যেভাবে ইতিহাস রচনা করলেন যোগী আদিত্যনাথ

যেভাবে ইতিহাস রচনা করলেন যোগী আদিত্যনাথ

ছবি: সংগৃহীত

ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি সহজ জয়ই পেয়েছে ।

তবে দেশটির নির্বাচনী ইতিহাসের অন্তত সিকি শতাব্দীর রেকর্ড ভেঙে প্রথমবারের মতো কোনো দল সেখানে পরপর দ্বিতীয়বারের মতো জয়ী হলো।

দলের নির্বাচনী প্রচারে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। মাথা কামানো, গেরুয়া পরিহিত হিন্দু পুরোহিত থেকে যিনি রাজনীতিক বনে গেছেন।

ভোটের আগের নির্বাচনী স্রোত ঠিক তার অনুকূলে দেখা যায়নি। বরং ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সমালোচনা তো ছিলই। আর সেই সাথে ছিল দলের ভেতর থেকেই বিরুদ্ধাচরণ।

গত সপ্তাহে গোরখপুরে তার নির্বাচনী প্রচারে ছিলেন। তিনি একটি প্রভাবশালী মন্দিরের পুরোহিত ছিলেন।

গাঁদা ফুলে সজ্জিত তার নির্বাচনী ট্রাক শহরের সরু অলিগলি দিয়ে যখন যাচ্ছিল তখন তার ভক্ত-সমর্থকরা উল্লাস করছিলেন। অনেকে ব্যালকনি বা ছাদে দাঁড়িয়ে তাকে দেখার চেষ্টা করছিলেন। কেউ কেউ ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন ফুল।

যোগী আদিত্যনাথ বিজয়-চিহ্ন দেখাচ্ছিলেন আর লাউড স্পীকারে বাজছিল দলীয় সঙ্গীত। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে বাতাসে শোনা যাচ্ছিল হিন্দু ধর্মীয় শ্লোগান।

তার পাশে থাকা একজন বিজেপি এমপি বলছিলেন, 'এটি জয়োৎসব'। কথাটিকে তখন অপরিপক্ব মন্তব্য মনে হলেও বৃহস্পতিবারের ফল দেখাচ্ছে যে তাদের আত্মবিশ্বাস নিষ্ফলে যায়নি।

ব্যাপক বিতর্কিত এক চরিত্র যোগী আদিত্যনাথ একই সাথে ঘৃণা ও ভালবাসার পাত্র।

তার ভক্ত-অনুসারীদের কাছে তিনি পবিত্র মানুষ, হিন্দু আইকন, দেবতার প্রতিচ্ছবি কিংবা হয়তো দেবতাই। কিন্তু সমালোচকরা তাকে বর্ণনা করেন ভারতের সবচেয়ে বেশি বিদ্বেষ-ছড়ানো রাজনীতিক হিসেবে। যিনি নির্বাচনী প্রচারে প্রায়ই মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্য দিয়েছেন।

তার পাঁচ বছরের শাসনে মুসলিমদের গণপিটুনি আর মুসলিম-বিদ্বেষী মন্তব্য নিয়মিতই শিরোনাম হয়েছে গণমাধ্যমে।

ভিন্ন ধর্মের বিয়ের বিরুদ্ধে বিতর্কিত এক আইনও করেছেন তিনি।

হোটেল-রেস্তোরাঁয় মাংস খাওয়া বন্ধ করেছেন, বিশেষত যেগুলো মুসলমানরা পরিচালনা করে।

এসব কারণে তাই মনে করা হচ্ছে যে তার দ্বিতীয় মেয়াদ রাজ্যের চার কোটি মুসলমানকে আরো কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলবে।

রাজনৈতিক গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও উত্তর প্রদেশ ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্য। গত পাঁচ বছরে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। অর্থনীতির অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। বেকারত্ব বেড়েছে। দ্রব্যমূল্য আকাশ ছুঁয়েছে। নারীদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতার খবর বারবার শিরোনাম হয়েছে।

গত বছর করোনাভাইরাস মহামারির সময় রাজ্যটি বারবার আলোচনায় এসেছে দুর্বল ব্যবস্থাপনার জন্য। যেখানে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে অনেক মানুষ। শ্মশানে চিতা জ্বলেছে দিন-রাত এবং গঙ্গায় ভেসে উঠেছিল অনেক লাশ। কিন্তু প্রতিবাদ ও নাগরিকদের হতাশা সত্ত্বেও বিজেপি এ গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যটির নির্বাচনে অনেকটা ভূমিধ্বস বিজয়ই পেয়েছে।

যোগী আদিত্যনাথকে নিয়ে একটি বই লিখেছেন সুপরিচিত সাংবাদিক ও লেখক শরৎ প্রধান।

তিনি বলছেন যে, আদিত্যনাথ ভোটারদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে তার অধীনে রাজ্যের উন্নতি হয়েছে, "এগুলো অর্ধসত্য ও মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে বলা হয়ে থাকলেও কেউ প্রোপাগান্ডায় বিজেপিকে হারাতে পারে না। দলটি মিস্টার আদিত্যনাথের অর্জন প্রচারের জন্য ব্যয় করেছে প্রায় সাড়ে আট কোটি ডলার। যদিও তার অনেক প্রকল্পই এখনো কাগজে-কলমে। এমনকি লখনৌ মেট্রো, ওমেন হেল্প লাইন, এক্সপ্রেসওয়ে ও একটি ক্রিকেট স্টেডিয়ামসহ আগের সরকারের অনেক কিছুও তারা নিজেদের অর্জন হিসেবে প্রচার করেছে।

