, সেই জায়গায় রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি, ভোটার- সবাইকে আশ্বস্ত করতে হবে যে, তারা এই অবস্থা থেকে বের হতে পারবেন। বের হওয়ার জন্য যা করা দরকার, সেটা দ্রুত করবেন।''

আস্থা অর্জন করতে পারাটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জের কথা বলছেন, যা এই নতুন কমিশনকে মোকাবেলা করতে হবে।তিনি বলছেন,'' একটা চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সিস্টেমটাকে তারা কতটা স্বচ্ছ করতে পারবেন। বিশেষ করে ইভিএম নিয়েও বিশাল প্রশ্ন উঠেছে। সব রাজনৈতিক দলকে তারা সাথে আনতে পারবেন কি না-যদি না পারেন, তাহলে তারা কী ব্যবস্থা নেবেন? গত দুই সময়ে যে নির্বাচনগুলো হয়েছে, সে বিষয়ে তারা কী অ্যাকশন নেবেন?''

তিনি বলেন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারকে সাথে নিয়ে তাদের কাজ শুরু করতে হবে।নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ফেমার প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান বলছেন, নির্বাচন নিয়ে 'ট্রাস্ট বিল্ডিং' বা বিশ্বাস তৈরি করতে পারাটাই হবে এই কমিশনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

তিনি বলেন, "একটা সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হলে, আগে আস্থা অর্জন করতে হবে। শুরুতেই তাদের চিন্তাভাবনা করে কাজ শুরু করতে হবে, যাতে তাদের সদিচ্ছা, কমিটমেন্ট কতটুকু, সেটা যেন জনগণ বুঝতে পারে।"

''রাজনৈতিক দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। নির্বাচন পর্যবেক্ষক, গণতান্ত্রিক বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় করে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের পরিকল্পনা তুলে ধরতে পারেন, তাহলে হয়তো সেটা তাদের জন্য সহজ হবে। তারা যে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করবেন, এটা যদি তারা বুঝিয়ে দিতে পারেন, তাহলেই অনেক বড় কাজ হয়ে যাবে,' বলেন তিনি।

কী করতে পারে ইলেকশন কমিশন?

সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, কমিশনের উচিত আগে খুঁজে বের করা যে আগের দুই মেয়াদের নির্বাচন কমিশন কেন বিতর্কিত হয়েছে। তাদের বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে, নির্বাচনের ব্যাপারে তারা এখন কোন অবস্থানে রয়েছেন।

''তাদের বুঝতে হবে আস্থার সংকটগুলো কেন তৈরি হয়েছে, কোথায় তৈরি হয়েছে। সেই মোতাবেক সংকটগুলো কাটানোর চেষ্টা করতে হবে। প্রথমত ভোটের ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটির আস্থা অর্জন করতে হবে। সেজন্য তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে,'' বলছেন মি. হোসেন।

তিনি বলছেন, ''তারা তাদের কাজটুকু যদি সঠিকভাবে করেন, সেখানে যদি সরকার বা রাজনৈতিক দল সহযোগিতা না করে, তাহলে জনগণ দেখবে যে অ্যাটলিস্ট ইলেকশন কমিশন তাদের কাজ ঠিকমতো করার চেষ্টা করেছে। তখন তারা চিন্তা করবেন যে, কী করতে পারেন।''ফেমার প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান বলেন, ''তাদের যে সদিচ্ছা আছে, তারা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত স্বাধীন থাকবেন বলে যে কমিটমেন্ট আছে, সেটা যদি জনগণকে বুঝিয়ে দিতে পারেন, তাহলেই তারা অনেক বড় কাজ করে ফেলবেন।''

সরকারের প্রভাব কাটাতে পারবে?

রাষ্ট্রপতি গঠিত একটি সার্চ কমিটির সুপারিশের মাধ্যমে নতুন এই নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। গত পাঁচই ফেব্রুয়ারি ওই সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ।শনিবার সেই কমিটির প্রস্তাবিত ব্যক্তিদের ভেতর থেকে একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং চারজনকে কমিশনার হিসাবে নিয়োগ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। এই প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়নি বিরোধী বিএনপি।

নির্বাচন কমিশনের ওপর ক্ষমতাসীন সরকারের বরাবরই একটা প্রভাব দেখা যায় বলে নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা অভিযোগ করেন।তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গঠিত নির্বাচন কমিশন নিয়ে এরকম প্রশ্ন না উঠলেও পরবর্তীতে যে দুটি কমিশন গঠিত হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে না পারার জোরালো অভিযোগ উঠেছে।

এ প্রসঙ্গে সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ''বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যা, সেখানে সিটিং গর্ভমেন্ট যদি তার প্রভাব না কমায়, তারা যদি ভালো নির্বাচনের জন্য ইলেকশন কমিশনকে কাজ করতে না দেয়, তাহলে ইলেকশন কমিশনের একার পক্ষে কাজটা করা খুব কঠিন।"''চাইলেই হয়তো তারা সেই প্রভাব এড়াতে পারবেন না। কিন্তু তাদের কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে, তাহলে হয়তো তারা প্রভাবটা কমিয়ে আনতে পারবেন। যেমন তাদের দৃঢ় থাকতে হবে, মাঠের (নির্বাচনী) বিন্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে,'' বলছেন মি. হোসেন।

নির্বাচন কমিশন কী বলছে?

নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপন জারির পরে প্রতিক্রিয়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, তারা সব রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানাবেন যেন তারা নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে।

আস্থা অর্জন ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে তারা কী করবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে সদ্য নিয়োগ পাওয়া নির্বাচন কমিশনার মোঃ আলমগীর বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ''এটা নিয়ে আমরা বসবো, আলোচনা করবো। কী ধরনের সমস্যা আছে, সেটাকে কীভাবে সমাধান করা যায়, এসব নিয়ে আলোচনা হবে। দরকার হলে সিভিল সোসাইটির সঙ্গে কথা হবে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা হবে।"''তারপরে হয়তো বলা যাবে, আমরা কী করতে যাচ্ছি। তবে সাংবিধানিকভাবেই তো বলা আছে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব কি? আমরা চেষ্টা করবো সেই দায়িত্ব পালন করার। ''

''নির্বাচন কমিশনের কাজ তো একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা, তাই না? সেটা করার জন্য আমাদের সবরকমের চেষ্টাই থাকবে,'' তিনি বলছেন।

আরেকজন নির্বাচন কমিশনার রাশিদা সুলতানা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ''কাজে বসি, দেখি কি পরিস্থিতি। এরপর আমরা নিজেরা আলোচনা করে, সাংগঠনিক পদ্ধতিতে যেভাবে কাজ করার দরকার, সেটা আমরা করে যাবো। আমার মনে হয়, কাজ শুরু করলে কোন সমস্যা আর থাকবে না।''কমিশনের ওপর আস্থা অর্জনের জন্য যেসব পন্থা রয়েছে, সেসব বিচার বিবেচনা করেই তারা উদ্যোগ নেবেন বলে তিনি জানান।

সূত্র : বিবিসি