বিজেপি সাফল্যের সাথে এমন ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে যে তারা একাই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারে ও নারীদের নিরাপত্তা দিতে সক্ষম।

শরৎ প্রধান বলছেন, এগুলোর বাইরেও যোগী আদিত্যনাথ সাফল্যের সাথে ভোটারদের মধ্যে ধর্মীয় রেখা টেনে দিয়েছিলেন। হিন্দুত্ববাদই ছিল প্রধান সেলিং পয়েন্ট। তার কট্টর সমর্থকদের কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ নয় যে আদিত্যনাথ তাদের জন্য কী করলেন, বরং তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো-তিনি মুসলিমদের নিয়ে কী করলেন। আর এটিই তার বিজয় নিশ্চিত করেছে।

গোরখপুরের সাংবাদিক উমেশ পাঠক বলছেন যে বেশ কিছু জনকল্যাণ প্রকল্পও সরকার ভোটাদের প্রভাবিত করতে ব্যবহার করেছে।

করোনা মহামারি শুরুর পর ২০২০ সালে প্রায় পনের কোটি মানুষকে ফ্রি রেশন দেয়া হয়েছে এবং অতি দরিদ্র হাজার হাজার পরিবারকে ঘর ও টয়লেট নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। তার অধীনে স্থানীয় প্রশাসন অনেক কাজ করেছে। তিনি কঠোর পরিশ্রমী। প্রকল্পগুলোর তদারকিতে নিয়মিত বৈঠক করেছেন যা কর্মকর্তাদের কাজে ব্যস্ত রেখেছে।

দু'হাজার সতেরো সালে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আদিত্যনাথের মনোনয়ন অনেককে বিস্মিত করেছিল।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজের পছন্দেই রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ এ রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাকে নির্বাচন করেছিলেন।

এ রাজ্যেই ভারতীয় লোকসভার বেশি আসন। যার সংখ্যা ৮০। মূলত আরএসএস এর প্রভাবেই যোগী আদিত্যনাথকে বেছে নিয়েছিলেন মোদী।

তবে এবার তার সমর্থকরা বলছে যে যোগী আদিত্যনাথকে 'অপরাজেয়'তে পরিণত করেছে এবারের জয়।

গোরখপুর ও রাজ্যের রাজধানী লখনৌতে গত সপ্তাহেই গুজব ছড়িয়েছিলো যে এই হিন্দু নেতার সাথে বিজেপি নেতৃত্বের বড় বিবাদ হয়েছে। দলের একজন সিনিয়র নেতা বলছিলেন যে যোগী আদিত্যনাথের উচ্চাকাঙ্খা দলের নেতৃত্বকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। এর আগে দায়িত্ব নেয়ার ছয় মাসের মধ্যেই গুজব ছড়ায় যে তিনিই ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী যা মিস্টার মোদীর সেকেন্ড ইন-কমান্ড অমিত শাহর সাথে ভালো যায়নি। তিনি একে হুমকি হিসেবে মনে করেছিলেন।

আদিত্যনাথ সাবেক অনেক বন্ধু ও সহকর্মীর সাথে দূরত্ব তৈরি করেছেন। তাদের একজন বলেছেন যে দলের মধ্যে অনেকেই তাকে হারাতে কাজ করেছে। রাজনীতি কোনো ব্যক্তিগত খেলা নয়। আপনাকে টিম মেম্বার হতে হবে। কিন্তু তিনি ছিলেন একরোখা। রাজনীতি ঘুড়ি ওড়ানোর মতো। আপনাকে প্রয়োজনে শক্ত বা নরম করতে হবে সুতো। সঠিক সময়ে এটা করতে পারলে ছিঁড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

আদিত্যনাথের সহকারী হিসেবে তিন দশক মন্দিরে কাজ করেছেন এমন একজন সব গুজবকে উড়িয়ে দিয়েছেন।
‘এটা বড় রাজ্য। আপনি সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারবেন না। কিন্তু তিনি সবসময় ভালো লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেছেন ও সফল হয়েছেন। সরকারে স্বচ্ছতা এনেছেন। জনগণ সরকার নিয়ে অসন্তুষ্ট নয়’ বলছিলেন তিনি।

তাকেই আবার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেয়া হবে না কেন সেই প্রশ্নই বরং তুলেছেন তিনি।

সাংবাদিক শরৎ প্রধান বলছেন - দলের মধ্যে বিভেদের ঘটনা সত্যি।

‘যোগী আদিত্যনাথ পরিচিত মোদীর প্রতি অবাধ্য হিসেবে- কিন্তু পার্টি যদি তাকে র‍াজ্য থেকে সরিয়ে দেয় তাহলে তাকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় নিতে হবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে তিনি দলীয় নেতৃত্বের জন্য আরও সমস্যা তৈরি করতে পারেন’ বলছিলেন তিনি।

পাঁচ বছর আগে যোগী আদিত্যনাথকে বলা হতো 'বিজেপির ভবিষ্যৎ'। বয়স তার পক্ষে-মাত্র ৪৯। মিস্টার মোদীর চেয়ে বিশ বছরের ছোটো তিনি।

অনেকেই তাই অবাক হবেন না-একদিন যদি তিনি প্রধানমন্ত্রী পদটিরও দাবিদার হন।

আজ তিনি তার কিছুটা হলেও এগিয়ে গেছেন।

সূত্র : বিবিসি